এদিকে বাজারে কার্যকর নজরদারি নেই। খোলাবাজারে পিয়াজ বিক্রি করেও দাম কমাতে পারছে না সরকারি সংস্থা টিসিবি। অবশ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, পিয়াজের বাড়তি দাম ঠেকাতে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেছে। অন্তত দুই হাজার বিক্রেতাকে শাস্তি দিয়েছে তারা। কিন্তু এর পরও মিলছে না সুফল। অতিরিক্ত দামে পিয়াজ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ভোক্তাসাধারণ।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর পিয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এরপর সরকারের তৎপরতায় মিয়ানমার থেকে পিয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। এতে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তা হলে বোঝা যাচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীই ইচ্ছা করে দাম বাড়াচ্ছেন। সরকারকে সেই জায়গায় নজরদারি করতে হবে। তারা মনে করেন, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে বাজারে এমন অযৌক্তিক মূল্য অব্যাহত রয়েছে।
বাজারে দেখা গেছে, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও মিয়ানমার ও মিসর থেকে আসছে পিয়াজ। এরপরও দাম কমছে না। উল্টো দফায় দফায় বাড়ছে। বৃষ্টির অজুহাতে শুক্র ও শনিবার দুই দফায় পিয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা পর্যন্ত। গতকাল পাইকারি বাজারে দেশী পিয়াজের প্রতিকেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে পিয়াজের দাম বাড়ছে।
এদিকে গতকাল চট্টগ্রামে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আমি আশাবাদী এক সপ্তাহের মধ্যে মিশরের পিয়াজ চলে আসবে। যদি আসে তা হলে হয়তো আমরা ৮০ টাকার মধ্যে পিয়াজ সরবরাহ করতে পারবো। তবে কষ্টটা বোধ হয় আমাদের আরো একটা মাস করতে হবে। কারণ আমাদের নিজেদের (পর্যাপ্ত পিয়াজ মজুদ) নেই।
রাজধানীর কাওরান বাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কেজিপ্রতি পিয়াজের জন্য গুনতে হচ্ছে ১২০ টাকা পর্যন্ত, যা এক দিন আগেও ছিল ১১০ টাকা। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানে কেজিতে পিয়াজের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। দেশী বা আমদানি সব ধরনের পিয়াজের দামেই ঊর্ধ্বগতি। গত এক মাসের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ১২০ টাকায় উঠল পিয়াজের দাম।
ঢাকার বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারে মিসর থেকে আসা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকা, যা শুক্রবার ছিল ৮০-৯০ টাকার মধ্যে। শুক্রবারের আগে ছিল ৬০-৭০ টাকা কেজি। মিসরের পিয়াজের পাশাপাশি বেড়েছে দেশি ও ভারতীয় পিয়াজের দাম। দেশি পিয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা, যা শুক্রবার ছিল ১০০-১১০ টাকা। শুক্রবারের আগে ছিল ৭৫-৮০ টাকা। শুক্রবারের আগে ৬০-৬৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ভারতীয় পিয়াজের দাম বেড়ে হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা।
পিয়াজের আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পিয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মাজেদ বলেন, আমরা যত কথাই বলি, ভারতের পিয়াজ আমদানি শুরু না হলে দাম কমবে না। কারণ আমরা অন্যান্য দেশ থেকে পর্যাপ্ত পিয়াজ পাচ্ছি না। আবার আমদানিও করতে হচ্ছে চড়া দামে।
তবে আরেক আমদানিকারক বলেন, বাজারে কিছু সমস্যা হচ্ছে। যেমন, মিসরের পিয়াজ আমদানিকারকরা ৮০-৮২ টাকার মধ্যে বিক্রি করছেন। সেটা খুচরা বাজারে ৯০ টাকা থাকার কথা। তবে এ পিয়াজও ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিয়ানমারের পিয়াজ ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আড়তে। সেটা খুচরায় ১০০-১০৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এটিও ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অস্থিরতার বাজারে এ সুবিধা বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, আগে দিনে ভারত থেকে সাড়ে ছয় হাজার টন পিয়াজ আসত। এখন সেখানে মিয়ানমার থেকে দিনে ২৫০-৩০০ টন পিয়াজ আসছে। অন্যান্য দেশ থেকে আরো কিছু পিয়াজ আসছে। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়।
রাজধানীর কাওরান বাজারের পাইকারি আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, দেশি, ভারতীয়, মিসর ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে। মেসার্স মাতৃভা-ার ৫৬ নম্বর আড়তের মূল্যতালিকায় দেখা গেল, দেশি পিয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, ভারতীয় পিয়াজ ১১৫ টাকা, মিসরের পিয়াজ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পিয়াজের দাম কেন কমছে না জানতে চাইলে আড়তের বিক্রেতা লোকমান হোসেন বলেন, পিয়াজ আমদানি কমে গেছে। দেশি পিয়াজের মজুদও কম। সব মিলিয়ে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। যে কারণে দাম বাড়তি। আরেক আড়তদার বলেন, বাজারে যারা প্রভাব বিস্তার করছেন, তারা অনেক বড় ব্যবসায়ী। তাদের ধরা উচিত।
এদিকে খুচরা বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২৫ টাকায়। শুক্রবারও এই দামেই বিক্রি হয় দেশি পিয়াজ। তবে একদিনের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে আমদানি করা পিয়াজ। ভালো মানের আমদানি করা পিয়াজ কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকা, যা শুক্রবার ছিল ৮০-৯০ টাকা।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনে মিয়ানমার থেকে যে পিয়াজ আমদানি হচ্ছে, সেগুলোর দাম পড়ছে প্রতি কেজি ৪২ টাকা। একই পিয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। এর আগে ভারতীয় পিয়াজ আমদানি হয়েছে ৭২ টাকা কেজি দরে। বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। মিসরের পিয়াজ আমদানি হয়েছে ২৫ টাকা কেজি দরে, বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
আমদানি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারত সরকার কর্তৃক পিয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হলেও ৩০শে সেপ্টেম্বর থেকে ১৯শে অক্টোবর পর্যন্ত ২০ দিনে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৮ হাজার ৫৬৮ টন পিয়াজ। এ সময়ে মিয়ানমার থেকে ১২ হাজার ৮৪৯ টন, মিসর থেকে ৫৬২ টন এবং চীন থেকে ৫২ টন পিয়াজ আমদানি করা হয়। সব মিলিয়ে ২০ দিনে পিয়াজ আমদানি হয়েছে ২২ হাজার টন।
মগবাজার মধুবাগ কাঁচাবাজারে দেখা গেছে, ওই বাজারে ৮ থেকে ১০ জন বিক্রেতা। তাদের মধ্যে ৫ জনের কাছে পিয়াজ আছে। আর বাকিদের কাছে পিয়াজ নাই। তাদের একজন জানালেন, 'দাম বেশি, গ্রাহকরা ঝামেলঅ করে, তাই বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। পিয়াজ বিক্রেতা সুমন মিয়া বলেন, পাইকারি বাজারে পিয়াজের অভাব নাই। দামটা বেশি, এটাই সমস্যা।
বিক্রেতাদের দাবি, পাইকারি বাজার থেকে চাহিদা অনুযায়ী পিয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে অনেকেই পিয়াজ বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। তারা বলেন, বৃষ্টির কারণে পিয়াজের দাম বেড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার শ্যামবাজার থেকে যে পিয়াজ ৮০ টাকা কেজি কিনেছি, এখন তা ১২০ টাকা। সামনে হয়তো আরো বাড়তে পারে। কিন্তু কিছুদিন পরই বাজারে নতুন পিয়াজ আসবে, এ পরিস্থিতিতে পিয়াজের দাম বাড়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। মূলত শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীদের কারণেই দাম বাড়ছে। শ্যামবাজারে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নিলেই দেখবেন দাম কমে গেছে।
টেকনাফ স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গেল ২৬ দিনে মিয়ানমার থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার টন পিয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানির এ হার আগের চেয়ে বাড়ছে।
গ্রাহকরা জানান, ব্যবাসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। দাম যখন বেড়ে যায় তখনই সব দোকানদার একসঙ্গে বাড়ায়। এটা সম্ভব তখনই, যখন বিক্রেতারা একজোট থাকে।
কাওরানবাজারে আসা মতিন বলেন, বাজারে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে। নজরদারি হলে অন্তত দিনে দিনে দাম বাড়তে পারে না।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) খোলাবাজারে ৪৫ টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করছে। কিন্তু তাতেও বাজারে কোনো প্রভাব পড়ছে না। প্রতিষ্ঠানটি এখন ঢাকার ৩৫টি স্থানে ট্রাকে করে পিয়াজ বিক্রি করছে। প্রতিটি ট্রাকে প্রতিদিন ১ হাজার কেজি করে পিয়াজ বিক্রির জন্য দেয়া হচ্ছে বলে জানান টিসিবির তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির।
গতকাল চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড এক্সপোর্ট ফেয়ারের (বিআইটিএফ) উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী বলেছেন, এবার আমাদের শিক্ষা হয়েছে। কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি বলেছেন খুব চেষ্টা করবেন পিয়াজ উৎপাদন বাড়াতে। আমাদের যেন আর বাইরের ওপর নির্ভর করতে না হয়। এবার হয়তো কষ্ট হবে। আশাকরি, আগামী বছর অবস্থার উন্নতি হবে। পিয়াজে ভারতনির্ভরতা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাই তা না, আমরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই। আমাদের সব চেষ্টা হলো আগামীতে যেন নিজেরাই এসব জিনিস উৎপাদন করতে পারি।
বাজার মনিটরিং প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, মজুদকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি। সমস্যাটা হচ্ছে হঠাৎ করে চাপ দিলে তারা বিগড়ে গেলে মানুষের কষ্ট আরো বাড়বে। এদিকে চাপের কারণে কিছু পিয়াজ পচেও গেছে। আমরা বাজার মনিটরিং করতে যাই। কিন্তু কাউকে জেলখানায় নিয়ে ভরবো সেই রকম মানসিকতা নেই। আমরা তাদের প্রোঅ্যাকটিভ করতে চাই, বোঝাতে চাই। তাতে কিছু কাজ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, সমস্যাটা আরো এক মাস থাকবে। মিশরের পিয়াজ ঢুকলে দাম কমে আসবে।
উল্লেখ্য, পিয়াজের বাজারের এ অস্থিরতার শুরু হয়েছিল ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারতের পিয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। সে সময় পিয়াজের দাম কেজি ১৩০ টাকায় উঠেছিল। কিন্তু এটি আবার কমে ৭০-৯০ টাকার মধ্যে আসে। কিন্তু তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দ্রুতই আবার ১০০ টাকা, পরের ধাপে ১১০ টাকা এবং সব শেষে গতকাল ১২০ টাকায় উঠে আসে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা হলেও দাম বাড়ার নেরাজ্য আর ঠেকানো যাচ্ছে না।