Monday, April 7, 2014

ভাসমান ধাপে চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষ

যশোর: যশোরের কেশবপুর উপজেলা ও তার সংলগ্ন কপোতাক্ষ পাড়ের অসহায় মানুষ সবজি চাষ করে আর্থিকভাবে পরিবর্তন এনেছেন। তারা পানির উপর ভাসমান ধাপে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সবজি বিক্রি করেই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনতে সক্ষম হয়েছেন। 

ধাপ চাষে সাফল্য দেখে আরো শত শত কৃষক এখন একাজে উৎসাহিত হচ্ছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ব বৃহৎ এলাকা জুড়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদ পলিতে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ফলে স্রোতহীন হয়ে পড়া ও পানির ধারণ ক্ষমতা না থাকায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পানি উপচে কপোতাক্ষ অববাহিকা অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। ঘর-বাড়ি, ফসলের মাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ডুবে যায়। বন্যার সময় মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে টং ঘর বেঁধে আশ্রয় নেয়। বছরের বেশ কয়েকটি মাস তারা এভাবে টং ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। 

১০/১১ বছর ধরে এ ভাবে বন্যা প্লাবিত হওয়ায় ফসল উৎপাদন করতে না পেরে কপোতাক্ষ অববাহিকা অঞ্চলের অনেক কৃষক অসহায় হয়ে পড়েছে। এ সমস্ত অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি করতে এগিয়ে এসেছে এলাকার কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। যাদের পরামর্শে দরিদ্র মানুষেরা ৫ থেকে ১০ জনের এক একটি গ্রুপ করে কপোতাক্ষ নদে ভাসমান প্রাকৃতিক সম্পদ কচুরীপানা তুলে পচন দেন। এক সপ্তাহ পর তারা পচনকৃত কচুরীপানা দিয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট প্রস্থে ও ৩৫ থেকে ৪০ ফুট দৈর্ঘের ধাপ তৈরি করে। এভাবে ৫০ থেকে ৬০টি ধাপ পর পর সাজিয়ে কপোতাক্ষের পানিতে ভাসিয়ে রাখা হয়। তার পর ওই পচনকৃত কচুরীপানা দিয়ে গোলাকৃতির ট্যামা তৈরী করে ধাপের উপর বসিয়ে দেয়া হয়। 
এরপর ট্যামার মধ্যে লাল শাক, ঢেঁড়স, পালং শাক, মুলা, টমেটো, সীম, মিষ্টি কুমড়া, করলা, আলু, লাউয়ের বীজ বপন  এবং বেগুন, মরিচ, ওলকপি ও ফুলকপির চারা রোপন করা হয়। শাক সবজি বড় হলে কৃষকেরা তা তুলে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। অনেক সময় তারা কপোতাক্ষ পাড় সংলগ্ন হাট বাজারের কাছে ধাপ ভাসিয়ে নিয়ে যেয়েও এসব শাক সবজি বিক্রি করে থাকেন। ক্রেতারাও কপোতাক্ষ পাড়ে যেয়ে ধাপ চাষীদের কাছে থেকে টাটকা শাক সবজি কিনে নেন। 

কৃষকরা জানান, প্রতি মৌসুমে সবজি বিক্রি করে খরচ বাদে এক একজন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। ভাসমান ধাপে উৎপাদিত সবজি চাষের আয় থেকে এসব দরিদ্র মানুষ বন্যা ক্ষতি পুষিয়ে এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা স্বাবলম্বি হয়ে উঠছেন। একটি ভাসমান ধাপ তৈরী করতে খরচ হয় ২৫০ থেকে ২৭৫ টাকা। 

বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সমাধান, সুশীলন ও আইডিও কেশবপুর, তালা ও কলারোয়া উপজেলার কপোতাক্ষ নদ সংলগ্ন গ্রামগুলির বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অসহায় ও দরিদ্র হয়ে পড়েছে এমন মানুষদের পরামর্শ ও ঋণ দিয়ে কপোতাক্ষ নদের পানিতে ভাসমান ধাপ চাষে আগ্রহী করে তোলে। কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষ এ সব সংস্থার পরামর্শ ও ঋণ নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাসমান ধাপ চাষ শুরু করেছেন। 

কেশবপুর, মনিরামপুর, তালা ও কলারোয়া উপজেলার অংশে কপোতাক্ষ নদের যেখানে পানি রয়েছে সেখানেই ধাপ চাষ হচ্ছে। বর্তমানে ৫ থেকে ৬ হাজার ধাপ কপোতাক্ষ নদের পানিতে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। আর এ ধাপ চাষের সাথে জড়িত রয়েছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। 

ধাপ চাষের সাথে জড়িত কেশবপুর উপজেলার চাঁদড়া গ্রামের কৃষক মুনছুর আলি জানান, তারা প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানিতে বন্যা প্ল¬াবিত হয়ে ফসল হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সমাধানের পরামর্শ ও ঋণ নিয়ে কপোতাক্ষের বদ্ধ পানিতে ভাসমান ধাপ চাষ করে তিনি এখন অনেকটা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হয়েছেন। ‘সমাধান’ থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন তাও পরিশোধ করেছেন। তিনি এখন ধাপ চাষের পাশাপাশি ধাপ তৈরী করে অন্যের কাছেও বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। 

আরেক বেসরকারী উন্নয়ণ সংস্থা সুশীলন থেকে ঋণ গ্রহণকারী মুস্তাইন বিল্ল¬াহ একজন সফল ধাপ চাষী। তিনি জানান, সুশীলন থেকে ঋণ নিয়ে ধাপ চাষ করে অনেক টাকা লাভ করেছেন। এ বছর তিনি নিজেই ৪০টি ধাপ তৈরী করে সবজি চাষের মাধ্যমে খরচ বাদে ৪৭ হাজার টাকা আয় করেছন। তার ধাপে যে সবজি রয়েছে তা থেকে তিনি আরো ২০ হাজার  টাকা আয় করতে পারবেন বলে জানান। 

উন্নয়ন সংস্থা সমাধানের পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় ৬৫০ জনকে পরামর্শ ও ঋণ দিয়ে ধাপ চাষে সহায়তা করা হয়। ধাপ চাষের আয় থেকে তারা সংস্থার সব ঋণও পরিশোধ করেছেন । 

কেশবপুর উপজেলা কৃষি কর্ম পাশাপাশি কপোতাক্ষ নদে ভাসমান ধাপ চাষ করে বাড়তি আয় করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে কর্তা সঞ্জয় কুমার দাস জানান, ধাপ চাষ লাভজনক। কপোতাক্ষ অঞ্চলের মানুষ কৃষি জমিতে চাষাবাদের খরচও কম লাগে। ধাপ চাষের শাক সবজি টাটকা ও সুস্বাদু। 

No comments:

Post a Comment