ঢাকা: বুড়িগঙ্গার তীরে ঘটে চলেছে পোশাক শিল্পের নীরব বিপ্লব। এখানে তৈরি পোশাক কমপক্ষে ৩৫টি দেশে রফতানি হচ্ছে। ছোট বড় প্রায় ১০ সহস্রাধিক গার্মেন্টসে তৈরি পোশাক বিক্রি হচ্ছে দেশের বাজারে। নগদ অর্থে যার পরিমাণ দৈনিক পঞ্চাশ কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে রাজধানীর সদরঘাট ও শ্যামপুর, অন্য তীরে কেরানীগঞ্জ উপজেলার আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন। আগানগরের ঠিক পশ্চিমে বাংলার চীন নামে পরিচিতি পাওয়া জিনজিরা, মোগল আমলের স্মৃতি বিজড়িত জিঞ্জিরা প্রাসাদ। এসব স্থানের ঐতিহাসিক পরিচিতি কালের বিবর্তনে চাপা পড়ে গেলেও বিভিন্ন শিল্পের কারণে এখন আবার জেগে উঠছে কেরানীগঞ্জ।
আগানগর ও শুভাঢ্যায় গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লী খুলে দিয়েছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। স্বাধীনতার পর সীমিত পরিসরে শুরু হওয়া এই গার্মেন্টস পল্লী ধীরে ধীরে ব্যাপকতা লাভ করেছে।
বর্তমানে এই পল্লী অভ্যন্তরীণ পোশাকের প্রায় ৬০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতি’র তথ্যমতে, এখানে দিনে বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার অধিক মূল্যের পোশাক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখানকার গার্মেন্টস পল্লীতে কর্মরত রয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
মফস্বল শহরগুলোর বিপণি বিতান তো বটেই, রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতে এখন বিদেশি কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতাদের হাতে হাতে উঠছে এখানকার পোশাক। এমনকি রফতানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, দুবাই, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ৩৫টি দেশে।
দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলে এ গার্মেন্টস পল্লীর বিকাশে উল্লেখযোগ্য কোন সহযোগিতা নেই সরকারি তরফে। এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের একান্ত প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে নিচ্ছেন সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র এই শিল্পকে।
পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, গেঞ্জি, স্যুট-ব্লে¬জার, বোরকা, সব রকমের শীতবস্ত্র, শিশুদের কাপড় থেকে শুরু করে নানা ধরনের পোশাক পাওয়া গেলে এই ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লী বিশেষভাবে বিখ্যাত জিন্স ও গেভার্ডিন প্যান্টের জন্য। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সিংগাপুর, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামিদামি ব্রান্ডের জিন্স ও গেভার্ডিন প্যান্টের আদলে প্রস্তুতকৃত এখানকার প্যান্ট বিদেশি প্যান্ট হিসেবে দেশের বড় বড় শপিংমলে বিক্রি হচ্ছে দেদার। মফস্বলের বিপণী বিতানগুলোতেও এর অনেক কদর।
এক্সপোর্ট গার্মেন্টের ফেব্রিকস কিনে এখানের ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লীর কারিগরেরা নিজস্ব আদলে তৈরি করছেন এসব প্যান্ট। ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি অংশ আবার বড় পোশাক কারখানার আংশিক ত্র“টিযুক্ত কাপড় বা ঝুট সংগ্রহ করে তৈরি করছেন চমৎকার সব পোশাক।
উল্লেখ্য, দেশের বৃহৎ তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মতো এখানে শমিক অসন্তোষের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীরা সারাক্ষণ কারখানা শ্রমিকদের সঙ্গেই লেগে থাকেন দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদে।
চরকালিগঞ্জ নুর সুপার মার্কেটে অবস্থিত ইত্যাদি গার্মেন্টসের মালিক তরুণ ব্যবসায়ী মো. বিপ্লব হোসেন (৩০)। পড়াশুনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় যোগ দেন। বিপ্লব হোসেন জানান, রাজধানীর মিরপুর, সাভার ইপিজেড, গাজীপুর, টংগী, নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চল থেকে জিন্সের ঝুট ফেব্রিক্স স্থানীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা মণে সংগ্রহ করে সেগুলোকে প্রথমে সাইজ, মান ও কালার অনুযায়ী ভাগ করি। এরপর সেগুলোকে কাটিং করি। তারপর বিদেশি প্যান্টের আদলে কম্পিউটারাইজড মেশিনে এমব্রয়ডারি করে দক্ষ দর্জি দিয়ে সেলাই করা হয়। সেলাই ও এমব্রয়ডারির পর সেগুলোকে ওয়াশিং মেশিনে কালার কিংবা বিশেষ অংশে ভিন্ন রূপদান করা হয়। তিনি বলেন, ছেলেদের প্যান্টের চেয়ে লেডিস প্যান্টের চাহিদা অনেক বেশি। ছোট বড় সবার জন্যই এই লেডিস প্যান্টের চাহিদা রয়েছে। উপমহাদেশে আগে ভারতে এই লেডিস প্যান্টের চাহিদা বেশি ছিল। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে এর চাহিদা বেড়েছে। আমাদের তৈরি প্যান্ট ১৬০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এখান থেকে কিনে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন আধুনিক শপিংমলে ১২০০ টাকার জিন্সের প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ২২০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়।
মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার বালিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা জিন্স প্যান্ট তৈরির কারিগর রফিক হাওলাদার বলেন, এখানে যেমন রিজেক্ট কাপড় দিয়ে প্যান্ট বানানো হয়, তেমনি নতুন কাপড় দিয়েও প্যান্ট বানানো হয়। আমরা জাপান, চীন, থাইল্যান্ডের তৈরি প্যান্টের মত একই রকম প্যান্ট হুবহু তৈরি করতে পারি। অনেক সময় বিদেশি প্যান্টের চেয়েও আমাদের ফিনিশিং ভালো হয়।
কেরানীগঞ্জ গামের্ন্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিজ শেখ বলেন, আমাদের তৈরি কাপড়ের মান দিন দিন ভাল হচ্ছে। তাই বিগত সময়ের চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। গার্মেন্টস পল্লীতে ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এখানে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক থাকায় কোন শ্রমিক অসন্তোষ নেই।
সমিতির সদস্য আসাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী হাজী আসাদ খান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ীরা তেমন লাভবান হতে পারেনি। ব্যাংক ঋণসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। তবে এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে আমরা আশাবাদী।
ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা, বিদ্যুত-গ্যাস সুবিধা পর্যাপ্তকরণ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সহজশর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা হলে এখানকার ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লী কেবল দেশেই নয়, গোটা এশিয়ার মধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারে, এমনটাই মনে করেন অনেকে।