রাজশাহী: আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সুমিষ্ট আমের রাজধানী বলে খ্যাত রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগানগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে মুকুল এসেছে। এবার আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন আম বাগানের মালিকেরা।
মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে এখন মুখরিত জেলার আমবাগানগুলো। আমচাষীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বাগান পরিচর্যার কাজে। সব কিছু অনুকূলে থাকলে এই দুই জেলায় এবার প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
রাস্তার দু’ধারে সারি সারি আমগাছ ও বাহারি নানা জাতের আমের কথা এলেই চলে আসে সীমান্তবর্তী জেলা দু’টির নাম। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আম চাষে জমির পরিমাণ। এক সময়ের রুক্ষ লাল মাটির বরেন্দ্র অঞ্চলেও আম চাষে ঘটেছে নীরব বিপ্লব।
গত কয়েক বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু-নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আম বাগান। তাই চলতি মৌসুমে এই দুটি জেলায় আম বাগানের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮১৬ হেক্টরে। এ বছর আম গাছের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। অথচ গত আম মৌসুমে আম বাগানের জমির পরিমাণ ছিল এর চেয়ে কিছুটা কম।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আড়াইশ’ জাতের আম চাষ হয় এই দুই জেলায়। এর মধ্যে সুস্বাদু ও দেখতে বাহারি ও স্বাদে ভালো ক্ষিরসাপাত, ল্যাংড়া, বোম্বাই, গোপালভোগ, হিমসাগর, ফজলী, আম্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি খিরসা, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, মোহন ভোগ জাতের আমই চাষ হচ্ছে বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল আমিন জানান, সাধারণত এক বছর আম উৎপাদন ভাল হলে পরের বছর ভালো হয় না। তাই আম ভালো হওয়ার বছরকে অন ইয়ার ও পরের বছরকে আম উৎপাদনের অফ-ইয়ার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে অভিহিত করে আসছিলো কৃষি বিভাগ। সেই হিসেবে এবার আম উৎপাদনের অন ইয়ার।
তিনি বলেন, তাপমাত্রা স্বাভাবিক ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাগানগুলোতে ধারণার থেকেও অনেক বেশি মুকুল এসেছে।
গত কয়েকদিনে, জেলার চারঘাট, বাঘা, পবা এবং দুর্গাপুর উপজেলার বেশ কিছু এলাকা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুর, কালীনগর, বালিয়াডাঙ্গা, মহিপুর, গোবরাতলা ও শিবগঞ্জ উপজেলার রানীহটি, কানসাট, কালুপুর এলাকা ঘুরে সিংহভাগ গাছে ব্যাপক মুকুল আসার দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে।
কৃষকরা এখন ব্যস্ত বাগান পরিচর্যার কাজে। বিভিন্ন রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ থেকে বাগান রক্ষা করতে তারা গাছে গাছে ¯েপ্র করছেন ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক।
চারঘাট উপজেলার নন্দনগাছি গ্রামের আমচাষী রেজাউল করিম জানান, এবার প্রতিটি বাগানে অপ্রত্যাশিত পরিমাণে মুকুল এসেছে। যে পরিমাণে মুকুল এসেছে তা থেকে ভালো উৎপাদন পেতে চাষীরা এখন বাগান পরিচর্যার কাজ করছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার হুজরাপুর এলাকার আমচাষী সাইদুর রহমানও বললেন একই কথা। তিনি আশা করছেন এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ভালো ফলন হবে।
আম বাগানগুলোয় ব্যাপক মুকুল আসার বিষয়টি স্বীকার করে তা রোগ বালাই থেকে রক্ষা করতে কৃষকদের সঠিক সময়ে সহনীয় মাত্রায় ছত্রাকনাশক স্প্রে ও সেচ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, কৃষকরা একটু সচেতন হয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সহনীয় মাত্রায় ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক ব্যবহার করলে আম উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। তবে তিনি বলেন, গাছে মুকুল আসার আগেই যেমন ¯েপ্র করার প্রয়োজন নেই তেমনি মুকুল ফোটা অবস্থায় কোনোভাবেই স্প্রে করা ঠিক নয়। কারণ এ সময় প্রচুর পরিমাণ উপকারী পোকা আমবাগানে আসে এবং পরাগায়নে সহযোগীতা করে। তাই সঠিকভাবে দুইবার ¯েপ্র দিতে পারলে প্রচুর পরিমাণ আম টিকে থাকবে।
তাছাড়াও গাছে সময়মত সার, পানি সেচ, পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমন এবং অন্য যত্ন পরিচর্যার মাধ্যমে আমের ফলন বাড়ানো সম্ভব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেয়ার জন্য আমচাষীদের অনুরোধ করেছেন।
অন্যদিকে স্থানীয় ফল গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দীন জানান, সঠিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। তিনি বলেন, আমচাষের বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলগুলো চাষীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে দলীয় সভা, উঠোন বেঠক ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, চলতি আম মৌসুমের শুরু থেকে আবহাওয়া পুরোপুরি অনুকূলে থাকায় এবার এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ গাছ মুকুলিত হয়েছে। আগামী ১০/১২ দিনের মধ্যে আরো ১৫ শতাংশ গাছ মুকুলিত হবে বলে তিনি আশা করছেন। সব কিছু ঠিক থাকলে এবার এই দুই জেলায় ৩ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হবে- এমন ধারণা করছেন তিনি।