হবিগঞ্জ : পাকা মেঝে আর টাইলস লাগানো বাসা পরিস্কার করতে গৃহিনীদের অন্যতম পছন্দ ফুলের ঝাড়–। বেশির ভাগ বাসা বাড়িতেই দেখা যায় এই ঝাড়–র ব্যবহার। বিদেশেও যাচ্ছে এই ঝাড়–। আর এই ঝাড়– তৈরীর প্রধান উপকরণ ফুলের অন্যতম উৎসস্থল হল হবিগঞ্জের পাহাড়ী এলাকা। এখানকার দরিদ্র লোকজন ফুলের ঝাড়– তৈরী করে স্বচ্ছলতা পেয়েছেন।
হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকায় প্রাকৃতিকভাইে বেড়ে উঠে বাঁশ, ছন, লতাপাতাসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ। এর মাঝেই এক ধরনের ফুল থেকে তৈরী হয়ে থাকে ঝাড়–। এই ফুলকে স্থানীয়ভাবে রেমা বলা হয়। বন্য এই ফুলের ঝাড়– এখন পাহাড়ে বসবাসরত দরিদ্র লোকজনের আয়ের অন্যতম উৎস।
হবিগঞ্জের বাহুবল, চুনারুঘাট, মাধবপুর ও নবীগঞ্জের কিছু এলাকা পাহাড় সমৃদ্ধ। এই সমস্ত পাহাড়ে উৎপাদিত ফুল থেকে প্রতিবছর ৪/৫ লাখ পিস ফুলের ঝাড়– তৈরী হয়। যার বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। শত শত পরিবার এই ঝাড়– তৈরী এবং বিক্রি করে পরিবারের আয় বাড়াচ্ছেন।
হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার সীমান্ত এলাকায় মুচাই পাহাড় নামে একটি পাহাড় রয়েছে। বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ অনেক বাঙালি পরিবার। সেখানে বসবাসরত মানুষের জীবন-জীবিকা পাহাড়ের ওপরই নির্ভরশীল।
আলিয়াছড়া পাহাড়ের রূপসী বস্তি বা আলিয়াছড়া বস্তিতে যাদের বসবাস তাদের অনেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছেন। মূলত বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। পাহাড়ের উপর ছোট ছোট কুটিরে তাদের বসবাস। বাগানে কাজ করার পর তাদের হাতে যে সময় থাকে সেই সময়ে বাড়ির আঙ্গিনায় অনেকেই ফুলের ঝাড়– তৈরী করেন। পরে তা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল শহরে পাইকারী মূল্যে বিক্রি করেন। অনেক সময় পাইকাররাও এসে এই ঝাড়– কিনে নিয়ে যায়।
রূপসী বস্তির বাসিন্দা মনর উদ্দিন জানান, পাহাড়ে কাজ শেষে ফেরার সময় জঙ্গল থেকে কান্ডসহ ফুল সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে রোদে শুকানোর পর তা সাইজ করা হয়। ২ থেকে আড়াই ফুট পর্যন্ত ফুলটিকে রেখে অবশিষ্ট অংশ লাকড়ি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পরে ১৫/২০টি ফুলকে একত্রিত করে প¬াস্টিকের ফিতা দিয়ে মুড়িয়ে ঝাড়ু তৈরী করা হয়। অবসর সময়ে কাজ করে তিনি প্রতিদিন ৮/১০টি ঝাড়– তৈরী করেন। এভাবে মৌসুমে হাজার থেকে দেড় হাজার ঝাড়– তৈরী করেন তিনি।
মনর উদ্দীন আরও জানান, ৭/৮ বছর যাবৎ তিনি এই কাজ করে আসছেন। এতে করে তার অবসর সময়টা কাজে লাগছে। পাশাপাশি সংসারের অভাব দূর হয়েছে। ৬ মেয়ে ও ১ ছেলে সন্তানের জনক মনর উদ্দিন এই বিশাল পরিবারের ব্যয় নির্বাহে ঝাড়– বিক্রির টাকা গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি জানান, প্রতিটি ঝাড়– তৈরি করতে তাদের ৫/৬ টাকা খরচ হয়। সেই ঝাড়– পাইকারী মুল্যে বিক্রি হয় ৭০ টাকা করে। এতে তাদের শ্রম কাজে লাগছে।
পাহাড়ের আরেক বাসিন্দা আবুল কাসেম জানান, ঝাড়– তৈরির ফুল কিনতেও পাওয়া যায়। শ্রমিকরা কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে এই ফুল কেটে নিয়ে আসেন। এক এক আটি ফুল বিক্রি হয় ৩০/৪০ টাকায়। যারা ফুল কিনে এবং শ্রমিক ব্যবহার করে ঝাড়– তৈরি করেন তাদের প্রতি ঝাড়–তে খরচ পড়ে ৩০/৩৫ টাকা।
রূপসী বস্তির বাসিন্দা মিজানুর রহমানও প্রতি মৌসুমে তৈরী করেন হাজারের উপর ঝাড়–। তিনি জানান, ঝাড়– বিক্রির বাড়তি আয় থেকে তার পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছে।
মুছাই পাহাড়সহ হবিগঞ্জ জেলার পাহাড়ী এলাকার যে সকল স্থানে এখনও আবাদ হয়নি সেখানেই এই ফুল বেশী উৎপাদন হয়। বাগানের গাছের ফাঁকে ফাঁকেও এই ফুল হয়। সাধারণত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পরিপক্ক ফুল আহরণ করা যায়। যারা ফুলের ঝাড়– তৈরী করেন তারা ওই সময়ে সারা বছরের জন্য ফুল সংগ্রহ করে রাখেন। পরে অবসর সময়ে ঝাড়– তৈরী করেন। পাহাড় ও আশেপাশের এলাকার লোকজন নিজেদের ব্যবহারের জন্যও এই ঝাড়– তৈরি করেন।
এক সময়ে অবহেলায় বেড়ে উঠা এই বন্য ফুলের এখন অনেক কদর। এই ফুল অনেকের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। এখানে বাণিজ্যিকভাবে এই ফুল আবাদ ও ঝাড়– তৈরির শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন পাহাড়ের অধিবাসীরা।