মাদারীপুর: মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ও সদর উপজেলার মস্তফাপুর পালপাড়ায় তৈরি প্রাচীনতম ঐতিহ্য মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না মৃৎশিল্পের নকশা করা নানান রকম বাহারী সামগ্রী। মৃৎশিল্পীরা কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছেন পূর্ব পুরুষের এই ঐতিহ্য।
জানা গেছে, রাজৈর উপজেলার খালিয়া এলাকা এক সময় মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। ৭ পুরুষ আগে তারা এসেছিলেন যশোর থেকে। যশোরের হরিচরণ পাল আর গুরুচরণ পাল দু’জনে আড়িয়াল খাঁ নদে’র তীরবর্তী এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে শুরু করেছিলেন এই পেশা। কালের পরিক্রমায় মৃৎশিল্পের কদর কমে গেলেও এই কুমারপাড়ার কয়েকটি পরিবার নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। তারা কারুকার্য খচিত মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল, কলসি, কড়াই, সরা, মটকা, পেয়ালা, বাসন-কোসন, মাটির ব্যাংকসহ নিত্য প্রয়োজনীয় নানা রকমারী তৈজসপত্র তৈরি করছেন।
স্থানীয়ভাবে মাটির সামগ্রী তৈরিকারী মৃৎশিল্পীদের বলা হয় কুমার। এককালে বিভিন্ন অঞ্চলে এ কুমার সম্প্রদায়দের নিয়ে গড়ে উঠেছিল কুমারপাড়া। কালের আবর্তনে কুমারপাড়া বিলীন হতে চলেছে। এখন টিকে থাকা দু-একজন কুমারও বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। মাটির সামগ্রীর চেয়ে টেকসই সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে মৃৎশিল্পের চাহিদা নেই। তাই অনেকে ঐতিহ্যগত পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।
জানা গেছে, যারা এখনো পৈত্রিক পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছেন তারা অতিকষ্টে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এসব দরিদ্র কুমার পরিবারগুলোর আর্থিক সংগতি না থাকায় তারা অধিক মাটি কিনে বেশি পরিমাণে জিনিস উৎপাদন করতে পারেন না। ফলে তারা খুব বেশি লাভবান হতে পারছেন না। এতে অর্থনৈতিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
খালিয়া এলাকার যতিন পাল জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা সবাই এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এটা তাদের জাত ব্যবসা হলেও এখন অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা ধরেছেন। তিনি জানান, মৃৎশিল্পের প্রয়োজনীয় এঁটেল মাটি এখন টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়। তাছাড়া মাটির তৈরি সামগ্রী পোড়ানোর জন্য জ্বালানির খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী এখন শুধু মাটির তৈরি ফুলের টব, কলকি ও দইয়ের পাত্র তৈরি হচ্ছে। তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে সারাদিনের পরিশ্রম এবং কষ্টের টাকাও আসছে না। তিনি আরো জানান, চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষের মেলায় তাদের সারা বছরের তুলনায় বিক্রি বেশি হয়।
মৃৎশিল্পীরা জানান, প্রযুক্তিতে তৈরি সহজলভ্য প¬াস্টিক জাতীয় পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে মাটির তৈরি পণ্য বাজারে আর চলছে না। ব্যবহারে সহজ প¬াস্টিক ও এলুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি তৈজসপত্র ছাড়া মানুষ আগের যুগের মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন ব্যবহার করছে না মোটেও।
প্রবীণ কারিগর গুরুদাস পাল বলেন, আমাদের এই বর্তমান পুরুষের পরে হয়তো আর কেউ এই পেশায় থাকবে না। এক যুগ আগেও এই কুমার পাড়ায় শতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। মৃৎশিল্প হারিয়ে যাওয়ার ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িত পরিবারগুলোতে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে।
এক সময়ের অতি প্রয়োজনীয় মাটির বাসন-কোসন এখন আর গেরস্তের ঘরে খুঁজে পাওয়া যায় না। কালের বিবর্তনে এখন গ্রামাঞ্চলেও চলে এসেছে আধুনিক সব তৈজসপত্র। ফলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সানকি পাতিলের দেখা এখন মেলে না। কিছু হিন্দু পাল সম্প্রদায় এখনও তাদের বংশগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন কায়িক শ্রমের বিনিময়ে তারা যা পান তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে কোনভাবে সংসার টিকিয়ে রেখেছেন। তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অুনষ্ঠানসহ অর্থনৈতিকভাবে মোটেই স্বচ্ছল নয়। ফলে পৈত্রিক পেশায় নিয়োজিত কুমাররা চরম বিপাকে পড়েছেন। তাই তারা সরকারের কাছে ক্ষুদ্র এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে স্বল্প সুদে এবং সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার দাবি জানান।
জানা গেছে, এ পেশার জিনিস তৈরির একমাত্র উপকরণ এঁটেল মাটির এখন বড়ই অভাব। ইটের ভাটার জন্য মাটি বিক্রি হওয়ায় এখন আর বিনামূল্যে মাটি পাওয়া যায় না। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মৃৎশিল্পীদের টিকিয়ে রাখার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশি¬ষ্টরা।
No comments:
Post a Comment