Monday, April 21, 2014

স্ট্রবেরি চাষ করে মণিরামপুরের শিক্ষিত বেকার ফারুক হোসেন স্বাবলম্বী

যশোর: স্ট্রবেরী সারা বিশ্বের একটি জনপ্রিয় ফল। কিছুটা লিচুর ন্যায়, দৃষ্টি নন্দন ও সুস্বাদু। এ ফলটি জীবন রক্ষাকারী নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এটি বীরুৎ জাতীয় বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ। এটি শীত প্রধান দেশের ফসল হলেও এ দেশে শীতকালে স্ট্রবেরী চাষ সম্ভব। সারা পৃথিবীতে নানা জাতের স্ট্রবেরী চাষ হলেও- দীর্ঘ দিবাজাত, স্বল্প দিবা জাত ও দিন নিরপেক্ষ জাতের চাষ বেশী হয়। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেন সোমা ক্লোনাল ভেরিয়েশন প্রযুক্তির সাহায্যে এ দেশে চাষ উপযোগী করে- রাবি-১, রাবি-২, রাবি-৩ নামে তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছেন। খোলামেলা জায়গা, পানি নিষ্কাশন, সেচ, তাপমাত্রা, উজ্জ্বল সূর্যলোক অর্থাৎ উপযুক্ত পরিবেশে বাংলাদেশের নানা জায়গায় গত কয়েক বছর যাবৎ এর চাষ শুরু হয়েছে এবং স্বাবলম্বী হচ্ছে শিক্ষিত বেকার যুবকরা। 

টেলিভিশনে স্ট্রবেরী চাষের ওপর একটি সচিত্র প্রতিবেদনসহ অনুষ্ঠান দেখে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মোহনপুর গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের পুত্র এমএ পাস শিক্ষিত বেকার যুবক ফারুক হোসেন শিমুলের আগ্রহ জন্মে স্ট্রবেরী চাষের। টেলিভিশন থেকে নেয়া তথ্য নিয়ে শিমুল ছুটে যান মাগুরার স্ট্রবেরী চাষি তুহিনের কাছে। তুহিনের মাধ্যমে শিমুল চলে যান এ দেশের স্ট্রবেরী চাষের উদ্ভাবক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধাপক ড. মনজুর হোসেনের কাছে। আত্মবিশ্বাসের প্রতীক শিমুল ড. মনজুর হোসেনের মাধমে স্ট্রবেরী চাষের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরিদর্শন করেন দেশের বিভিন্ন স্থানের নানা ক্ষেত। স্ট্রবেরী চাষের ওপর সম্যক ধারণা নিয়ে বাড়ি ফেরেন শিমুল।

সংকটময় ও তীব্র প্রতিযোগিতার এ সময়ে চাকরির পেছনে না দৌঁড়িয়ে তিনি স্থির করেন নিজেকে আমি স্ট্রবেরী চাষ করবো এবং নিজেকে অন্যান্যের ন্যায় আত্মনির্ভরশীল করে তুলব। সে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে স্থানীয় কামালপুর মাঠে ২০ কাঠা জমি লিজ নিয়ে উদ্ভাবক ও মাগুরার চাষী তুহিনের পরামর্শ মোতাবেক নিজস্ব প্রজ্ঞা খাটিয়ে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে ৫ হাজার চারা রোপণ করেন গত বছর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে।

নভেম্বর-এপ্রিল পর্যন্ত ৫ মাস এ চাষের জন্য উপযোগী সময়। জমি লিজ, উপযুক্ত মাটি, সেচ, সার, উত্তম পরিচর্যাসহ ফল আসা পর্যন্ত গতবছর শিমুলের খরচ হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার টাকা। ৪৫-৬০টি স্ট্রবেরীতে ১ কেজি হয়। প্রতি কেজি স্ট্রবেরী (ফল) পাইকারি স্থানীয় যশোরের হাটবাজারে ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ৯শ’ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। খরচ বাদে প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় হয়েছে তার। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে প্রতিটি স্ট্রব্রেরী গাছ থেকে ৩শ’ গ্রাম ফলা পাওয়া যেতে পারে। তবে তার ক্ষেতের গাছ থেকে আরও বেশি ফল পাওয়া গেছে বলে শিমুল জানান। এ বছরও স্ট্রবেরী চাষের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে শিমুল। 
মাত্র ৫/৬ মাসে ৩ লাখ টাকা আয় করা একজন শিক্ষিত বেকার যুবকের স্বপ্নের ব্যাপার হলেও মণিরামপুরের মোহনপুর গ্রামের শিক্ষিত বেকার যুবক শিমুল সে স্বপ্নকে সম্ভব এবং বাস্তবে পরিণত করে চলেছেন। সে এখন আধুনিক প্রযুক্তিতে গড়ে তুলেছেন অগ্রণী বিশেষায়িত কৃষি খামার। 

Saturday, April 19, 2014

ব্যাটের গ্রাম যশোরের নরেন্দ্রপুর : সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত

যশোর: যশোর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অজপাড়া গাঁ নরেন্দ্রপুরের মিস্ত্রিপাড়া। এটা এখন ব্যাটের গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। শতাধিক পরিবার জড়িয়ে পড়েছে এই পেশায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন ক্রিকেটের ব্যাট তৈরিতে। অনেকেই আগে পেশায় ছুতোর ছিলেন। আর্থিক দিক থেকে  তা লাভজনক না হওয়ায় সে পেশা ছেড়ে দিয়ে তারা ব্যাট তৈরি করতে শুরু করেন। এতে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার এসেছে। তাদের দেখাদেখি অনেকে ভাগ্য ফিরাচ্ছেন এই পেশা বেছে নিয়ে। তাদের তৈরি ব্যাট পৌঁছে যাচ্ছে বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। 

প্রায় ২০ বছর আগে এ গ্রামের সঞ্জিত মজুমদার এই কাজটি শুরু করেছিলেন। খুলনার ক্রীড়াসামগ্রী ব্যবসায়ীরা তাকে এই ব্যাট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেন। সঞ্চিত নমুনা এনে কয়েকটি ব্যাট তৈরি করে দেখালেও তখনো কিছু সমস্যা ছিল। এরপর ব্যবসায়ীরা তাকে উন্নতমানের ব্যাট তৈরির কলাকৌশল শিখিয়ে দেয়। কিন্তু সঞ্জিত সে শিক্ষা ধরে রাখতে পারেনি। তবে তার কাজ দেখে অনেকেই এগিয়ে এসেছে এবং তারা কাজ শুরু করে দেয়। তারা ফলও পেয়ে যায়। এখন এই পরিবারগুলোর দৈন্যতা নেই, তারা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। 

ব্যাট প্রস্তুতকারী মো. তরিকুল ইসলাম ব জানান, আমাদের বড় সমস্যা বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ থাকলে যন্ত্র বসিয়ে কাজ করতে পারতাম। তিনি জানান, হাতে কাজ করা বেশ কঠিন। 

ছোট ব্যাট, বড় ব্যাট, ভালমানের ব্যাট তৈরি হয় এখানে। প্রকৃত সিজনে (শীতকালে) মিস্ত্রিরা কাজ করেন দিন-রাত। এখন অফ সিজন স্বাভাবিক বাজার ধরে রাখতে কাজ করছেন আর আগামী দিনের জন্য জমা করছেন প্রয়োজনীয় কাঠ সাইজ করে। তবে তাদের বাজার ধরতে হয় বাইরের জেলায়। মোবাইলে অর্ডার পেয়ে রূপদিয়া বাজারে যেয়ে ট্রাকে উঠিয়ে দিতে হয়। দামও সংগ্রহ করতে হয় এইভাবে। পুরুষদের পাশাপশি মহিলারাও কাজ করেন। রং করা, স্টিকার লাগানো, আঠা লাগানো  প্রভৃতি।

ব্যাট তৈরির কারিগরদের নানাবিধ সমস্যা আছে। চলাচলের জন্য গ্রামে এখনো ভাল রাস্তা নেই। বিদ্যুতের অভাবে মেশিনের পরিবর্তে হাতেই কাজ করতে হয় অনেক পরিবারকে। পিলার আছে তার বা বিদ্যুৎ নেই বেশিরভাগ পরিবারে।

ব্যাট নির্মাতা শাহাবুদ্দিন জানান, একেক জন ব্যাট তৈরি করে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা রোজগার করি। প্রায় ১০০’ ঘর এ পেশার সাথে যুক্ত।

হিন্দু-মুসলিম শতাধিক পরিবার কাজ করে দেশের ক্রিকেট খেলার মাঠের তরুণ-যুবকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ব্যাট। তারা যে দাম পান দোকানদাররা পান তার চেয়ে বেশি। যশোরে নেই এই ব্যাটের পাইকারি বাজার। বাজারজাতের জন্যে তাকিয়ে থাকতে হয় অন্য জেলার ক্রেতার উপর। ছোট ব্যাট প্রতিশ’ খুব বেশি হলে ৩ হাজার টাকা, সাধারণ ব্যাট প্রতিশ’ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা এবং ভাল মানের কাঠের তৈরি ব্যাট প্রতিশ’ ২০ হাজার টাকা পান তারা। তবে এর জন্য পর্যাপ্ত কাঠ কেনা, শ্রম দিয়ে তৈরি করা ছাড়াও নানাবিধ বিনিয়োগ করতে হয়। তারপরও লাভ যা থাকে তা দিযে খেয়ে পরে সঞ্চয় থাকে কিছু।

স্বপন বিশ্বাস জানান, ১০-১২ বছর যাবৎ এই কাজ করে জীবন নির্বাহ করে আসছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভাল আছি।

সমস্যা থাকা সত্ত্বেও নরেন্দ্রপুরের মিস্ত্রিপাড়ার মানুষ আনন্দেই সময় কাটান ব্যাট তৈরি করে। বছরের পর বছর তারা আপন মনে নিপূণভাবে তৈরি করছেন খেলার এই সামগ্রীটি। অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের তৈরি ব্যাট পাওয়া যাচ্ছে বলেই বৈদেশিক মূদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে না। আর সরকারি সহযোগিতা, বিদ্যুৎ সমস্যা, রাস্তার সমস্যা, বাজারজাত সমস্যা না থাকলে এটি একটি বড় শিল্পে পরিণত হতে পারে। আসতে পারে সুনাম ও অর্থ দেশের জন্য। 

Monday, April 7, 2014

ভাসমান ধাপে চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষ

যশোর: যশোরের কেশবপুর উপজেলা ও তার সংলগ্ন কপোতাক্ষ পাড়ের অসহায় মানুষ সবজি চাষ করে আর্থিকভাবে পরিবর্তন এনেছেন। তারা পানির উপর ভাসমান ধাপে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সবজি বিক্রি করেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। 

ধাপ চাষে সাফল্য দেখে আরো শত শত কৃষক এখন একাজে উৎসাহিত হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ব বৃহৎ এলাকা জুড়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদ পলিতে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ফলে স্রোতহীন হয়ে পড়া ও পানির ধারণ ক্ষমতা না থাকায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পানি উপচে কপোতাক্ষ অববাহিকা অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। ঘর-বাড়ি, ফসলের মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ডুবে যায়। বন্যার সময় মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে টং ঘর বেঁধে আশ্রয় নেয়। বছরের বেশ কয়েকটি মাস তারা এভাবে টং ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। 

১০/১১ বছর ধরে এ ভাবে বন্যা প্লাবিত হওয়ায় ফসল উৎপাদন করতে না পেরে কপোতাক্ষ অববাহিকা অঞ্চলের অনেক কৃষক অসহায় হয়ে পড়েছে। এ সমস্ত অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি করতে এগিয়ে এসেছে এলাকার কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। যাদের পরামর্শে দরিদ্র মানুষেরা ৫ থেকে ১০ জনের এক একটি গ্রুপ করে কপোতাক্ষ নদে ভাসমান প্রাকৃতিক সম্পদ কচুরীপানা তুলে পচন দেন। এক সপ্তাহ পর তারা পচনকৃত কচুরীপানা দিয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট প্রস্থে ও ৩৫ থেকে ৪০ ফুট দৈর্ঘের ধাপ তৈরি করে। এভাবে ৫০ থেকে ৬০টি ধাপ পর পর সাজিয়ে কপোতাক্ষের পানিতে ভাসিয়ে রাখা হয়। তার পর ওই পচনকৃত কচুরীপানা দিয়ে গোলাকৃতির ট্যামা তৈরী করে ধাপের উপর বসিয়ে দেয়া হয়। 
এরপর ট্যামার মধ্যে লাল শাক, ঢেঁড়স, পালং শাক, মুলা, টমেটো, সীম, মিষ্টি কুমড়া, করলা, আলু, লাউয়ের বীজ বপন  এবং বেগুন, মরিচ, ওলকপি ও ফুলকপির চারা রোপন করা হয়। শাক সবজি বড় হলে কৃষকেরা তা তুলে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। অনেক সময় তারা কপোতাক্ষ পাড় সংলগ্ন হাট বাজারের কাছে ধাপ ভাসিয়ে নিয়ে যেয়েও এসব শাক সবজি বিক্রি করে থাকেন। ক্রেতারাও কপোতাক্ষ পাড়ে যেয়ে ধাপ চাষীদের কাছে থেকে টাটকা শাক সবজি কিনে নেন। 

কৃষকরা জানান, প্রতি মৌসুমে সবজি বিক্রি করে খরচ বাদে এক একজন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। ভাসমান ধাপে উৎপাদিত সবজি চাষের আয় থেকে এসব দরিদ্র মানুষ বন্যা ক্ষতি পুষিয়ে এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বি হয়ে উঠছেন। একটি ভাসমান ধাপ তৈরী করতে খরচ হয় ২৫০ থেকে ২৭৫ টাকা। 

বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সমাধান, সুশীলন ও আইডিও কেশবপুর, তালা ও কলারোয়া উপজেলার কপোতাক্ষ নদ সংলগ্ন গ্রামগুলির বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অসহায় ও দরিদ্র হয়ে পড়েছে এমন মানুষদের পরামর্শ ও ঋণ দিয়ে কপোতাক্ষ নদের পানিতে ভাসমান ধাপ চাষে আগ্রহী করে তোলে। কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষ এ সব সংস্থার পরামর্শ ও ঋণ নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাসমান ধাপ চাষ শুরু করেছেন। 

কেশবপুর, মনিরামপুর, তালা ও কলারোয়া উপজেলার অংশে কপোতাক্ষ নদের যেখানে পানি রয়েছে সেখানেই ধাপ চাষ হচ্ছে। বর্তমানে ৫ থেকে ৬ হাজার ধাপ কপোতাক্ষ নদের পানিতে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। আর এ ধাপ চাষের সাথে জড়িত রয়েছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। 

ধাপ চাষের সাথে জড়িত কেশবপুর উপজেলার চাঁদড়া গ্রামের কৃষক মুনছুর আলি জানান, তারা প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানিতে বন্যা প্ল¬াবিত হয়ে ফসল হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সমাধানের পরামর্শ ও ঋণ নিয়ে কপোতাক্ষের বদ্ধ পানিতে ভাসমান ধাপ চাষ করে তিনি এখন অনেকটা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হয়েছেন। ‘সমাধান’ থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন তাও পরিশোধ করেছেন। তিনি এখন ধাপ চাষের পাশাপাশি ধাপ তৈরী করে অন্যের কাছেও বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। 

আরেক বেসরকারী উন্নয়ণ সংস্থা সুশীলন থেকে ঋণ গ্রহণকারী মুস্তাইন বিল্ল¬াহ একজন সফল ধাপ চাষী। তিনি জানান, সুশীলন থেকে ঋণ নিয়ে ধাপ চাষ করে অনেক টাকা লাভ করেছেন। এ বছর তিনি নিজেই ৪০টি ধাপ তৈরী করে সবজি চাষের মাধ্যমে খরচ বাদে ৪৭ হাজার টাকা আয় করেছন। তার ধাপে যে সবজি রয়েছে তা থেকে তিনি আরো ২০ হাজার  টাকা আয় করতে পারবেন বলে জানান। 

উন্নয়ন সংস্থা সমাধানের পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় ৬৫০ জনকে পরামর্শ ও ঋণ দিয়ে ধাপ চাষে সহায়তা করা হয়। ধাপ চাষের আয় থেকে তারা সংস্থার সব ঋণও পরিশোধ করেছেন । 

কেশবপুর উপজেলা কৃষি কর্ম পাশাপাশি কপোতাক্ষ নদে ভাসমান ধাপ চাষ করে বাড়তি আয় করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে কর্তা সঞ্জয় কুমার দাস জানান, ধাপ চাষ লাভজনক। কপোতাক্ষ অঞ্চলের মানুষ কৃষি জমিতে চাষাবাদের খরচও কম লাগে। ধাপ চাষের শাক সবজি টাটকা ও সুস্বাদু। 

Sunday, April 6, 2014

নড়াইলে পল্লীর জেলেরা এখনো ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরে

নড়াইল: নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম গোয়ালবাড়ি। এ গ্রামে জেলেরা খেয়ে না খেয়ে সংরক্ষণ করে চলেছে বিলুপ্তপ্রায় ভোঁদড়। স্থানীয় ভাষায় এদের ধেঁড়ে নামে ডাকা হয়। জেলেদের জীবিকার অন্যতম হাতিয়ার এই ভোঁদড় কেননা এই ভোঁদড় দিয়ে তারা মাছ ধরে। তাই ভোঁদড় তাদের সন্তানের মতো। নিজের সন্তানকে খেতে দিতে না পারলেও ভোঁদড়ের বাচ্চাকে গরুর দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে এই গ্রামের লোকেরা। ওই ভোঁদড়রাই জেলেদের জালে তুলে দিচ্ছে ট্যাংরা, পুটিসহ নানা রকম মাছ। এ কারণে জেলেদের প্রিয় ভোঁদড়। 

তবে নদীর মাছ কমে যাওয়া, সুন্দরবনে বনদস্যুদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন গোয়ালবাড়ির জেলেরা ভোঁদড় নিয়ে শঙ্কিত। তারা কি বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী ভোঁদড়কে শেষ পর্যন্তু বাঁচিয়ে রাখতে পারবে? এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন পর্যায় থেকে।

জানা গেছে, নড়াইল শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নড়াইল-নওয়াপাড়া সড়কের পার্শ্বে কলোড়া ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি নামক একটি গ্রাম। এ গ্রামে জেলে পাড়ায় প্রায় শতাধিক পরিবার বসবাস করে। এদের অধিকাংশই খাল-বিল, নদী-নালা থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। পরিবারের মহিলারা বাড়িতে বসে জাল তৈরী, কোথাও জাল কেটে গেলে ঠিক করাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকে। কত বছর ধরে তারা ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ ধরছে তার সঠিক তথ্য কেউ জানাতে না পারলেও তাদের বাবা, ঠাকুর দাদারা এর সাহায্যে মাছ শিকার করত বলে জানান। কবে কখন কোথা থেকে ভোঁদড় আনা হয়েছিল তার হিসেব তাদের কাছে নেই। আগে এ গ্রামে কয়েকশ’ ভোঁদড় থাকলেও এখন এর সংখ্যা মাত্র ৩০টির মতো হবে। অভাব অনটনের কারণে অনেকে ভোঁদড় বিক্রি করে দিয়েছে। ভোঁদড় দেখতে অনেকটা বেজির মত। এ প্রাণী দুই থেকে তিন ফুট লম্বা হয়।

ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা সম্পর্কে সচিন বিশ্বাস জানান, জাল দিয়ে তারা গোবরা, চিত্রা, ভৈরব নদীতে মাছ ধরে। দু’জন নৌকা চালায়। দু’জন জাল ধরে রাখে। আর ভোঁদড় জালের সঙ্গে পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদের গলায় রশি দিয়ে বাধা থাকে। এরা মাছ তাড়িয়ে এনে জালে প্রবেশ করায়। কখনো কখনো ডুব দিয়ে বড় মাছ ধরে এনে তুলে দেয় জেলের হাতে।

গুরুপদ বিশ্বাস জানান, কয়েক বছর আগেও আমরা ভোঁদড় নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যেতাম। কিন্তু ডাকাতের অত্যাচারে এখন আর তারা সুন্দরবনে যান না। আশপাশের খালে-নদীতে ভোঁদড়ের সাহায্যে মাছ ধরি। 

হরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের ৭টি, ভুবেন বিশ্বাসের ৪টি, রবিন বিশ্বাসের ৫টি, সচীন বিশ্বাসের ৭টিসহ এখানে প্রায় ৩০টির মত ভোঁদড় রয়েছে। জেলেরা ভোঁদড়গুলোকে সন্তানের মত লালন পালন করে। এদের প্রধান খাবার মাছ এবং ব্যাঙ।

অধির বিশ্বাস জানান, একটি মা ভোঁদড় প্রতিবছর ৪/৫ টি বাচ্চা দেয়। বাঁচ্চা ভোঁদড় মায়ের দুধ, গরুর দুধ পান করে। ৬ মাস পার হলে এরাই মাছ ধরার জন্য পানিতে নামে। তুষার বিশ্বাস বলেন, নদী-খালে মাছ নেই বলে অনেকে ভোঁদড় বিক্রি করে দিয়েছে। একটি ভোঁদড় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়। 

গৃহবধু মীরা জানান, তার স্বামী রবিন অভাবের জন্য ভোঁদড় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। 

ভোঁদড় কিনতে আসা মাগুরার বামনখালী গ্রামের অশোক বিশ্বাস জানান, আমি ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরি। আমার একটি আছে আর একটি কিনতে এসেছি। ১টি পছন্দ হয়েছে, দাম ১০ হাজার টাকা।

জেলে পল্লীর প্রবীণ ব্যক্তি রবিন বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা বাবা, ঠাকুরদার আমলের থেইকেই ভোঁদড় দিইয়ে মাছ ধরতেছি। ভোঁদড়গুলো আমাগের সন্তানের মত। কিন্তু অভাবের জন্যিই আমিও ভোঁদড় বেইচে দিতে বাধ্য হইছি। 

Saturday, April 5, 2014

বাঁশ ও বেত শিল্প পাল্টে দিয়েছে টাঙ্গাইলের বর্নী গ্রাম

টাঙ্গাইল: তাঁত আর মিষ্টি চমচমের জেলা হিসেবে সুপরিচিত টাঙ্গাইলে আরও একটি সম্ভাবনাময় শিল্প ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে, তাহলো বাঁশ ও বেতের মাধ্যমে তৈরি করা কুটির শিল্প। স্বল্প পুঁজি নিয়ে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বর্নী গ্রামে কুটির শিল্পের ব্যবসা করে অনেকের জীবনে এসেছে স্বচ্ছলতা। তাদের তৈরি বাঁশ ও বেতের এসব পণ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ ও দেশের বাইরে। 

উল্লেখ করতে হয় যে, কারুশিল্পী শাহ আলম মিয়া পাল্টে দিয়েছেন পুরো বর্নী গ্রামের চিত্র। এ গ্রামের বাঁশ বেত শিল্পীরা এক সময় বাজার হারাতে হারাতে পেশা ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শাহ আলম তাদের দেখিয়েছেন নতুন ঠিকানা। এখন তার দেখানো পথে সবাই কর্মব্যস্ত। বাঁশ বেতের নিত্য নতুন পণ্যসামগ্রী তৈরি করে সবাই সচ্ছল। 

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল ইউনিয়নে বর্নী গ্রাম। এই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার বংশ পরম্পরায় বাঁশ বেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা সাধারণত কুলা, ধামা, পলো ইত্যাদি তৈরি করতেন। কিন্তু দিন দিন এসব পণ্যের চাহিদা কমে আসছিল। ফলে দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে এ গ্রামের কারুশিল্পীরা। অনেককেই অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হত। পেটের দায়ে অনেকে দিনমজুরিসহ অন্য পেশায় চলে যেতে শুরু করে। মাত্র কয়েক বছর আগেও দেলদুয়ার উপজেলার বর্নী, বারপাখিয়া, বাথুলী, কোপাখীসহ বেশ কয়েকটি  গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন বেকার। 

পরিবর্তনের হাওয়া লাগে এভাবে, গ্রামের মৃত সেফাত উল্লাহর ছেলে শাহ আলম মিয়া স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি শখের বসে গ্রামের অন্যদের দেখে নিজেও বাঁশ বেতের কাজ শিখে ফেলেন। ’৮৯ সালে এইচএসসি পাস করার পর এক সময় শখের বশে শেখা বাঁশ বেতের কাজকেই পেশা হিসেবে নেন শাহ আলম। গ্রামের অন্যদের মতো তিনিও কুলা, ডালা, পলো, মাথাল ইত্যাদি গৃহস্থালি সামগ্রী তৈরি করে স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করতেন। কয়েক বছর এ কাজ করার পর শাহ আলম লক্ষ্য করলেন দিন দিন এসব পণ্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলেন আধুনিক প্লাস্টিক সামগ্রী ক্রমেই বাজার দখল করে নিচ্ছে। বাঁশ বেতের চেয়ে অধিক টেকসই হওয়ায় মানুষ এসবের দিকে ঝুকছে। 

শাহ আলম বলেন, ‘তখন থেকেই আমার মাথায় চিন্তা ঢুকে, নতুন নতুন সামগ্রী তৈরি করতে হবে। তবেই নিজে এই পেশায় টিকে থাকতে পারবো। গ্রামের অন্যরাও খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে।’ ’৯৩ সালের দিকে একদিন শাহ আলম ঢাকার একটি অভিজাত কারুপণ্যের দোকানে গিয়ে কথা বলেন। 

তারা তাকে বাঁশের তৈরি ট্রে ও বেতের তৈরি টেবিল ম্যাটের ডিজাইন দিয়ে বলেন, এগুলো তৈরি করে দিতে পারবেন কিনা। বাড়ি ফিরে এসে কাজে লেগে যান শাহ আলম। পাঁচ দিনের মধ্যেই সেই ডিজাইনের ট্রে ও টেবিল ম্যাট তৈরি করে ঢাকায় নিয়ে যান। শাহ আলমের তৈরি আইটেমগুলো পছন্দ হয় তাদের। তারা শাহ আলমকে এসব পণ্য নিয়মিত সরবরাহ করতে বলেন। 

তারপর থেকেই শাহ আলম নতুন নতুন ডিজাইনের বাঁশ বেতের হস্তশিল্প তৈরি ও সরবরাহ শুরু করেন। শুরুতে নিজে একা তৈরি করে সরবরাহ করতেন। অন্যরা তেমন আগ্রহ দেখাতেন না। শাহ আলম প্রথমে আশপাশের দু’একজনকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিত্যনতুন পণ্য তৈরি করতে শেখান হাতে-কলমে। তৈরিকৃত পণ্য ঢাকায় বিক্রিরও ব্যবস্থা করে দেন। নতুন পণ্য বিক্রি করে ভাল লাভ পেতে থাকেন তারা। ঢাকায় তাদের পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে সবাই শাহ আলমের কাছে কাজ শিখে এবং তার দেয়া ডিজাইন মতো নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন শুরু করেন। 

বর্নী গ্রামের শাহজাহান মিয়া বলেন, প্রথম প্রথম আমাগো নতুন নতুন জিনিস তৈরির আগ্রহ আছিল না। শাহ আলম যখন বুঝাইলো এগুলো তৈরি করলে ভাল টাকা পাওয়া যাব, তহন আমরা তার কথামতো কাজ শুরু করলাম।’ এই গ্রামেরই বাসিন্দা শুকুরি বেগম বলেন, ‘এহন আমরা সবাই শাহ আলমের শেখানো কাজ করি। এতে ভাল পয়সা পাওয়া যায়। আমাগো আর অভাব নাই।’ 

বর্নী গ্রামে এখন প্রতিটি বাড়িতেই ছেলে, বুড়ো, নারী সবাই বাঁশ বেতের কাজ করছেন। অনেক বাড়িতে গৃহবধুরা গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাঁশ বেতের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। জয়নাল আবেদিন (৬৫) বলেন, ‘এক সময় খুব দুরাবস্থার মধ্যে চলতে হতো। এখন খুব ভাল আছি। জিনিষ তৈরির সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যায়।’ 

বর্নী গ্রামের সিুফিয়া ওমর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কালিদাস চন্দ্র মন্ডল বলেন, আগে এ গ্রামের লোকেরা বাঁশ বেতের কাজ করে খুব কষ্টে দিনতিপাত করতেন। এখন তাদের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। তাই তারা খুব ভালো আছেন। 

বর্তমানে বর্নী গ্রামে বাঁশ-বেতের কাজে উৎপাদন তালিকায় আরও নতুন নতুন পণ্যযোগ হচ্ছে। বাঁশের ট্রে, বেতের টেবিল ম্যাটের পর যোগ হয় পেপার ঝুড়ি, লন্ড্রি ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, ফ্লোর ল্যাম্প, জুয়েলারি বক্স, ফটোস্ট্যান্ডসহ নানা ধরনের শো-পিস। বর্তমানে শাহ আলম বাঁশ বেতের গহনা ও জুতো তৈরি করেছেন। এগুলো বাজারজাতকরণের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যেই শাহ আলম বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের ‘শীলু-আবেদ কারুশিল্প পুরস্কার’ লাভ করেছেন। 

Thursday, March 27, 2014

ফুলের ঝাড়– তৈরী করে স্বচ্ছল হবিগঞ্জের পাহাড়ী এলাকার বাসিন্দারা

হবিগঞ্জ : পাকা মেঝে আর টাইলস লাগানো বাসা পরিস্কার করতে গৃহিনীদের অন্যতম পছন্দ ফুলের ঝাড়–। বেশির ভাগ বাসা বাড়িতেই দেখা যায় এই ঝাড়–র ব্যবহার। বিদেশেও যাচ্ছে এই ঝাড়–। আর এই ঝাড়– তৈরীর প্রধান উপকরণ ফুলের অন্যতম উৎসস্থল হল হবিগঞ্জের পাহাড়ী এলাকা। এখানকার দরিদ্র লোকজন ফুলের ঝাড়– তৈরী করে স্বচ্ছলতা পেয়েছেন।

হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকায় প্রাকৃতিকভাইে বেড়ে উঠে বাঁশ, ছন, লতাপাতাসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ। এর মাঝেই এক ধরনের ফুল থেকে তৈরী হয়ে থাকে ঝাড়–। এই ফুলকে স্থানীয়ভাবে রেমা বলা হয়। বন্য এই ফুলের ঝাড়– এখন পাহাড়ে বসবাসরত দরিদ্র লোকজনের আয়ের অন্যতম উৎস।

হবিগঞ্জের বাহুবল, চুনারুঘাট, মাধবপুর ও নবীগঞ্জের কিছু এলাকা পাহাড় সমৃদ্ধ। এই সমস্ত পাহাড়ে উৎপাদিত ফুল থেকে প্রতিবছর ৪/৫ লাখ পিস ফুলের ঝাড়– তৈরী হয়। যার বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। শত শত পরিবার এই ঝাড়– তৈরী এবং বিক্রি করে পরিবারের আয় বাড়াচ্ছেন।

হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার সীমান্ত এলাকায় মুচাই পাহাড় নামে একটি পাহাড় রয়েছে। বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ অনেক বাঙালি পরিবার। সেখানে বসবাসরত মানুষের জীবন-জীবিকা পাহাড়ের ওপরই নির্ভরশীল।

আলিয়াছড়া পাহাড়ের রূপসী বস্তি বা আলিয়াছড়া বস্তিতে যাদের বসবাস তাদের অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। মূলত বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। পাহাড়ের উপর ছোট ছোট কুটিরে তাদের বসবাস। বাগানে কাজ করার পর তাদের হাতে যে সময় থাকে সেই সময়ে বাড়ির আঙ্গিনায় অনেকেই ফুলের ঝাড়– তৈরী করেন। পরে তা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহরে পাইকারী মূল্যে বিক্রি করেন। অনেক সময় পাইকাররাও এসে এই ঝাড়– কিনে নিয়ে যায়।

রূপসী বস্তির বাসিন্দা মনর উদ্দিন জানান, পাহাড়ে কাজ শেষে ফেরার সময় জঙ্গল থেকে কান্ডসহ ফুল সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে রোদে শুকানোর পর তা সাইজ করা হয়। ২ থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত ফুলটিকে রেখে অবশিষ্ট অংশ লাকড়ি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পরে ১৫/২০টি ফুলকে একত্রিত করে প¬াস্টিকের ফিতা দিয়ে মুড়িয়ে ঝাড়ু তৈরী করা হয়। অবসর সময়ে কাজ করে তিনি প্রতিদিন ৮/১০টি ঝাড়– তৈরী করেন। এভাবে মৌসুমে হাজার থেকে দেড় হাজার ঝাড়– তৈরী করেন তিনি।

মনর উদ্দীন আরও জানান, ৭/৮ বছর যাবৎ তিনি এই কাজ করে আসছেন। এতে করে তার অবসর সময়টা কাজে লাগছে। পাশাপাশি সংসারের অভাব দূর হয়েছে। ৬ মেয়ে ও ১ ছেলে সন্তানের জনক মনর উদ্দিন এই বিশাল পরিবারের ব্যয় নির্বাহে ঝাড়– বিক্রির টাকা গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি জানান, প্রতিটি ঝাড়– তৈরি করতে তাদের ৫/৬ টাকা খরচ হয়। সেই ঝাড়– পাইকারী মুল্যে বিক্রি হয় ৭০ টাকা করে। এতে তাদের শ্রম কাজে লাগছে।

পাহাড়ের আরেক বাসিন্দা আবুল কাসেম জানান, ঝাড়– তৈরির ফুল কিনতেও পাওয়া যায়। শ্রমিকরা কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে এই ফুল কেটে নিয়ে আসেন। এক এক আটি ফুল বিক্রি হয় ৩০/৪০ টাকায়। যারা ফুল কিনে এবং শ্রমিক ব্যবহার করে ঝাড়– তৈরি করেন তাদের প্রতি ঝাড়–তে খরচ পড়ে ৩০/৩৫ টাকা।

রূপসী বস্তির বাসিন্দা মিজানুর রহমানও প্রতি মৌসুমে তৈরী করেন হাজারের উপর ঝাড়–। তিনি জানান, ঝাড়– বিক্রির বাড়তি আয় থেকে তার পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছে। 

মুছাই পাহাড়সহ হবিগঞ্জ জেলার পাহাড়ী এলাকার যে সকল স্থানে এখনও আবাদ হয়নি সেখানেই এই ফুল বেশী উৎপাদন হয়। বাগানের গাছের ফাঁকে ফাঁকেও এই ফুল হয়। সাধারণত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পরিপক্ক ফুল আহরণ করা যায়। যারা ফুলের ঝাড়– তৈরী করেন তারা ওই সময়ে সারা বছরের জন্য ফুল সংগ্রহ করে রাখেন। পরে অবসর সময়ে ঝাড়– তৈরী করেন। পাহাড় ও আশেপাশের এলাকার লোকজন নিজেদের ব্যবহারের জন্যও এই ঝাড়– তৈরি করেন।

এক সময়ে অবহেলায় বেড়ে উঠা এই বন্য ফুলের এখন অনেক কদর। এই ফুল অনেকের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। এখানে বাণিজ্যিকভাবে এই ফুল আবাদ ও ঝাড়– তৈরির শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন পাহাড়ের অধিবাসীরা। 

Sunday, March 23, 2014

জাহাজ নির্মাণেই একদিন বিশ্ব জয় করবে বাংলাদেশ

চট্টগ্রাম: নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প। সরকার এ শিল্পের প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এ অবস্থায় পুঁজি বিনিয়োগকারীরা এ খাতে আরো মনোযোগী হলে আগামীতে এ শিল্পকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন বিপ্লবের সূচনা ঘটবে। পরিবেশ দূষণের দায় এবং ‘জাহাজ ভাঙা শিল্পের বাংলাদেশ’ অপবাদ ঘুচিয়ে পৃথিবীর বড় বড় অভিজাত ‘জাহাজ নির্মাণ’ করেই একদিন বিশ্ব জয় করবে বাংলাদেশ। এমনই আশা করছেন এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। 

পাল তোলা কাঠের জাহাজ যখন সাত সমুদ্র পাড়ি দিত সে যুগে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছিল জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিশাল অবকাঠামো। চট্টগ্রামে নির্মিত বাণিজ্যতরী ও রণতরীর কদর ছিল বিশ্বব্যাপী। রফতানি হতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। প্রায় একশ’ বছর পর বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ঐতিহ্য আবার ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয়, জাহাজ নির্মাণে এ মুহূর্তের বিশ্ববাজারের বিশাল চাহিদা কাজে লাগানো সম্ভব হলে এ খাতটি দেশের বিদ্যমান সকল রফতানি খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রথম স্থানে উন্নীত হবে অচিরেই। 

উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)-এর নীতিমালায় ২৫ বছরের বেশি পুরনো জাহাজ সমুদ্রে চলাচল না করার বিধান করা হয়েছে। আইএমও’র এ নির্দেশনার কারণে কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোতেই ২৫ বছর বা তার বেশি বয়েসী প্রায় ৩ হাজার জাহাজের নিবন্ধন বাতিল হচ্ছে। এর স্থলে সমসংখ্যক নতুন জাহাজ যোগ করতে হবে। 

জানা গেছে, বিশ্বে প্রতি বছর সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বাড়ছে ৩ শতাংশ হারে। সে হিসেবে বিশ্বের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক অবস্থায়ও চাহিদা মাফিক জাহাজ নির্মাণে সমর্থ নয়। সেখানে হঠাৎ করে এ বিশাল সংখ্যক জাহাজ নির্মাণ কীভাবে হবে তা নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন সামুদ্রিক জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ বিরাট সংকটই বাংলাদেশি জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। 

এ সংকটের কারণেই বিশ্ববাজারে এ মুহূর্তে প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলারের জাহাজ নির্মাণের অর্ডার রয়েছে। এর মাত্র শতকরা দুই ভাগ কাজও যদি বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পায়, তাহলেও প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের (৬০,০০০ কোটি টাকা) বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ। 

ইতোমধ্যে দেশিয় প্রযুক্তি ও লোকবল ব্যবহার করে দেশের শিপবিল্ডার্সগুলো যাত্রীবাহী জাহাজ, ড্রেজার, অয়েল ট্যাংকার, টাগবোট, ফিশিং বোটসহ নানা ধরনের যান্ত্রিক নৌযান নির্মাণে সফলতা দেখিয়েছে। এ সুবাদে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সুনাম এখন ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্যতম জাহাজ নির্মাণকারী দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ভারতের সবগুলো শিপইয়ার্ড বছর দেড়েক আগে থেকেই ৫ বছরের জন্য অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাই ক্রেতারা জাহাজ কেনার জন্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বিকল্প দেশ খুঁজছে। এই সুযোগটা বাংলাদেশি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছে।

এদিকে জাহাজ নির্মাতারা সরকারি উদ্যোগে জাহাজ নির্মাণ শিল্প জোন স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পখাতে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে ১৫টি শিপইয়ার্ড নিয়ে জাহাজ নির্মাণ জোন গড়ে তোলা সম্ভব। দেশিয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টি সার্টিফিকেট পশ্চিমা দেশগুলো গ্রহণ করতে চায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য ব্যাংক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করে এবং ঋণের সুদ কিছুটা কম করা হয় তাহলে জাহাজ নির্মাণ ব্যয় অনেকটা কমে যাবে। 

বাংলাদেশে এখন ছোট-বড় শতাধিক জাহাজ নির্মাণ কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মাত্র ৭টি প্রতিষ্ঠান রফতানিযোগ্য জাহাজ নির্মাণ করছে। এরমধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড, ফিসার শিপইয়ার্ড, মেঘনা ঘাটের আনন্দ শিপইয়ার্ড, খান ব্রাদার্স শিপইয়ার্ড, নারায়ণগঞ্জের এনইএসএল শিপইয়ার্ড ও দেশ শিপইয়ার্ড। 

কর্ণফুলীর তীরে গড়ে ওঠা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ইতোমধ্যে জার্মানি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও পাকিস্তানে সমুদ্রগামী জাহাজ রফতানি করে সুনাম কুড়িয়েছে। রফতানির জন্য আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ নির্মাণের অর্ডার পেয়েছে। এ পর্যন্ত ছোটবড় প্রচুর জাহাজ নির্মাণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি । 

আনন্দ শিপইয়ার্ডকে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পের পথিকৃৎ বলা হয়। ১৯৯২ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড দেশে সর্বপ্রথম বিশ্বমানের (ক্লাস শিপ) জাহাজ নির্মাণ করে। এরপর ২০০৬ সালে মালদ্বীপে দুটি কার্গো জাহাজ রফতানির মাধ্যমে জাহাজ রফতানি বাণিজ্যে প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এই শিপইয়ার্ড ও পর্যন্ত ৩শ’টিরও বেশি জাহাজ তৈরি করেছে। রফতানি করেছে প্রায় এক ডজন জাহাজ। আরো কয়েকটি জাহাজ রফতানির তালিকায় রয়েছে। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ে জাহাজ নির্মাণ শুরু করে কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড। এ পর্যন্ত প্রায় ৮০টি জাহাজ তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাহাজ নির্মাণ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি। তাদের অনেকে জানেন না তাদের নিজ দেশে অনেক জাহাজ নির্মাণ কারখানা গড়ে ওঠেছে। এমনই একজন সিঙ্গাপুরের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসা বাংলাদেশি কর্মী আবদুল করিম। ভাবতেই পারেননি দেশেই তিনি একই ধরনের কাজ পাবেন।

৩৫ বছর বয়েসী আবদুল করিম বছর দুয়েক আগে দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ণ মেরিন-এ যোগ দেন। এখানে বর্তমানে প্রতি ১২ জনে একজন কর্মী রয়েছেন, যারা একসময় বিদেশি কোন শিপইয়ার্ডে কাজ করতেন। করিম জানালেন, ‘সিঙ্গাপুরের চেয়ে এখানে আমার বেতন প্রায় অর্ধেক। কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলাদেশে আমি ভালো আছি এবং আমি আমার পরিবারের কাছে থাকতে পারছি।

বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে শত শত কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চল। বিস্তীর্ণ সমুদ্র তীর, নদী তীর। আগামীদিনে এ অব্যবহৃত উপকূল জুড়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠলে এ সম্ভাবনাময় খাতকে ঘিরেই হয়ত একদিন এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

Sunday, March 16, 2014

মাদারীপুরে মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে

মাদারীপুর: মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ও সদর উপজেলার মস্তফাপুর পালপাড়ায় তৈরি প্রাচীনতম ঐতিহ্য মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না মৃৎশিল্পের নকশা করা নানান রকম বাহারী সামগ্রী। মৃৎশিল্পীরা কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছেন পূর্ব পুরুষের এই ঐতিহ্য।

জানা গেছে, রাজৈর উপজেলার খালিয়া এলাকা এক সময় মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। ৭ পুরুষ আগে তারা এসেছিলেন যশোর থেকে। যশোরের হরিচরণ পাল আর গুরুচরণ পাল দু’জনে আড়িয়াল খাঁ নদে’র তীরবর্তী এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে শুরু করেছিলেন এই পেশা। কালের পরিক্রমায় মৃৎশিল্পের কদর কমে গেলেও এই কুমারপাড়ার কয়েকটি পরিবার নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। তারা কারুকার্য খচিত মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল, কলসি, কড়াই, সরা, মটকা, পেয়ালা, বাসন-কোসন, মাটির ব্যাংকসহ নিত্য প্রয়োজনীয় নানা রকমারী তৈজসপত্র তৈরি করছেন। 

স্থানীয়ভাবে মাটির সামগ্রী তৈরিকারী মৃৎশিল্পীদের বলা হয় কুমার। এককালে বিভিন্ন অঞ্চলে এ কুমার সম্প্রদায়দের নিয়ে গড়ে উঠেছিল কুমারপাড়া। কালের আবর্তনে কুমারপাড়া বিলীন হতে চলেছে। এখন টিকে থাকা দু-একজন কুমারও বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। মাটির সামগ্রীর চেয়ে টেকসই সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে মৃৎশিল্পের চাহিদা নেই। তাই অনেকে ঐতিহ্যগত পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। 

জানা গেছে, যারা এখনো পৈত্রিক পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছেন তারা অতিকষ্টে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এসব দরিদ্র কুমার পরিবারগুলোর আর্থিক সংগতি না থাকায় তারা অধিক মাটি কিনে বেশি পরিমাণে জিনিস উৎপাদন করতে পারেন না। ফলে তারা খুব বেশি লাভবান হতে পারছেন না। এতে অর্থনৈতিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

খালিয়া এলাকার যতিন পাল জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা সবাই এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এটা তাদের জাত ব্যবসা হলেও এখন অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা ধরেছেন। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় এঁটেল মাটি এখন টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়। তাছাড়া মাটির তৈরি সামগ্রী পোড়ানোর জন্য জ্বালানির খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী এখন শুধু মাটির তৈরি ফুলের টব, কলকি ও দইয়ের পাত্র তৈরি হচ্ছে। তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে সারাদিনের পরিশ্রম এবং কষ্টের টাকাও আসছে না। তিনি আরো জানান, চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষের মেলায় তাদের সারা বছরের তুলনায় বিক্রি বেশি হয়। 

মৃৎশিল্পীরা জানান, প্রযুক্তিতে তৈরি সহজলভ্য প¬াস্টিক জাতীয় পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে মাটির তৈরি পণ্য বাজারে আর চলছে না। ব্যবহারে সহজ প¬াস্টিক ও এলুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি তৈজসপত্র ছাড়া মানুষ আগের যুগের মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন ব্যবহার করছে না মোটেও।

প্রবীণ কারিগর গুরুদাস পাল বলেন, আমাদের এই বর্তমান পুরুষের পরে হয়তো আর কেউ এই পেশায় থাকবে না। এক যুগ আগেও এই কুমার পাড়ায় শতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। মৃৎশিল্প হারিয়ে যাওয়ার ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলোতে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে। 

এক সময়ের অতি প্রয়োজনীয় মাটির বাসন-কোসন এখন আর গেরস্তের ঘরে খুঁজে পাওয়া যায় না। কালের বিবর্তনে এখন গ্রামাঞ্চলেও চলে এসেছে আধুনিক সব তৈজসপত্র। ফলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সানকি পাতিলের দেখা এখন মেলে না। কিছু হিন্দু পাল সম্প্রদায় এখনও তাদের বংশগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কায়িক শ্রমের বিনিময়ে তারা যা পান তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কোনভাবে সংসার টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অুনষ্ঠানসহ অর্থনৈতিকভাবে মোটেই স্বচ্ছল নয়। ফলে পৈত্রিক পেশায় নিয়োজিত কুমাররা চরম বিপাকে পড়েছেন। তাই তারা সরকারের কাছে ক্ষুদ্র এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে স্বল্প সুদে এবং সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার দাবি জানান।

জানা গেছে, এ পেশার জিনিস তৈরির একমাত্র উপকরণ এঁটেল মাটির এখন বড়ই অভাব। ইটের ভাটার জন্য মাটি বিক্রি হওয়ায় এখন আর বিনামূল্যে মাটি পাওয়া যায় না। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মৃৎশিল্পীদের টিকিয়ে রাখার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশি¬ষ্টরা।

মাদারীপুরে মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে

মাদারীপুর: মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ও সদর উপজেলার মস্তফাপুর পালপাড়ায় তৈরি প্রাচীনতম ঐতিহ্য মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না মৃৎশিল্পের নকশা করা নানান রকম বাহারী সামগ্রী। মৃৎশিল্পীরা কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছেন পূর্ব পুরুষের এই ঐতিহ্য।

জানা গেছে, রাজৈর উপজেলার খালিয়া এলাকা এক সময় মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। ৭ পুরুষ আগে তারা এসেছিলেন যশোর থেকে। যশোরের হরিচরণ পাল আর গুরুচরণ পাল দু’জনে আড়িয়াল খাঁ নদে’র তীরবর্তী এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে শুরু করেছিলেন এই পেশা। কালের পরিক্রমায় মৃৎশিল্পের কদর কমে গেলেও এই কুমারপাড়ার কয়েকটি পরিবার নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। তারা কারুকার্য খচিত মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল, কলসি, কড়াই, সরা, মটকা, পেয়ালা, বাসন-কোসন, মাটির ব্যাংকসহ নিত্য প্রয়োজনীয় নানা রকমারী তৈজসপত্র তৈরি করছেন। 

স্থানীয়ভাবে মাটির সামগ্রী তৈরিকারী মৃৎশিল্পীদের বলা হয় কুমার। এককালে বিভিন্ন অঞ্চলে এ কুমার সম্প্রদায়দের নিয়ে গড়ে উঠেছিল কুমারপাড়া। কালের আবর্তনে কুমারপাড়া বিলীন হতে চলেছে। এখন টিকে থাকা দু-একজন কুমারও বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। মাটির সামগ্রীর চেয়ে টেকসই সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে মৃৎশিল্পের চাহিদা নেই। তাই অনেকে ঐতিহ্যগত পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। 

জানা গেছে, যারা এখনো পৈত্রিক পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছেন তারা অতিকষ্টে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এসব দরিদ্র কুমার পরিবারগুলোর আর্থিক সংগতি না থাকায় তারা অধিক মাটি কিনে বেশি পরিমাণে জিনিস উৎপাদন করতে পারেন না। ফলে তারা খুব বেশি লাভবান হতে পারছেন না। এতে অর্থনৈতিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

খালিয়া এলাকার যতিন পাল জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা সবাই এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এটা তাদের জাত ব্যবসা হলেও এখন অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা ধরেছেন। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় এঁটেল মাটি এখন টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়। তাছাড়া মাটির তৈরি সামগ্রী পোড়ানোর জন্য জ্বালানির খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী এখন শুধু মাটির তৈরি ফুলের টব, কলকি ও দইয়ের পাত্র তৈরি হচ্ছে। তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে সারাদিনের পরিশ্রম এবং কষ্টের টাকাও আসছে না। তিনি আরো জানান, চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষের মেলায় তাদের সারা বছরের তুলনায় বিক্রি বেশি হয়। 

মৃৎশিল্পীরা জানান, প্রযুক্তিতে তৈরি সহজলভ্য প¬াস্টিক জাতীয় পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে মাটির তৈরি পণ্য বাজারে আর চলছে না। ব্যবহারে সহজ প¬াস্টিক ও এলুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি তৈজসপত্র ছাড়া মানুষ আগের যুগের মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন ব্যবহার করছে না মোটেও।

প্রবীণ কারিগর গুরুদাস পাল বলেন, আমাদের এই বর্তমান পুরুষের পরে হয়তো আর কেউ এই পেশায় থাকবে না। এক যুগ আগেও এই কুমার পাড়ায় শতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। মৃৎশিল্প হারিয়ে যাওয়ার ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলোতে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে। 

এক সময়ের অতি প্রয়োজনীয় মাটির বাসন-কোসন এখন আর গেরস্তের ঘরে খুঁজে পাওয়া যায় না। কালের বিবর্তনে এখন গ্রামাঞ্চলেও চলে এসেছে আধুনিক সব তৈজসপত্র। ফলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সানকি পাতিলের দেখা এখন মেলে না। কিছু হিন্দু পাল সম্প্রদায় এখনও তাদের বংশগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কায়িক শ্রমের বিনিময়ে তারা যা পান তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কোনভাবে সংসার টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অুনষ্ঠানসহ অর্থনৈতিকভাবে মোটেই স্বচ্ছল নয়। ফলে পৈত্রিক পেশায় নিয়োজিত কুমাররা চরম বিপাকে পড়েছেন। তাই তারা সরকারের কাছে ক্ষুদ্র এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে স্বল্প সুদে এবং সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার দাবি জানান।

জানা গেছে, এ পেশার জিনিস তৈরির একমাত্র উপকরণ এঁটেল মাটির এখন বড়ই অভাব। ইটের ভাটার জন্য মাটি বিক্রি হওয়ায় এখন আর বিনামূল্যে মাটি পাওয়া যায় না। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মৃৎশিল্পীদের টিকিয়ে রাখার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশি¬ষ্টরা।

Wednesday, March 12, 2014

পিরোজপুরে টমেটো চাষ করে হুমায়ুন স্বাবলম্বী

পিরোজপুর: পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার গাজীপুর গ্রামের কৃষক হুমায়ুন টমেটো চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিন মাসে তিনি উপার্জন করেছেন আড়াই লাখ টাকা। আর এ টমেটো চাষে তিনি ব্যবহার করেছেন জৈব সার। পোকা মাকড় দমনে বিষ প্রয়োগ না করে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। দীর্ঘ দশ বছর ধরে কৃষি কাজ করে তার স্বচ্ছলতা না এলেও চলতি মৌসুমে শীতকালীন টমেটো চাষ করে তার আর্থিক দৈন্যতা ঘুচেছে।

হুমায়ুন কবীর জানিয়েছেন, ভান্ডারিয়ার গাজীপুর গ্রামের এক কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। ২০০২ সালে এসএসসি পাশ করে অভাব অনটনের সংসারে উপার্জনের জন্য কৃষি কাজ শুরু করতে হয় তাকে। আমন ও আউশ ধান চাষের পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে বাড়ির আশপাশে বিভিন্ন ধরণের শীত ও গ্রীষ্মকালীর শাক সবজীর চাষাবাদ করে সংসার চললেও অর্থ জমানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বরং ধার-দেনা করে তাকে চলতে হয়েছে। কিন্তু এবার টমেটো চাষ করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন ভান্ডারিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলামের সহযোগিতায়। কারণ তার পরামর্শে এ বছর শীত মৌসুমে টমেটোর চাষ শুরু করেন হুমায়ুন। 

মাত্র দু’একর জমিতে সর্বমোট ৪৮ হাজার টাকা খরচ হয় টমেটো চাষে। এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার টমেটো বিক্রি হয়েছে। আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার টমেটো ক্ষেতে রয়েছে তার। মৌসুমের শুরুতে প্রতিটন ৩০ হাজার টাকা করে বিক্রি হলেও পর্যায়ক্রমে দাম কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার টাকায়। 

ভান্ডারিয়া বাজারের কাঁচা মালের পাইকারী ব্যবসায়ী মোঃ হায়দার আলী জানান, হুমায়ুন টমেটো চাষে কীটনাশক ব্যবহার করেননি এবং আমরাও এই টমেটো পাকাতে কোন রাসায়নিক প্রয়োগ করিনি বিধায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তথা ক্রেতা সাধারণের কাছে এই টমেটোর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। হুমায়ুনের সাফল্য দেখে অনেক বেকার যুবক বিভিন্ন ধরণের চাষাবাদে ঝুঁকছে। 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম জানান, কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে টমেটো চাষ করে হুমায়ুন আজ স্বাবলম্বী। আমাদের পরামর্শ নিয়ে সঠিকভাবে ধান, গম, শাক-সবজী, ফল-ফলাদীর চাষাবাদ করলে লাভবান হওয়া সম্ভব। কারণ বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি।