Monday, June 15, 2020

বড়দের স্বার্থসিদ্ধি আর ছোটদের হতাশার মুখে ঠেলে দেয়ার বাজেট

কারখানায় লেখক।

।। কাজী সাজেদুর রহমান।। 

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এসএমই ফাউন্ডেশন শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এনবিআর'কে যে নিদে'শনা প্রদান করা হয় তা উপেক্ষিত।

ঘুরে ফিরে সেই একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি বড়দের স্বার্থসিদ্ধি আর ছোটদেরকে আবারো হতাশার মুখে ঠেলে দেয়ার এক নির্মম পরিহাস। সব সময়ের মতো এসএমই উদ্যোক্তাদের যৌক্তিক দাবিগুলোকে কখনোই ওই অফিসের মানুষগুলো আমলে নেয়নি। তারা কখনো বুঝতে চেষ্টা করেনি এই দাবিগুলো এদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারত। 

বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়। আজকে যে সম্ভাবনাময় সেক্টরগুলো ছোট আকারে উন্মোচিত তা যে একসময় অনেক বড় শিল্পখাতে উম্মোচিত হবে না তা কেন আপনাদের বোধগম্য হয় না।

আজকে যেখানে দিনে দিনে বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে, সেখানে আমরা নতুন নতুন সেক্টরগুলোকে উঠে আসার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দূরে থাক বরং কিভাবে তাকে বাধাগ্রস্ত করা যায় তার সব বন্দোবস্ত নিজেরাই করে দিচ্ছি। 

জি আমি কাজী সাজেদুর রহমান, স্বত্বাধিকারী, কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজ, কথা বলছি এমন একটি শিল্প নিয়ে যাকে আমরা পরিবেশবান্ধব শিল্প হিসেবে চিনি, কথা বলছি এমন একটি শিল্প পণ্য নিয়ে যাকে আমরা স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য হিসেবে বিবেচনায় রাখি। বলছি পেপার কাপ শিল্পের কথা অথচ এ শিল্পটি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত।

বিগত ৪টি বছর আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দরজায় দরজায় ঘুরেছি তাদেরকে এতোটুকু বোঝানোর জন্য চেষ্টা করেছি যে, দেখুন পেপার কাপ একটি পরিবেশ বান্ধব পণ্য এটা আমাদের পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে। বিশ্বের সব জায়গায় এটি পরিবেশ বান্ধব পণ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এর সমস্ত কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে সব কিছুতে আমদানি শুল্ক ০% থেকে ৫% শতাংশ করা আছে। অথচ আমাদের দেশে আজকে রাজস্ব বোর্ড এটি সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকায় সাধারণ কাগজের মতোই এই কাগজটিকে গণ্য করে ৬১% আমদানি শুল্ক আরোপ করে রেখেছে।

বাংলাদেশে পেপার কাপের ইতিকথা:-

২০১২ সালে আমি প্রথম কেপিসি ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যাত্রা শুরু করি। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে এসে এসএমই ফাউন্ডেশন আমাকে জাতীয় বর্ষসেরা এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার প্রদান করে। আমার এই পুরস্কার পাওয়ার পরে বাংলাদেশ থেকে অনেক উদ্যোক্তা অনুপ্রাণিত হয়ে পেপার কাপ শিল্প স্থাপন করে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ৪০টির মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- এই যে, এর ভিতরে মাত্র ৩ থেকে ৪টি হাতেগোনা প্রতিষ্ঠান যারা এখনো পর্যন্ত খুবই সামান্য পরিসরে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। 

আমি যদি একটি পরিসংখ্যান বলি, এই মুহূর্তে বিশ্ববাজারে পেপার কাপ এর বাৎসরিক বাজার মূল্য ৩১৬ বিলিয়ন ডলার। এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সেখানে প্রতি মাসে ১০০ কোটির বেশি পেপার কাপ ব্যবহৃত হয়। আপনারা সবাই জানেন, বাংলাদেশে চায়ের ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং এই চায়ের দোকানগুলোতে প্রতি মাসে ১৫ কোটি প্লাস্টিক কাপ এবং ১২ কোটি পেপার কাপের ব্যবহার। 

যদিও প্লাস্টিক কাপ হাইকোর্ট কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, বিধায় আগামী ডিসেম্বরের পরে এটি বৈধভাবে আর বাজারে আসতে পারবে না। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য যে কাপের চাহিদা তৈরি হবে সেটা বলাই বাহুল্য। এই পরিসংখ্যান-ই বলে দেয় যে, এই শিল্প সেক্টরটি অনেক বৃহৎ আকার ধারণ করার ক্ষমতা রাখে।

 অথচ আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যারা বসে আছেন তাদের মাথায় এটা গত ৪ বছরে আমি বারবার আবেদন করেও বুঝাতে সক্ষম হইনি। যার দরুন কাঁচামাল আমদানি করতে বেশি আমদানি শুল্ক হওয়ায় দেশের উদ্দ্যোক্তারা উক্ত বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। আবার অন্যদিকে যেখানে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলতেছেন যে, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে হবে। তার মানে হল এই, দেশে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারকে বাড়ানো। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পেপার কাপের ইন্ডাষ্ট্রি বাংলাদেশের মধ্যে ৪০টি এবং যারা সক্ষম বাংলাদেশকে পরিপূর্ণভাবে সাপ্লাই দেয়ার জন্য।

অথচ এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড টিকে থাকার জন্য সহযোগিতা না করে উল্টো তারা বিদেশ থেকে পেপার কাপ আনার সব ব্যবস্থাকে আরো সহজ করে দিয়েছে। 

যেমন পেপার কাপের ফিনিশ প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি আমদানি মূল্য যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩.৫ ডলারের নিচে নয়, সেখানে আমাদের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১.৫ ডলার নির্ধারণ করে। যার দরুন অবৈধ অসাধু আমদানিকারকরা এই সুযোগে তারা কাপের দাম কম দেখিয়ে হিউজ পরিমাণে কোরিয়া, ভারত এবং চীন থেকে নিয়ে আসছে, যা সমস্ত বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অত্যন্ত নিম্নমানের কাপ হওয়া সত্বেও সেটিই এখন কম মূল্যে বাজারজাত হওয়ায় এটি সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশে অবস্থানরত যে সমস্ত ইন্ডাস্ট্রি কাজ করছিল তাদের আর বাজারে টিকে থাকার নূন্যতম সুযোগ আর বাকি থাকে না।

একটি মজার বিষয় লক্ষণীয় যে, কাগজের কাপ এর কাঁচামাল আমদানিতে ৬১% শুল্ক আরোপ করা আছে। কিন্তু কাগজের কাপ যেটা ফিনিশ প্রোডাক্ট হিসেবে পরিচিত তার ক্ষেত্রেও ৬১% শুল্ক আরোপ করা আছে, যা একটি হাস্যকর বিষয় বস্তু হিসেবে প্রতীয়মান হয়। 

এবারের বাজেট প্রসঙ্গ:- 

২০২০-২১ সালের বাজেটে পেপার কাপ ম্যানুফ্যাকচারিং এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমি এবং আমাদের উজ্জ্বল ভাই, আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যাই আমাদের আবেদনটি জমা দেয়ার জন্য। আমরা যখন প্রথম সেক্রেটারির রুমে প্রবেশ করি উনি আমাদের সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলতে রাজি ছিলেন না। এবং পরবর্তীতে আমরা অনলাইনের মাধ্যমে তা জমা দেই।

তারা কথা দিয়েছিলেন যে, অনলাইনে জমা দিলে তারা এটার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা আমাদের আবেদনটা পড়েও দেখেন নাই। যদি একবার পড়ে দেখার চেষ্টাও করতেন তাহলে কিছু একটা সুযোগ আমাদের অবশ্যই আসতো। এটাই হলো আমাদের দেশের দৈন্যদশা, যা আমরা প্রতি মুহূর্তে অনুধাবন করি।

আর একটি পরিসংখ্যান দিয়ে আমি আমার আলোচনা শেষ করতে চাই। সেটা হলো:- আমরা যদি গাণিতিকভাবে দেখার চেষ্টা করি মাসে ৩০কোটি পেপার কাপ যদি দেশীয় বাজারে র জন্য বানানো হয় সেখানে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ থাকে। আর যখন‌ এটি বিদেশে রপ্তানি হবে তখন সবকিছুর সূচক আরো বেশি পজিটিভ হবে।

পেপার কাপ একটি আমদানি বিকল্প পণ্য হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে অর্থনীতিতে বৃহৎ অবদান রাখার সুযোগ থাকে। আমার মনে হয়, এই সকল বিষয়গুলো যদি অতীব গুরুত্ব দেয়া হয় পেপার কাপ একটি ছোট শিল্প সেক্টর থেকে একটি বড় শিল্প সেক্টর হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে, যা আমি মনে করি বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরের সমতুল্য হওয়ার সক্ষমতা রাখে।

সুতরাং সরকারের কাছে আমার আবেদন, যারা এই সকল দায়িত্বগুলো নিয়ে বসে আছেন, দয়া করে তাদেরকে বলুন, যেন তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসএমইর ভেতরে যে সমস্ত উদ্যোগগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সেগুলো নিয়ে বিশদ কাজ করে, যাতে উদ্যোক্তাদেরকে অন্তত ওই সকল আমলাদের অফিসে গিয়ে বসে থাকতে না হয়।

এ দেশটির অর্থনীতিতে, পরিবেশ রক্ষায়, স্বাস্থ্য সুরক্ষায়, কর্মসংস্থানে যাতে আমি এবং সকল উদ্দ্যোক্তারা আরো বেশি অবদান রাখতে পারি সেই কামনা করে এখানেই শেষ করছি। আপনাদের সকলের দোয়া কামনা করছি।

লেখক: পেপার কাপ ম্যানফেকচারার এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি ও এই শিল্পে অন্যতম উদ্যোক্তা কেপিসি ইন্ড্রাষ্ট্রিজের চেয়ারম্যান। 

No comments:

Post a Comment