Saturday, May 31, 2014

বুড়িগঙ্গা তীরে পোশাক শিল্পের নীরব বিপ্লব


ঢাকা: বুড়িগঙ্গার তীরে ঘটে চলেছে পোশাক শিল্পের নীরব বিপ্লব। এখানে তৈরি  পোশাক কমপক্ষে ৩৫টি দেশে রফতানি হচ্ছে। ছোট বড় প্রায় ১০ সহস্রাধিক গার্মেন্টসে তৈরি পোশাক বিক্রি হচ্ছে দেশের বাজারে। নগদ অর্থে যার পরিমাণ দৈনিক পঞ্চাশ কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। 

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে রাজধানীর সদরঘাট ও শ্যামপুর, অন্য তীরে কেরানীগঞ্জ উপজেলার আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন। আগানগরের ঠিক পশ্চিমে বাংলার চীন নামে পরিচিতি পাওয়া জিনজিরা, মোগল আমলের স্মৃতি বিজড়িত জিঞ্জিরা প্রাসাদ। এসব স্থানের ঐতিহাসিক পরিচিতি কালের বিবর্তনে চাপা পড়ে গেলেও বিভিন্ন শিল্পের কারণে এখন আবার জেগে উঠছে কেরানীগঞ্জ।

আগানগর ও শুভাঢ্যায় গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লী খুলে দিয়েছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। স্বাধীনতার পর সীমিত পরিসরে শুরু হওয়া এই গার্মেন্টস পল্লী ধীরে ধীরে ব্যাপকতা লাভ করেছে। 

বর্তমানে এই পল্লী অভ্যন্তরীণ পোশাকের প্রায় ৬০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমিতি’র তথ্যমতে, এখানে দিনে বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার অধিক মূল্যের পোশাক। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখানকার গার্মেন্টস পল্লীতে কর্মরত রয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ।

মফস্বল শহরগুলোর বিপণি বিতান তো বটেই, রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতে এখন বিদেশি কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতাদের হাতে হাতে উঠছে এখানকার পোশাক। এমনকি রফতানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, দুবাই, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ৩৫টি দেশে।

দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলে এ গার্মেন্টস পল্লীর বিকাশে উল্লেখযোগ্য কোন সহযোগিতা নেই সরকারি তরফে। এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেদের একান্ত প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে নিচ্ছেন সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র এই শিল্পকে। 

পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, গেঞ্জি, স্যুট-ব্লে¬জার, বোরকা, সব রকমের শীতবস্ত্র, শিশুদের কাপড় থেকে শুরু করে নানা ধরনের পোশাক পাওয়া গেলে এই ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লী বিশেষভাবে বিখ্যাত জিন্স ও গেভার্ডিন প্যান্টের জন্য। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সিংগাপুর, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামিদামি ব্রান্ডের জিন্স ও গেভার্ডিন প্যান্টের আদলে প্রস্তুতকৃত এখানকার প্যান্ট বিদেশি প্যান্ট হিসেবে দেশের বড় বড় শপিংমলে বিক্রি হচ্ছে দেদার। মফস্বলের বিপণী বিতানগুলোতেও এর অনেক কদর।

এক্সপোর্ট গার্মেন্টের ফেব্রিকস কিনে এখানের ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লীর কারিগরেরা নিজস্ব আদলে তৈরি করছেন এসব প্যান্ট। ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি অংশ আবার বড় পোশাক কারখানার আংশিক ত্র“টিযুক্ত কাপড় বা ঝুট সংগ্রহ করে তৈরি করছেন চমৎকার সব পোশাক। 

উল্লেখ্য, দেশের বৃহৎ তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মতো এখানে শমিক অসন্তোষের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীরা সারাক্ষণ কারখানা শ্রমিকদের সঙ্গেই লেগে থাকেন দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদে। 

চরকালিগঞ্জ নুর সুপার মার্কেটে অবস্থিত ইত্যাদি গার্মেন্টসের মালিক তরুণ ব্যবসায়ী মো. বিপ্লব হোসেন (৩০)। পড়াশুনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় যোগ দেন। বিপ্লব হোসেন জানান, রাজধানীর মিরপুর, সাভার ইপিজেড, গাজীপুর, টংগী, নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চল থেকে জিন্সের ঝুট ফেব্রিক্স স্থানীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা মণে সংগ্রহ করে সেগুলোকে প্রথমে সাইজ, মান ও কালার অনুযায়ী ভাগ করি। এরপর সেগুলোকে কাটিং করি। তারপর বিদেশি প্যান্টের আদলে কম্পিউটারাইজড মেশিনে এমব্রয়ডারি করে দক্ষ দর্জি দিয়ে সেলাই করা হয়। সেলাই ও এমব্রয়ডারির পর সেগুলোকে ওয়াশিং মেশিনে কালার কিংবা বিশেষ অংশে ভিন্ন রূপদান করা হয়। তিনি বলেন, ছেলেদের প্যান্টের চেয়ে লেডিস প্যান্টের চাহিদা অনেক বেশি। ছোট বড় সবার জন্যই এই লেডিস প্যান্টের চাহিদা রয়েছে। উপমহাদেশে আগে ভারতে এই লেডিস প্যান্টের চাহিদা বেশি ছিল। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে এর চাহিদা বেড়েছে। আমাদের তৈরি প্যান্ট ১৬০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এখান থেকে কিনে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন আধুনিক শপিংমলে ১২০০ টাকার জিন্সের প্যান্ট বিক্রি হচ্ছে ২২০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। 

মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার বালিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা জিন্স প্যান্ট তৈরির কারিগর রফিক হাওলাদার বলেন, এখানে যেমন রিজেক্ট কাপড় দিয়ে প্যান্ট বানানো হয়, তেমনি নতুন কাপড় দিয়েও প্যান্ট বানানো হয়। আমরা জাপান, চীন, থাইল্যান্ডের তৈরি প্যান্টের মত একই রকম প্যান্ট হুবহু তৈরি করতে পারি। অনেক সময় বিদেশি প্যান্টের চেয়েও আমাদের ফিনিশিং ভালো হয়। 

কেরানীগঞ্জ গামের্ন্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিজ শেখ বলেন, আমাদের তৈরি কাপড়ের মান দিন দিন ভাল হচ্ছে। তাই বিগত সময়ের চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। গার্মেন্টস পল্লীতে ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এখানে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক থাকায় কোন শ্রমিক অসন্তোষ নেই। 

সমিতির সদস্য আসাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী হাজী আসাদ খান বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ীরা তেমন লাভবান হতে পারেনি। ব্যাংক ঋণসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। তবে এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে আমরা আশাবাদী।

ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা, বিদ্যুত-গ্যাস সুবিধা পর্যাপ্তকরণ, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সহজশর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা হলে এখানকার ক্ষুদ্র গার্মেন্টস পল্লী কেবল দেশেই নয়, গোটা এশিয়ার মধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারে, এমনটাই মনে করেন অনেকে।

নওগাঁয় পাম চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে

নওগাঁ: নওগাঁয় পাম চাষ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নওগাঁ সদরসহ মহাদেবপুর, মান্দা, ধামইরহাট, পতœীতলা এবং রানীনগর উপজেলায় ইতিমধ্যে কমপক্ষে ২০/২৫টি পাম বাগান গড়ে উঠেছে। মুলত দোঁয়াশ মাটিতে পাম চাষ হয়ে থাকে। পাম চাষের প্রয়োজনীয় রৌদ্রতাপ, আর্দ্রতা এবং গড় বৃষ্টিপাত সবকিছুই নওগাঁ’র জমিতে বিদ্যমান বলেই এখানে পাম চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এখানকার উৎসাহী কিছু সচেতন মানুষ পাম চাষ শুরু করেছেন। আর এতে সহযোগিতা করছে গ্রীন গোল্ড এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

তারা পাম গাছের চারা সরবরাহ, প্রচার এবং প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানটি হবিগঞ্জ থেকে পাম গাছের চারা সংগ্রহ করে স্থানীয় পর্যায়ে উৎসাহী পামচাষীদের মধ্যে চার সরবরাহ করছে এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করছে। 

জেলার অনেকের মত নওগাঁ হাসপাতালের দন্ত চিকিৎসক ডাঃ ওমর আলী তাঁর ২৫ শতক জমিতে এবং মান্দা উপজেলার গনেশপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার তার ১ বিঘা জমিতে পাম চাষ করেছেন। তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, পাম চাষে খরচ তেমন নেই। প্রতিটি পাম চারার মুল্য সর্বোচ্চ ১শ টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে কমপক্ষে ৮০টি চারা লাগানো যায়। সে হিসেবে প্রথম বছরে চারার মুল্য বাবদ খরচ হয় ৮ হাজার টাকা। সার কীটনাশক এবং পরিচর্যা বাবদ খরচ হয় আরও ৮ হাজার টাকা। বাগান তৈরির দ্বিতীয় বছর পরিচর্যা বাবদ খরচ হয় ৫ হাজার টাকার মত। আর কোন খরচ নাই। একটি গাছে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি কাঁদি আসে। প্রতিটি কাঁদিতে ২ থেকে ৩ হাজার পর্যন্ত ফল ধরে থাকে। একটি গাছ থেকে গড়ে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০ কেজি পাম তেল পাওয়া যায়। 

গ্রীন গোল্ড এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী রেজাউর রহমান টুকু জানান, গাছ থেকে সরাসরি পাম ফল সংগ্রহ করে গরম পানিতে সিদ্ধ করে তাতে চাপ দিয়ে তেল সংগ্রহ করা যাবে। আবার ফলগুলোকে সরিষার তেল উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত কাঠের ঘানিতে নিষ্কাশন করেও তেল সংগ্রহ করা যাবে। বাড়িতে গরম পানিতে সিদ্ধ করে অথবা কাঠের ঘানিতে নিষ্কাশন করে সংগৃহীত পাম তেল সরাসরি বিভিন্ন তরকারি রান্নাতে ব্যবহার করা যাবে।

কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক এস এম নুরুজ্জামান মন্ডল জানান, নওগাঁসহ বাংলাদেশে পাম চাষ লাভজনক। চাষের সম্ভাবনাও রয়েছে। কাজেই তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে প্রতিটি বাড়িতে ৫/৬টি করে পাম গাছের চারা লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন আগামী ২/৪ বছরের মধ্যে মানুষ প্রতিটি বাড়িতেই পাম গাছ লাগাবেন। তিনি বলেন, পাম ফল থেকে পরিশোধনের মাধ্যমে সঠিক প্রক্রিয়ায় তেল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি। তেল নিষ্কাশনের পরিশোধনের ব্যবস্থা নেয়া হলে এ দেশের মানুষের মধ্যে পাম চাষের উৎসাহ আরও বেড়ে যাবে। তিনি আরও জানান, শুধু তেল নয় বাইপ্রডাক্ট হিসেবে পাম ফল থেকে প্রাপ্ত চর্বি দিয়ে সাবান, গ্লিসারিন, বিভিন্ন রকমের কসমেটিক্স এবং ডিটারজেন্ট পাউডার তৈরি করা যাবে। 

নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ শরীফুল ইসলাম খান বাংলাদেশে পাম চাষের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, পাম ফল থেকে তেল নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনা হলে এবং তেল নিষ্কাশনে সহজ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হলে চাষীরা পাম চাষে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন। তিনি সয়াবিন তেলের চেয়ে পাম তেল অধিক স্বাস্থ্যসম্মত বলে মনে করেন। তিনি আরও বলেন, পাম চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে আমদানী নির্ভর ভোজ্য তেল সয়াবিনের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় ঘটবে।  

Wednesday, May 28, 2014

হবিগঞ্জে বাম্পার ফলন: বিদেশেও রফতানি হচ্ছে হবিগঞ্জের কাঁঠাল

হবিগঞ্জ: জ্যৈষ্ঠ মাসকে বলা হয় মধু মাস। কারণ প্রচণ্ড গরমে চারিদিকে পাকতে শুরু করেছে আম-কাঁঠাল। এই মধু ফলের স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ দিতে বন্ধ হয়ে গেছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জনসংখ্যার বৃদ্ধি আর বন উজাড় হওয়ার জন্য এই মধু ফলও এখন দূর্লভ হতে চলেছে। আবার এই ফল উৎপাদন প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তবে হবিগঞ্জে এবছরের চারিদিকে মৌ মৌ ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে জাতীয় ফল কাঁঠাল। গাছগুলোর শাখা ভরে উঠেছে এই ফলে। 

পাহাড় আর বনাঞ্চল অধ্যুষিত হবিগঞ্জ জেলায় এ বছর কাঠালের বাম্পার ফলন হয়েছে। বাগান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার কাঁঠাল আসছে পাইকারী বাজারে। এখন চলছে কাঁঠাল বিক্রির ধুম। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সুস্বাদু এই কাঁঠাল ক্রয়ের জন্য ক্রেতারা ভিড় জমাচ্ছেন ফলের আড়তে।

হবিগঞ্জের মাটি কাঁঠাল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তুলনামূলকভাবে মিষ্টি ও সুস্বাধু। তাই এখানকার কাঁঠালের চাহিদা বেশি। হবিগঞ্জের পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে অনেকগুলো কাঁঠালের বাগান। বাড়ির আঙ্গিনা ও রাস্তার পাশেও দেখা যায় কাঁঠাল গাছের ছড়াছড়ি। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মাধবপুর ও বাহুবল উপজেলার পাহাড়ি এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার কাঁঠাল বাজারে আসে। হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতর সূত্রে জানা যায়, এবছর কাঁঠালের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলার ১২ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল উৎপাদন করা হয়েছে। উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন।

কাঁঠালকে বলা হয় বাংলাদেশের জাতীয় ফল। এই ফলের স্বাদে যেমন অনন্য তেমনি পুষ্টিতেও ভরপুর। তাই সকলস্তরের লোকজনের কাছেই কাঁঠাল অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ গ্রামের দরিদ্র লোকজন এই সময়ে তাদের প্রধান খাদ্য তালিকায় চলে আসে এই কাঁঠাল। তারা বাজার থেকে কাঁঠাল এনে পরিবারের সকলে মিলে একবেলা আহারের পরিবর্তে পেট ভরে খেয়ে থাকেন। কাঁঠালের বীজ শুকিয়ে তারা রেখে দেন বাড়িতে। পরবর্তীতে এই বীজ সবজি হিসেবে ব্যবহার করেন। এমনকি কাঁঠালের যে উচ্ছিষ্ট অংশ তাও ব্যবহার করা হয় গো-খাদ্য হিসেবে। কাঁঠালের মুচি যেটি ঝড়ে যায় সেটিকেও ভর্তা হিসাবে খাওয়া হয়। অর্থাৎ একটি কাঁঠালের বহুমুখী উপযোগ ভোগ করেন তারা। 

হবিগঞ্জের সবচেয়ে বড় ফলের পাইকারী বাজার মুছাই। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি আড়ৎ। এই আড়তে বিক্রির জন্য কৃষকরা তাদের কাঁঠাল নিয়ে আসেন। প্রতি ১শ’ হিসাবে নিলামের মাধ্যমে এই কাঁঠাল বিক্রি হয়। পাইকাররা নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন কাঁঠাল কিনতে। ছোট সাইজের কাঁঠাল প্রতিশ’ বিক্রি হচ্ছে ১৪শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা করে। তবে বড় কাঁঠালের দাম বেশি। সামনে কাঁঠালের দাম আরও কমবে। মুছাই থেকে ট্রাক ভর্তি হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায় এই কাঁঠাল। এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে হবিগঞ্জের কাঁঠাল।

মুছাইর ফলের আড়তের মালিক সফিকুর রহমান জানান, এ বছর কাঁঠালের ভাল ফলন হয়েছে। এখন ভাল দাম থাকলেও সামনে যখন ব্যাপকভাবে ফসল আসতে থাকবে তখন দাম কমে যাবে। তিনি আরও জানান, তাদের কাছ থেকে ঢাকা ও সিলেটের পাইকাররা কাঁঠাল নিয়ে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। বড় ও ভাল কাঁঠাল লন্ডন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিরা বাংলাদেশী কাঠাল খুব বেশি পছন্দ করে।

সিলেট থেকে মুছাই আড়তে আসা আব্দুল জলিল জানান, তিনি প্রায়ই এখান থেকে কাঁঠাল নিয়ে সিলেটের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। এখানকার কাঁঠাল তুলনামূলকভাবে ভাল এবং দামও কম।

মুছাই বাজারে কাঁঠাল কিনতে হবিগঞ্জ শহর থেকে নজরুল আলম চৌধুরী জানান, বাজারে ফরমালিন আর কারবাইড মেশানো থাকায় এখানে এসেছি কাঁঠাল কিনতে। এখানকার কাঠাল সম্পুর্ণ নির্ভেজাল।

বাগান মালিক ইব্রাহিম মিয়া জানান, আমাদের বাগানে সহযোগী ফসল হিসেবে কাঁঠাল উৎপাদন করা হয়। কাঁঠাল উৎপাদন করতে আলাদা কোন যতœ নিতে হয় না বলে উৎপাদন খরচও কম। তবে এ বছর বেশি ফলন হওয়ায় দাম কম হওয়ায় আশংকা করছেন তিনি।
আলিয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির মন্ত্রী উটিয়াম টমপেয়ার জানান, তার বাগানের গাছগুলোতে কাঠালের ফলন অন্যান্য বছরের তুলনায় ভাল হয়েছে। বাজারে দামও ভাল। গরম বেশি থাকায় একটু আগে থেকেই কাঁঠাল পাকতে শুরু করেছে। তবে জুন-জুলাই মাস হবে এর ভরা মৌসুম। 

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক গোপাল চন্দ্র দাস জানান, সরকারিভাবে অত্যন্ত পুষ্টিকর কাঁঠাল ফলের ফলন বাড়ানো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদন করলে একই সাথে ফসল এবং কাঠ পাওয়া যায়। কাঁঠাল গাছের পাতা থেকে শুরু করে প্রতিটি অংশ ব্যবহার করা যায় বলে অন্যান্য ফলের তুলনায় এটি লাভজনক। এছাড়ও কাঁঠাল উৎপাদনে তেমন যতেœরও প্রয়োজন হয় না। একটি গাছ বহু বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। তবে বন্যামুক্ত এলাকায় কাঁঠালের বাগান করা উচিত। কারণ দীর্ঘদিন এই গাছ পানি সহ্য করতে পারে না।

Tuesday, May 27, 2014

নওগাঁয় আঙ্গুর চাষে অভাবনীয় সাফল্য শিক্ষিত বেকার যুবক উজ্জ্বলের

নওগাঁ: নওগাঁর উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক সালাহউদ্দিন উজ্জ্বল আঙ্গুর চাষ করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। একই সঙ্গে নওগাঁ’র মাটিতে আঙ্গুর চাষের যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে তা তিনি প্রমাণ করেছেন।

সালাহউদ্দিন উজ্জ্বল নওগাঁ শহরের কোমাইগাড়ি মহল্লার সৈয়দ আলীর পুত্র। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে সরকারি-বেসরকারি যে কোন একটি চাকরি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে জীবিকার তাগিদে কৃষিভিত্তিক প্রকল্প হাতে নেন। পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট জেলা থেকে অস্ট্রেলিয়ান উন্নত জাতের আঙ্গুরের চারা এনে রোপণ করেন।

২০১২ সালে কোমাইগাড়ি নতুন জেলখানা’র পার্শ্বে ৩ বিঘা জমি লীজ নিয়ে গড়ে তোলেন আঙ্গুরের বাগান। ওই বছরের এপ্রিল মাসে অস্ট্রেলিয়ান উন্নত জাতের মধ্যে ক্রীমসন সীডলেস এবং মেনেনডি সীডলেস জাতের আঙ্গুরের প্রায় ৩শ’টি চারা রোপণ করেন। প্রতিবিঘা জমি প্রতিবছর বর্তমানে ১২ হাজার টাকা করে বছরে ৩৬ হাজার টাকা করে ৩ বছরের জন্য। মোট লীজ মূল্য প্রায় ১ লাখ টাকা তাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। চারা রোপণ, শ্রমিক খরচ, সার ফসফেট ইত্যাদি বাবদ প্রথম বছর খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
চারা রোপণের ১১ মাস পর ২০১৩ সালের ১ ফেব্র“য়ারি মাসে প্রথম গাছ ছেঁটে দিলে প্রথমবারের মত মোট গাছের মধ্যে ১০টি গাছে আঙ্গুর ধরে। প্রতিটি গাছ থেকে এ বছর এক কেজি করে আঙ্গুর উৎপাদিত হয়। ২০১৪ সালে ফেব্র“য়ারি মাসে দ্বিতীয়বারের মত গাছ ছেঁটে দিলে পুনরায় আঙ্গুর ধরে। এ পর্যায়ে প্রায় একশ’টি গাছে আঙ্গুর ধরেছে। প্রতিটি গাছে এই পর্যায়ে কমপক্ষে ৩ কেজি করে মোট ৩শ’ কেজি আঙ্গুর উৎপাদনের প্রত্যাশা করছেন তিনি। বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি ২৫০ টাকা হারে উৎপাদিত আঙ্গুরের বিক্রি মূল্য পাবেন ৭৫ হাজার টাকা।

উজ্জ্বল জানিয়েছেন, আগামী ২-১ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৫ সাল নাগাদ তার বাগানের আঙ্গুরের উৎপাদন আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পাবে। বছরে দুই বার আঙ্গুর উৎপাদিত হবে। প্রতিবার প্রতিটি গাছ থেকে ২০ কেজি করে মোট ৪০ কেজি আঙ্গুর উৎপাদিত হবে। সে হিসেবে ৩শ’টি গাছে প্রতি পর্যায়ে ৬ হাজার কেজি করে বছরে দু’টি ধাপে ১২ হাজার কেজি আঙ্গুর উৎপাদিত হবে। আঙ্গুরের বর্তমান বাজার অব্যাহত থাকলেও তখন উৎপাদিত আঙ্গুরের মূল্য পাবেন ৩০ লাখ টাকা। আর আঙ্গুরের মূল্য বৃদ্ধি হলে বিক্রিত মূল্য আরও বেড়ে যাবে। এ থেকে পরিচর্যা, সার ফসফেট, লেবার খরচ ইত্যাদি বাবদ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বাদ দিলে বছরে নীট মুনাফা করবেন প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা বলে উজ্জ্বল জানিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এস এম নুরুজ্জামান মন্ডল জানিয়েছেন, আঙ্গুর চাষ করে সালাহউদ্দিন উজ্জ্বল এক অসাধ্য সাধন করেছেন। উন্নতজাতের আঙ্গুর চাষে এই সফলতা বিরল। উজ্জ্বলের বাগানের আঙ্গুর আকারে যেমন বড় তেমনই খেতে সুস্বাদু ও মিষ্টি। উজ্জ্বলের মত এ ধরনের কৃষিভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তুলে শিক্ষিত বেকার যুবকদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তাকে অনুসরণ করলে অনেকেই সফল হতে পারবেন বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। 

Sunday, May 25, 2014

পঞ্চগড়ে সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্প দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে

পঞ্চগড়: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকা  এবং বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান সম্ভব নয়। তাই সেচ যন্ত্রে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। এ জন্য এলাকা বিশেষে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সৌর শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুত ব্যবহার শুরু হয়। এক্ষেত্রে পঞ্চগড়ের কৃষকরাও সৌর বিদ্যুতে সেচ পাম্প চালিয়ে তাদের কৃষি কাজ চালিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্যোগে তারা সফল হয়। এ জন্য এখানে সৌর বিদ্যুত চালিত সেচ পাম্প দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। 

বেংহারী গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান জানান,পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলার হাড়িভাসা,বোদা উপজেলার শিকারপুর, জগন্নাথপুর,বেংহারী ও তেপুকুরীয়া গ্রামের কৃষি নির্ভর এলাকায় সেচ সুবিধা খুব সহজলভ্য  ছিল না। ফলে পর্যাপ্ত সেচের অভাবে অনেক জমি অনাবাদী থাকতো। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় সৌর বিদ্যুৎ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে এখানকার কৃষকেরা। এ প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ শক্তির বিকল্প সৌর শক্তির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী করতোয়া নদী থেকে পানি তুলে এবং গভীর নলকুপের মাধ্যমে ভু-গর্ভস্থ থেকে পানি উঠিয়ে জমিতে সেচ দিচ্ছে। এতে আলাদা কোন জ্বালানি প্রয়োজন না হওয়ায় উৎপাদন খরচ অনেকাংশে কমে গেছে। 

পঞ্চগড় সদর ও বোদা এই দুই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ১০টি সমিতির মাধ্যমে ১৬টি সেচ এলাকায় ৫শ’ জন কৃষক ২ হাজার বিঘা জমিতে এবার বোরো চাষ করেছে সৌর বিদ্যুৎ চালিত পাম্পের মাধ্যমে। সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচ সুবিধা এবং ভু-গর্ভস্থ পানি সরবরাহ লাইন পেয়ে তারা অত্যন্ত খুশি। এবার কম খরচে তাদের ফলনও ভালো হয়েছে। 

মিউচুয়াল ট্রাষ্ট ব্যাংক সৌর চালিত সেচ পাম্প স্থাপনের পাশাপাশি প্রকল্প এলাকার কৃষকদের মাঝে মৎস্য চাষ,গবাদি পশু পালন ও কৃষি কাজের জন্য টাকা ঋণ দিচ্ছে। সৌর বিদ্যুৎ চালিত এই সেচ পাম্প সুবিধা বঞ্চিত এলাকার কৃষকদের অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে সেচ প্রদান, বছরে কমপক্ষে ৩টি ফসল উৎপাদন সর্বোপরি বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের মাধ্যমে কৃষি পণ্য উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কৃষকদের আরো সুবিধার জন্য এ বছর সমিতি ভুক্ত আরো ৬ টি  সৌর সেচ পাম্প স্থাপন করা হবে।  তবে সৌর বিদ্যুৎ সেচ প্ল¬¬¬ান্ট ব্যয় বহুল। একটি সৌর চালিত পাম্প স্থাপনে ৩২ লাখ টাকা ব্যয় হয় বলে কৃষকরা জানান। 

পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসার বিভাগের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, সমবায় ভিত্তিতে অধিকতর সহজ শর্তে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা গেলে, পঞ্চগড়ে আরো বৃদ্ধি পাবে সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচের। নিশ্চিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা, লাভবান হবে কৃষকরা।

Saturday, May 24, 2014

দেশে পুষ্টি নিয়ে দৈন্যতা এখনো কাটেনি

ডেস্ক রিপোর্ট: দেশে সামগ্রিকভাবে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতিতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। তবে পুষ্টি পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি ঘটেনি। 

বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মতে তীব্র অপুষ্টির কারণে দেশে প্রতি বছর ৬৫ হাজার শিশু মারা যায়। বর্তমানে ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ৫ লাখ শিশু অপুষ্টিজনিত নানা রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত। তারা মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব শিশুর চিকিৎসা সেবার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই।

স্বীকৃত যে, বরিশালসহ উপকূলীয় এলাকায় অপুষ্টির প্রকোপ সর্বাধিক। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে পঞ্চগড় জেলায় অপুষ্টির শিকার শিশুর সংখ্যা কম নয়। এখানকার শিশুরা অপুষ্টিজনিত নানা রোগব্যধিতে আক্রান্ত। তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার তেমন একটা ব্যবস্থা নেই। 

রাজধানী ঢাকায় হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও এসব শিশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাই দেশের অন্যত্র শিশুর অপুষ্টিজনিত রোগব্যধির চিকিৎসা সীমিত হওয়াই স্বাভাবিক।

তাছাড়া পুষ্টি নিয়ে তেমন কর্মসূচিও নেই। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কোনো কাজ করছে না। তা প্রকাশ পেয়েছে পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন ডা. মোজাম্মেল হকের কথায়। তার মতে এখানে অপুষ্টিজনিত রোগব্যধি তেমন একটা নেই। তিনি মনে করেন পুষ্টিহীনতার অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্য ঘাটতি। অজ্ঞতাও এর জন্য দায়ী। সজিনা ও কচু শাকে যে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে তা ক’জনে জানেন। এসব শাক-সবজি খেলে শুধু শিশু নয়, মায়েদেরও পুষ্টির ঘাটতি মেটে।

তেঁতুলিয়া উপজেলায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, শিশু ও মায়েদের ভিড়। তারা অনেকেই অপুষ্টির শিকার। উপজেলার কোম্পানিজোতে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী ফ্লোরেন্স হেলেন জানান, শিশুদের জিং জাতীয় ট্যাবলেট দেয়া হয়। এখানে পুষ্টি নিয়ে তেমন কোন কাজ হয় না। মায়েদের রক্তশূন্যতা দেখা দিলে আয়রন ট্যাবলেট দেয়া হয়। শিশুদের কৃমিনাশক ওষুধ দেয়া হয়। কৃমির কারণেও পুষ্টির অভাব দেখা দেয়।

পঞ্চগড়ে পুষ্টি নিয়ে হতাশা থাকলেও কোথাও কোথাও আলোর ঝলক দেখা যায়। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছেÑ পুষ্টিহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই পঞ্চগড়ের ১০টি গ্রামে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পঞ্চগড়ে খলিদাপুর, কুমারপাড়া, নানিয়াপাড়া, সিপাইকামাত সরকারপাড়াসহ ১০টি গ্রামের অধিকাংশ মা-শিশু সারা বছরই অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছিলেন। 

জাপানের আজিনমতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় ‘আজিনমতো পুষ্টি প্রকল্প’ নামে প্রকল্পে কাজ করছে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তারা মা ও শিশুদের পুষ্টির অবস্থা বাড়ানো, পুষ্টি উন্নয়ন বিষয়ক সচেতনতা ও ধারণা বৃদ্ধি, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধমে মারাত্মক অপুষ্টির শিকার মায়েদের পুষ্টি অবস্থার উন্নয়ন, দরিদ্র মায়েদের পুষ্টি অবস্থা স্থায়ীভাবে উন্নতি করা, আয়ের সুযোগ তৈরি করা, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের বাড়িতে পুষ্টিকর রান্নার মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া তারা এ প্রকল্প সফল করতে মা ও শিশুকে সপ্তাহে ৬ দিন রান্না করা খাদ্য সরবরাহ করছে।

পঞ্চগড়ে স্বেচ্ছাসেবী এই প্রতিষ্ঠানটি পুষ্টি নিয়ে কাজ করাতে সারাদেশে আশাব্যঞ্জক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, দেশের ১১ থেকে ১৬ বছর বয়েসী ৪৩ শতাংশ কিশোরী রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। এদের বেশির ভাগই আবার অল্প বয়সে বিয়ে করে গর্ভধারণ করে। এতে গর্ভের শিশুটিও অপুষ্টির শিকার হয়। এ চালচিত্র পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের প্রত্যেকটি জেলার।

অপুষ্টি থেকে শিশুদের মুক্ত করতে না পারলে তারা নানা রোগব্যধির শিকার হওয়াই স্বাভাবিক। স্মরণ রাখা দরকার আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক, তারা পুষ্টির অভাবে নানা রোগ-ব্যধির শিকার হলে তা জাতির জন্য অমঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, অপুষ্টির কারণে প্রধান ৬টি রোগ হয়। রোগগুলো হলো হাড্ডিসার রোগ, গা ফোলা রোগ, রাতকানা রোগ, রক্তস্বল্পতা রোগ, জিহবা ও ঠোঁটের কোণে ঘা, আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা।

পুষ্টিবিদ ডা. শাহাজাদা সেলিম জানান, আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশু আয়রণজনিত খাবারের অভাবে এ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য এবং পরিবারে পুষ্টিজ্ঞানের অভাব। জন্মের ৪ থেকে ৬ মাস পর আয়রণ সমৃদ্ধ বাড়তি খাবার না খেয়ে শুধু বুকের দুধ খেলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ সময় শুধু মায়ের দুধে আয়রণের অভাব পূরণ হয় না। কলিজা, মাংস, মাছ, মোটরশুঁটি, শিম, বরবটি, ডাল, বাদাম, সবুজ শাক-সবজিতে প্রচুর আয়রণ থাকে। এগুলো খেলে আয়রনের অভাব সহজে পূরণ করা যায়।

উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। শুধু অপুষ্টির কারণে প্রতি মিনিটে ১০টি শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছিলো ২০০৬ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে। জাতিসংঘের এমডিজি বা সহস্রাব্দের  উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হাত থেকে শিশুদের রক্ষায় একটি বাৎসরিক লক্ষ্যও স্থির করে দেয়া হয়েছিলো। সেই লক্ষ্য অর্জনে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের সংকল্পও ব্যক্ত করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।

২০১২ সালের ৮ আগস্ট লন্ডনে বিশ্ব পুষ্টি সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা বলেন, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অপুষ্টি কোন একক দেশের সমস্যা নয়। এর প্রভাব বিশ্বের সর্বত্র। তাই এসব বিষয়ে বৈশ্বিক জাতীয় পরিকল্পনা ও কৌশল বাস্তবায়নে গোটা বিশ্বের সম্পদের ব্যবহার, অভিজ্ঞতা বিনিময়, গবেষণা ও প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ ও কাজ করতে হবে। বাংলাদেশও এই অঙ্গীকারে শামিল। 

দেশের ২৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টি ও রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। এদের ব্যাপারে যথাযথ  উদ্যোগ না নিলে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই পরিপূর্ণতা লাভ করবে না। এ কথা স্মরণ রেখেই সরকারকে পুষ্টি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। 

Thursday, May 22, 2014

বরিশালের ব্রান্ড-আইটেম হিসেবে পরিণত হয়েছে গুঠিয়ার সন্দেশ

বরিশাল: উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের ছানার তৈরী গুঠিয়ার সন্দেশ বর্তমানে দেশব্যাপী বরিশালের ব্রান্ড-আইটেম হিসেবে পরিণত হয়েছে। 
জানা গেছে, শুধু বরিশাল মহানগরী নয় গুঠিয়ার সন্দেশ’র খ্যাতি দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। বরিশাল নগরী থেকে গুঠিয়া ইউনিয়নের দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। 

এই গুঠিয়া ইউনিয়নটি আজ সুখ্যাতি লাভ করেছে তার তেরী বিখ্যাত সন্দেশ’র জন্য। দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে আসা ভোজন বিলাসী মানুষ বরিশালে পা রাখলে গুঠিয়ার সন্দেশ-এর স্বাদ নিয়ে যাবেন এমটাই বলেন স্থানীয়রা।

গুঠিয়া সন্দেশের প্রধান বিক্রেতা বাংলাদেশ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্তাধিকারী পরিমল ভদ্র জানান, গুঠিয়া সন্দেশের রেসিপি এসেছে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া অঞ্চল থেকে। আমার কাকা সতীশ ভদ্র আমাদের এ দোকানেই ছিলেন। এরপর বিএম কলেজের সামনে দোকান দেন। কাকার (সতীশ ভদ্র) মুখে শুনেছি, পাকিস্থান আমলে তিনি পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া এলাকায় এক কারিগরের কাছে তিনি এর রেসিপি শিখে নেন। পরে ১৯৬২ সালে তিনি দেশে এসে নতুন ধরণের এই সন্দেশ তৈরি শুরু করেন। অচিরেই এই সন্দেশের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে গুঠিয়া ছাড়াও বরিশাল নগরীর বেশ কয়েকটি শো’রুমে এই সন্দেশ পাওয়া যায়।

সন্দেশ তৈরীর প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিমল চন্দ্র ভদ্র জানান, গুঠিয়া সন্দেশের রেসিপি অত্যন্ত সাধারণ। পরিমাণ মত ‘আঁচ ও পাক’ই ভালো সন্দেশ তৈরীর প্রধান রেসিপি। ভাল সন্দেশ তৈরি করতে খাঁটি দুধের প্রয়োজন। সাধারণত ৬ থেকে ৭ কেজি খাঁটি দুধে ১ কেজি ছানা হয়। ছানার সাথে সমপরিমাণ চিনি মিশিয়ে অল্প জাল দিতে হয়। ২০ থেকে ৩০ মিনিট জ্বালে পাক দিয়ে অল্প আঁচে ৫ মিনিট রাখলেই গুঠিয়া সন্দেশের কাঁচামাল তৈরি হয়।

এরপর পরিমাণ মত কাঠের বাটার উপরে নিয়ে সন্দেশের আকার তৈরী করা হয়। সৌন্দর্যের  (ডেকরেশন) জন্য সন্দেশের উপর কিচমিচ দেয়া হয়।

তিনি জানান, গুঠিয়া সন্দেশ টাটকা থাকলে তা থেকে টাটকা গরুর দুধের সুঘ্রাণ আসবে। অত্যন্ত মুখরোচক এই সন্দেশে খাঁটি ছানা ও চিনি ছাড়া অন্য কোন প্রকার উপকরণ থাকে না। গরুর দুধ ছাড়া অন্য কোনো দুধ দিয়ে গুঠিয়ার সন্দেশ তৈরি করা হয় না।

বর্তমানে নগরীতে ও গুঠিয়া এলাকায় এ সন্দেশের বহু দোকান থাকলেও বাংলাদেশ মিষ্টান্ন ভান্ডারকে এর সুতিকাগার বলা যায়। ১৯৬২ সাল থেকে এই দোকানটি গুঠিয়া ব্রীজ সংলগ্ন স্থানে সন্দেশ বানিয়ে আসছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত সন্দেশ বানিয়ে থাকেন তারা । প্রতিকেজি সন্দেশ বিক্রি হয় ৪’শ টাকা করে। ১ কেজিতে ২৫ পিস পর্যন্ত সন্দেশ ওঠে।

আদি গৌরনদী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সত্বাধিকারী শ্রীধাম ঘোষ জানান, ভোজন বিলাসীদের কাছে গুঠিয়ার সন্দেশ লোভনীয় একটি নাম। এ খাবার দেখলে জিভে জল আসে না এমন ভোজন বিলাসীদের সংখ্যা অতি নগন্য। বরিশালে ভোজন বিলাসী কেউ আসলে গুঠিয়ার সন্দেশের স্বাদ নিতে ভোলে না। মানুষ বরিশালে কাজে বা বেড়াতে এলে ফেরার সময় গুঠিয়ার সন্দেশ নিয়ে যায়। আর ধীরে ধীরে এভাবেই গুঠিয়ার সন্দেশের এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। 

পোল্ট্রি শিল্প ও কৃষিকাজে নারীর অবদান

ডেস্ক রিপোর্ট: কয়েক দশক আগেও গ্রামীণ নারীরা ঘরকন্যার কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগী পালন করে বাড়তি দু’পয়সা আয়-উপার্জন করতো। হালে নারীরা পোল্ট্রি শিল্পকে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। পোল্ট্রি শিল্প ছাড়াও নারী শ্রমিকরা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কৃষি কাজে। আগে সাধারণত গ্রামের পুরুষরা মাঠে কাজ করত। নারীরা তখন ঘরকন্যার পাশাপাশি কৃষি কাজে পুরুষের সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো (তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের ক্ষেত্রে আলাদা চিত্র)। ইদানীং দেশের অনেক জায়গায় প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কাজে নারীরা এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর জনপদে নারী শ্রমিকরা কৃষি কাজে পুুরুষের সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্প ও কৃষি কাজে নারীর এই অংশগ্রহণে নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলছে।

দেশে মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ। এদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। ৬৮ শতাংশ নারী কৃষি, পোল্ট্রি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কৃষি কাজে বীজ বপণ থেকে শুরু করে সার দেয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, এমনকি ফসল কাটায় নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকে আবার বাড়ির পাশে কিংবা উঠানে অনাবাদি জায়গায় শাক-সবজি, ফল-ফলাদির আবাদ করে সংসারে বাড়তি রোজগারের একটা পথ করে নিচ্ছে। এতে পরিবারের ভরণপোষণের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও তারা অনবদ্য ভূমিকা রাখছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে চা-শিল্পের মতো সমৃদ্ধ খাতের পিছনেও পাহাড়ি নারী চা শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন থেকে শুরু করে আজকে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান রয়েছে। 

২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। এ সময়ে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য খাত, পশু, হাঁস-মুরগি পালন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১১৬ শতাংশ। 

প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের কোন হিসেব নেই। এমনকি কৃষি কাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও করা হয় না।  মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়।
ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব নারীর অবদানের স্বীকৃতি আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষিতে নারী শ্রমিক বা কিষানীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামীণ নারীর শ্রম নির্ঘণ্ট শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষ যারা কাজ করছে এবং কাজ করছে না কিন্তু কাজ খুঁজছে- এমন জনগোষ্ঠীর অংশকেই শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে ১ কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান। কৃষিতে নতুন কর্মসংস্থান নতুন কাজের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেও এ খাতের গতিশীলতা, ন্যায্য মজুরি অথবা কৃষিশ্রমিকের বাজারে প্রবেশগম্যতা কিছুতেই নিশ্চিত করে না। শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের কৃষকদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতথ্য থাকলেও কিষাণীদের কোনো সংখ্যাতথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে নেই। নারী কৃষিশ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষক হিসেবে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিও শ্লথ হয়ে পড়বে। কর্মজীবী নারী সংগঠনের নেতারা কৃষিশ্রম আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে একটি শ্রম কমিশন গঠন করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে। কৃষকের অধিকার আদায়ে কৃষি শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা ও সেই সঙ্গে একটি কৃষি কমিশনও গঠন করতে হবে। তারা বলেন, কৃষি খাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টিতে, অথচ কৃষি কাজে নারীর স্বীকৃতি নেই। আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষিব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষিশ্রমিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব। তারা নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সরকারি কৃষি কর্মকান্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিক তথা কিষাণীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন।

কৃষিতে নারী শ্রমিকদের অধিকার জাতীয় জীবনে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কতগুলো আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এতে মানুষ ও নাগরিক হিসেবে নারীর সমান অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালে ঘোষিত নারীর প্রতি বিরাজমান সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের দলিল যা সংক্ষেপে সিডও সনদ নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল 'অন্ন জোগায় নারী' এ স্লোগানটি। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে নারী উন্নয়নের সামগ্রিক রূপরেখা হিসেবে  ‘বেইজিং ঘোষণা ও প্লাটফরম ফর অ্যাকশন’ গৃহীত হয়। নারী উন্নয়নের বৈশ্বিক নির্দেশিকা হিসেবে এ প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের আলোকে নিজ নিজ দেশে নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ এবং সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সব পরিমন্ডলে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করা। সেই সঙ্গে গৃহ, কর্মক্ষেত্র ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব পরিসরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং দায়দায়িত্ব সমবণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠিত করা। এরই আলোকে ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে।

দেশে প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে বৈষম্য থেকে এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর কাজের সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি আবশ্যক। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবে। এছাড়াও পোল্ট্রি খাতে নারী শ্রমিকের সংযোজন এ খাতকে আরো গতিশীল করে তুলবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিও দেখতে হবে। 

Thursday, May 15, 2014

হবিগঞ্জের বাগুনীপাড়া গ্রামের কৃষক আ. কাইয়ুম সাথী ফসলে কোটিপতি

হবিগঞ্জ: রোদ-বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে কঠোর পরিশ্রমই হলো কৃষিকর্ম। যারা আরামপ্রিয় তারা এ কাজকর্ম এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু এই কষ্টের ভেতরেও যে আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে তা অনেকেই জানেন না। যারা এই কষ্টকে ধারণ করতে পারেন তারা কখনো ব্যর্থ হন না। সফলতা তাদের কাছে ধরা দেবেই। এর উদাহরণ হবিগঞ্জ সদর

উপজেলার বাগুনীপাড়া গ্রামের কৃষক আ. কাইয়ুম। কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার বিনিময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন কৃষি খামার। সেখানে সাথী ফসলের আবাদ করে পেয়েছেন আশাতীত সাফল্য। হয়েছেন শুন্য থেকে কোটিপতি। এলাকায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার এই সফলতায় কৃষি বিপ্লব ঘটেছে বাগুনিপাড়া গ্রামে।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বাগুনীপাড়া গ্রামের মো. আ. কাইয়ুম একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেছেন মাত্র ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। পৈত্রিক জমিজমা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ২ বিঘা জমিই ছিল তার সম্বল। জীবনের প্রথম দিকে সনাতন আবাদে এই জমিগুলো থেকে তেমন একটা লাভবান হতে পারতেন না তিনি। এক সময় জমিগুলোতে লাভের জন্য আখ চাষও করেছেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। তবে ১৯৯০ সালে তার ৫ শতক জমিতে বারির রুমা প্রজাতির টমেটো আবাদ করে আশাতীত সাফল্য পান। পেয়ে যান নতুন পথের সন্ধান। সেই সময়ে ৫শতক জমির টমেটো বিক্রি থেকে তার নীট লাভ হয় ৫ হাজার টাকা। 
এই মুনাফা দেখে কৃষক আ. কাইয়ুম কুষি বিভাগের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে শুরু করেন সবজি আবাদ। তবে সনাতন পদ্ধতিতে নয়। উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগাম সবজি আবাদে মনোযোগ দেন তিনি। একই জমিতে অধিক ফলন ও সারা বছর ফসল পেতে তিনি শুরু করেন সাথী ফষলের আবাদ। 

জমিতে টেংরাবাশ ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় মাচা। পৌষ ও মাঘ মাসে আবাদ করা হয় টমেটো। ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত ফসল পাওয়া যায়। চৈত্র মাসে সেখানে লাগানো হয় বরবটি। এই ফসল পাওয়া যায় বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত। আর আষাঢ় মাসে লাগানো হয় করলা। সেখান থেকেও দীর্ঘদিন ফসল পাওয়া যায়। পাশাপাশি একই মাচায় অন্যান্য সবজি আবাদ করা হয়। 
কৃষক আ. কাইয়ুম এ বছর টমেটো বিক্রি থেকে নীট আয় করেছেন ৮ লাখ টাকা। করলা থেকে আয় এসেছে ১ লাখ টাকা। বরবটি থেকে আয় আসবে ১ লাখ টাকা। বেগুন, সীম, লাউ ও চাউল কুমড়াসহ অন্যান্য ফসল থেকে আয় আসবে আরও ২ লাখ টাকা। তার খামারে প্রতিদিন কাজ করে ১২ জন শ্রমিক। তাদেরকে দেয়া হয় দৈনিক ৩শ' টাকা। যা অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশী মজুরি। খামারে তিনি জৈবিক সার বেশী ব্যবহার করেন। পোকা মাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে ব্যবহার করেন সেক্স ফেরোমন। 
কৃষক আ. কাইয়ুম জানান, এক সময় কৃষি কাজ করতে তাকে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন আর ঋণের প্রয়োজন নেই । কষ্ট করলে যে সফলতা আসবে সেই বিশ্বাস আমার ছিল। এখন অনেক লোক আমার কাছে আসে পরামর্শের জন্য। আমি সবাইকে পরামর্শ দেই। আমার এখানে যারা কাজ করে তারাও নিজেদের জমিতে ভাল সবজি আবাদ করছে। 

কৃষির আয় থেকে আ. কাইয়ুম তার সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। তার ৪ সন্তানের সকলেই এসএসসি পাশ করেছে। একজন পড়ছে কলেজে। এই আয়ে তার বাড়ীতে দালান উঠেছে। পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া ২ বিঘা জমি বেড়ে হয়েছে ১২ বিঘা। এর ৮ বিঘাতে আবাদ হয় সবজি এবং ৪ বিঘাতে আবাদ হয় ধান। ক্রয় করেছেন ১টা ট্রাক্টর, ১টা পাওয়ার ট্রিলার, ১টা মাড়াই মেশিন, ২টা অগভীর নলকুপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। তার এই সফলতায় গ্রামের প্রায় ৩শ’ কৃষক সবজির খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি নিয়মিত কৃষি বিভাগের পরামর্শ নেন এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে থাকেন। কৃষি খামার থেকে উৎপাদিত ফসল কিনতে অনেক সময় পাইকাররা ট্রাক নিয়ে আসেন আ. কাইয়ুম এর কাছে। এছাড়াও তিনি এই ফসল বিক্রি করেন, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও বি-বাড়ীয়া জেলার সরাইলে। 

আ. কাইয়ুমের জমিতে শ্রমিকের কাজ করা বাবুল, মুরাদ ও ময়না মিয়া জানায়, তারা এখানে কাজ করে ভাল পারিশ্রমিক পায়। কাজ করার পাশাপাশি নিজেদের জমিতেও সবজি আবাদ করছে তারা। 

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ ও নিউটন অধিকারী জানান, কৃষক আ. কাইয়ুম যে কোন সমস্যা দেখা দিলে কিংবা পরামর্শের প্রয়োজন হলে তিনি তাদের কাছে আসেন। এ ব্যাপারে তাকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হয়। আ. কাইয়ুম প্রমাণ করেছেন পরিশ্রক আর বুদ্ধি থাকলে দেশেই ভাল কিছু করা সম্ভব। 

হবিগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র সোম জানান, একজন কৃষক যদি বাড়িতে থেকেই বছরে ১২ লাখ টাকা মুনাফা করতে পারে সেটি কম কথা নয়। আ. কাইয়ুম পরিশ্রম আর সাধনা করে এই পর্যায়ে এসেছেন। তাকে যদি সবাই অনুসরণ করে তাহলে দেশে বেকারত্ব হ্্রাস পাওয়ার পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

Saturday, May 10, 2014

কুমিল্লায় ঘরে ঘরে ‘সাদা সোনা’

কুমিল্লা: ভোর বেলায় চাষীরা ঘুম থেকে জেগে দেখেন ঘরের বারান্দায় এমন কি খুপরী ঘরেও সাদা ফুল ফুটে আছে। তারা ফুল ছিড়ে বিক্রি করেন। এতে নগদ টাকা আসে। এই হলো মাশরুম। মাশরুমকে কেউ বলেন ‘সাদা ফুল’, কেউ বলেন ‘সাদা সোনা’।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার খাড়াতাইয়া মাশরুম পল্লীর চাষী সাহেরা বেগম। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। স্বামী মোঃ জসিম (অব. সেনা সদস্য)। স্বামী অবসরের পর পরিবারের আর কোন আয়ের পথ না থাকায় ৩ সন্তানের লেখাপড়ার খরচসহ পরিবারের অন্যান্য খরচ চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তার পর ২০০৮ সালে কুমিল্লা মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র হতে ৩ দিনের মাশরুম চাষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তার পর তাকে সরকারিভাবে ২৫টি মাশরুমের স্পন প্যাকেট সরবরাহ করা হয়। ঐ বছর তিনি ২৫টি স্পন থেকে প্রায় ১০০টি খড়ের প্যাকেট তৈরী করেন। একই বছর তার আয় হয় ছয় হাজার  টাকা, যা দিয়ে তিনি পরবর্তী বছরের জন্য একটি ছোট মাশরুম চাষ ঘর ও খড় কিনে রাখেন। বর্তমানে তার মাসিক আয় প্রায় বিশ হাজার টাকা।

বর্তমানে খাড়াতাইয়া ও গাজীপুর মাশরুম পল্লীতে ৬০ জন মাশরুম চাষী আছেন। উক্ত পল্লী থেকে দৈনিক গড়ে ৮০-১০০ কেজি মাশরুম উৎপাদন হয়। যা প্রতি দিন বিভিন্ন ভোক্তা এসে কিনে নিয়ে যান। তাছাড়া কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন কাঁচা বাজারে, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্রতি কেজি মাশরুম ১৩০-১৫০ টাকায় পাইকারী দামে বিক্রি হয়। মাশরুম বাজারজাতকরণের জন্য মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র, কুমিল্লা সার্বিক সহযোগিতা করে আসছেন। মাশরুম চাষীরা জানান যে, সংসারের কাজ শেষে তারা আগে অলস সময় কাটাতেন। বর্তমানে তারা অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে বেশ ভাল আয় করছেন। বর্তমানে উক্ত পল্লীতে গৃহবধূ, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, স্কুল, কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা সখের বসে মাশরুম চাষ করলেও তা এখন অনেকের আয়ের উৎস। এই মাশরুমকে কৃষিবিদরা সাদা সোনা হিসেবে অবহিত করে থাকেন।

উদ্যানতত্ত্ববিদ ড. মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান যে, মাশরুমে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল ও অল্প পরিমাণ শর্করা। মাশরুমের সবজি, ভর্তা, স্যুপসহ নানান মজাদার খাবার তৈরী করা যায়।
মাশরুম ডায়াবেটিক, হৃদরোগ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, ও মরণ ব্যাধি ক্যান্সার রোগ ছাড়াও আরো অনেক রোগ প্রতিরোধ হিসাবে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

উল্লেখ্য, ২০০৭-২০০৮ অর্থ বছর থেকে এ পর্যন্ত বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র, কুমিল্লার উদ্যোগে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ৩০৫০ জন মাশরুম কেন্দ্রের প্রশিক্ষকরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমবায় প্রতিষ্ঠানে আরো প্রায় ৫০০০ জন আগ্রহী নারী পুরুষকে মাশরুম চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। বর্তমানে জেলার বুড়িচং, চান্দিনা ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ৪টি মাশরুম পল্লী রয়েছে। এসব মাশরুম পল্লীতে রয়েছে প্রায় ১৫০ জন মাশরুম চাষী। দিন দিন চাষী সংখ্যা বেড়েই চলছে।

খাড়াতাইয়া মাশরুম পল্লীর মনোয়ারা বেগম, পারভীন আক্তার, ইতি বেগম জানান, সরকারিভাবে মাশরুমের বহুবিধ গুণাগুণ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বেশি করে প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

কুমিল্লা মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্রের সহকারী মাশরুম উন্নয়ন কর্মকর্তা জনাব মোঃ গোলাম সারওয়ার ভূইঁয়া জানান, ছোট আকারে মাশরুম চাষ করলে অনায়াসে প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

তিনি আরো জানান, পারিবারিকভাবে মাশরুম চাষ করে অনায়াসে পরিবারের আমিষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তাছাড়া আমাদের দেশে জমি কমছে কিন্ত জনসংখ্যা বাড়ছে। এই বিশাল জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণে মাশরুমের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য মাশরুম চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

Thursday, May 8, 2014

দিনাজপুরে লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

দিনাজপুর: রসালো ও সুস্বাদু লিচু মানেই দিনাজপুরের লিচু। তাই দিনাজপুর লিচুর জেলা হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত। আর এই জেলার ১৩টি উপজেলাতেই লিচু চাষ বেড়ে চলছে। প্রতি বছর বাড়ছে লিচু চাষের জমির পরিমাণ। উৎপাদনের জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকায় এবার মধুমাসের ফল লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রতিটি লিচু গাছে থোকা থোকা লিচু শোভা পাচ্ছে। আর ক’দিন পরই লিচু পাকতে শুরু করবে।

দিনাজপুর হর্টিকালচার বিভাগের উপ-পরিচালক মোকলেসুর রহমান জানান, প্রতিবছর এই জেলার উৎপাদিত লিচু দেশের বিভিন্ন জেলা ও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরবরাহ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়া ও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এবার জেলায় লিচুর বাম্পার ফলন হবে। এখন পর্যন্ত জেলার লিচু বাগানে ও বসত বাড়ীতে লাগানো গাছে লিচুর ফলন ভালো দেখা যাচ্ছে। ভালো ফলনের আশায় লিচু চাষীরা পুরোদমে পরিচর্যা চালায়। চাষীদের সহযোগিতা করতে কৃষি অধিদপ্তর এবং হর্টিকালচার বিভাগ থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনোয়ারুল আলম জানান, গত ২০০৯ সালে জেলায় লিচু চাষের জমির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫শ’ হেক্টর। ২০১০ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৮০ হেক্টরে। ২০১১ সালে ১ হাজার ৯৫৬ হেক্টর এবং ২০১২ সালে ২ হাজার ৫শ’ হেক্টর এবং ২০১৩ সালে ২ হাজার ৭শ’  হেক্টর লিচু চাষ হয়। চলতি বছর ২০১৪ সালে লিচু চাষের জন্য জমির পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ২শ’ হেক্টরে বেড়ে গেছে। চলতি বছরে দিনাজপুর জেলায় ৩ হাজার ২শ’ হেক্টর জমিতে লিচু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিনাজপুরের লিচু সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় দেশব্যাপী এর চাহিদা বেশী।

দিনাজপুরের লিচুর মধ্যে চায়না থ্রী, চায়না ফোর, বেদেনা, বোম্বাই ও মাদ্রাজি উল্লেখযোগ্য। আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে এবার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জেলার সদর উপজেলার আউলিয়াপুর, মাসিমপুর, পুলহাট, সিকদারগঞ্জ, মহব্বতপুর, উলিপুর, খানপুর এলাকায় ঐতিহ্যবাহী বেদেনা লিচু চাষ উল্লেখযোগ্য। এই এলাকার মাটির কারণেই উৎপাদিত বেদেনা লিচু সুস্বাদু এবং উন্নত মানের হয়ে থাকে। অন্য এলাকার বেদেনা লিচুর চেয়ে এই এলাকার বেদেনা লিচু গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয়। হাইব্রিড জাতের লিচু চায়না টু, চায়না থ্রি, চায়না ফোর সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, বিরল, বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ীসহ জেলার ১৩টি উপজেলাতেই ব্যাপকহারে বাগান গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা অনেক  লিচুর বাগান আগাম ক্রয় করে নিয়েছে।

দিনাজপুর সদর উপজেলার উলিপুর গ্রামের আদর্শ লিচু চাষী রমজান আলী (৫০) জানান, লিচুর ফুল আসার সাথে সাথে পরিচর্যা শুরু করতে হয়। নিয়মিত স্প্রে ও সেচ দিতে হয়। রমজান আলীর ৩ একর জমি দুটি লিচু বাগান রয়েছে। ২৯৫টি লিচু গাছের মধ্যে ৮২টি রয়েছে বেদেনা লিচুর গাছ এবং দেশি ও হাইব্রিড জাতের চায়না থ্রির গাছ রয়েছে ২১৩টি।

এ দুটি বাগান তিনি ১ বছরের জন্য ব্যবসায়ীর কাছে সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। বাগানের বয়স প্রায় ১২ থেকে ১৬ বছর হবে। যত দিন যাবে লিচুর গাছে ফল বেশি ধরবে এবং দামও বাড়তে শুরু করবে। এ ছাড়াও তার বাড়ীতে ৪টি লিচুর গাছ রয়েছে এর মধ্যে একটি বেদেনা ও দুটি মাদ্রাজি ও একটি বোম্বে লিচু। এ ৪টি গাছের লিচু তার পরিবারের খাওয়া আত্মীয়-স্বজনকে দেয়া  ছাড়াও বিক্রি করা হয়।

বিরল উপজেলার মাধববাটী গ্রামের লিচু বাগানের মালিক রামকৃষ্ণ রায় জানান, এবার আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় বাম্পার লিচুর ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার দেড় একর জমিতে চায়না থ্রি লিচু বাগান রয়েছে। তার বাগানে ১৫২টি গাছ রয়েছে। চলতি বছর কিশোরগঞ্জ জেলার ব্যবসায়ী ফজল হক এক বছরের জন্য ২ লাখ টাকায় বাগানটি ক্রয় করেছে। বাগানের লিচুর গাছের বয়স ১৫ বছর চলছে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সাফায়েত হোসেন জানান, লিচু চাষে ব্যঘাত না হওয়ার লক্ষ্যে কৃষি কর্মকর্তারা চাষীদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়েছে। এর ফলে উৎপাদন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

Sunday, May 4, 2014

বরগুনার আমতলীতে স্বাবলম্বী হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার

বরগুনা: বরগুনার আমতলী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহ আলম প্রায়শই অভিযোগ করেন, গ্রাম কিংবা শহরের স্থানীয় মানুষগুলোর কাছে গেলে তাদের প্রথম তারা জিজ্ঞাসা করতো, আপনারা ‘কী দেবেন?’ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর-আইলার পর উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের মধ্যে এক ধরনের ত্রাণ নির্ভরশীলতা তৈরী হয়েছিল। ক্রমে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। সেসময়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন, অপরিকল্পিত ও অপরিমিত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ স্থানীয় মানুষের স্বভাবই পাল্টে দেয়। ফলে দুর্নামের ভাগীদার হয়েছে সাধারণ মানুষ। 

এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটাতে কৃষি, মৎস্য বিভাগ, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী, ভূমি দপ্তর, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারী সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ও আরপাঙ্গাশিয়া দু’টি ইউনিয়নে রিকল নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এনএসএস নামের একটি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা। রিকল প্রকল্পের আওতায় আসা মানুষগুলোর জীবন ও মানসিকতায় পরিবর্তনও এসেছে ব্যাপক। তারা এখন আর হাত পাতেন না। বাইরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বসে না থেকে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা নিরুপন করেন এবং নিজেদের সক্ষমতা দিয়েই তা সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন। 

রিকল প্রকল্পে উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশাখালী ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ ২৭টি সিবিও’র (কমিউনিটি বেজড অরগানাইজেশন/ উপকারভোগী সংগঠন) অন্তর্ভূক্ত হয়ে তাদের সমস্যা নিরুপন করেন ও তার সমাধানে সোস্যাল ম্যাপ তৈরী করেন। প্রতি সপ্তাহে সংগঠনের সভা ডেকে করণীয় নির্ধারণ করেন। প্রথমে তারা নিজেদের সম্পদ, সামর্থ ও সহযোগিতা দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালান। প্রয়োজনে সহায়তা নেন মূল সংস্থা এনএসএসর। সরকারী বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাসমূহের সাথে উপকারভোগী সংগঠনগুলোর (সিবিও’র) সংযোগ তৈরী করে দেয় এনএসএস। এভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তার মাধ্যমে ঐ দুই ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার এখন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ছুঁতে যাচ্ছে। 

এনএসএস’র নির্বাহী পরিচালক অ্যাড. শাহাবুদ্দিন পান্না জানান, স্থানীয় মানুষগুলোর ত্রাণ মুখোপেক্ষি মনোভাব দূর করতেই মূলত আমরা সরাসরি সহায়তা দেই না। বছরের পর বছর ত্রাণ সহায়তা দেয়া বা পাওয়া সম্ভব নয়। তাদেরকে সংকট মোকাবেলায় সক্ষম করাই আমাদের লক্ষ্য। এনএসএস ঐ জনগোষ্ঠির মধ্যে জরুরী প্রয়োজনে নলকূপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা, হাঁস-মুরগী, গবাদিপশু, সার-বীজ অর্থসহায়তা প্রভৃতি দিয়েছে ঠিকই তবে তা কারা পাবে তা বাছাই করেছে সিবিও’র সদস্যরা। এখানে নিজে না নিয়ে যার বেশী প্রয়োজন তাকে দেয়ার একটা মানসিকতা তৈরী করতে সফলতা পাওয়া গেছে। এমনকি সিবিও’র বাইরেও মানবিক কারণে সহায়তা প্রদান করছেন সদস্যরা। 

মানুষের অধিকার নিয়েও কাজ করছে ঐ সিবিওগুলো। ইতোমধ্যে খাসজমিতে ভূমিহীনদের প্রাপ্যতা ও জলমহালের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করছে তারা। জানালেন, আমতলীর পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মতিয়ার রহমান। উপজেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাড. এম এ কাদের মিয়া বলেন, রিকল প্রকল্পটি প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর মানুষদের সচেতন করেছে। আন্দোলন করতে শিখিয়েছে। তারা এখন আর বসে থাকে না। পথে নামা শিখেছে। প্রয়োজনে আমাদের মতো সামাজিক-রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরও তাদের আন্দোলনে শরিক করছে। 

আমতলীর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান খান জানান, দূযোর্গপ্রবন এলাকা হিসেবে স্থানীয়রা সবসময়েই ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করেন। আমাদের মাধ্যমে সিবিও’র সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা আপদকালীন সময়ের জন্য খাদ্যভান্ডারও তৈরী করেছেন। দূযোর্গে তৎপরতামূলক মহড়া করছেন নিয়মিত। দূর্যোগে নিজেকে রক্ষাসহ অপরকে রক্ষা করার সক্ষমতাও তাদের হয়েছে। 

আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশখালী ইউনিয়নের প্রতিটি পরিবারে এনএসএস হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরী করিয়েছে এবং এ কাজে আনুসাঙ্গিক মালামাল দিয়েছে। এটি একটি ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ। এ কারণে উপজেলার ঐ দু’টি ইউনিয়নে ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো রোগও কমে গেছে জানালেন, আমতলীর উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. একরামুল কবির। 

স্বাবলম্বীতার জন্য নিজের সক্ষমতা প্রয়োজন। আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশখালী ইউনিয়নের স্থানীয় মানুষগুলোকে এই উপলব্ধি এনে দেয়ার জন্য এনএসএস’র কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য বললেন আমতলীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ। তিনি আরও বলেন, এ কার্যক্রমে আশপাশের ইউনিয়নের লোকজনও সচেতন হচ্ছে।

মুন্সীগঞ্জের তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল পুনঃখনন না করলে অর্থনীতিতে আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে

মুন্সীগঞ্জ: বাংলাদেশের সুয়েজ খাল হিসেবে পরিচিত মুন্সীগঞ্জের তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল জৌলুসহীন হয়ে পড়ছে। নাব্যতা সঙ্কটে লঞ্চ তো দূরের কথা ছোট নৌকা চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও রাজবাড়িসহ বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও মুন্সীগঞ্জ জেলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা ও ধলেশ্বরীর সংযোগ খালটির ¯্রােতধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদী ভাঙ্গন প্রকট হচ্ছে। এই খালের মুখে লৌহজং উপজেলার ডহরী ও বড় মোকাম এলাকায় আসন্ন বর্ষায় নদী ভাঙ্গন ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। 

খালটি অচল থাকার কারণে কৃষি জমির সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত, বর্ষার পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় দু’পাশের গ্রাম ও কয়েক হাজার একর কৃষি জমি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির বিভিন্ন অংশ বেদখল হওয়াতে এর আকার ছোট হয়ে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ খালের এই নাজুক অবস্থার কারণে পরিবেশে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এতে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান, খালটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ড্রেজিং জরুরি হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিং না হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ¯্রােতধারা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এ খাল এখন দেখ-ভাল করছে বিএডিসি। 

বিএডিসির সহাকারী প্রকৌশলী (সেচ) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘খালটির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কেউ আমাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করেনি। তাই এ ব্যাপারে আমরা কিছুই করতে পারছি না। তাছাড়া খালটি বিএডিসির আওতায় কি-না তাও আমি নিশ্চিত নই। কারণ ৩০ ফুটের বেশি প্রশ্বস্ত খাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায়। 

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, ‘তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল এবং এর সাথে যুক্ত ইছামতি নদীর গুরুত্ব উল্লেখ করে এর যৌবন ফিরিয়ে আনতে সরকারকে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ  নেয়া হবে।’

টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বালিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘একদা বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের মালবাহী নৌকা ও অন্যান্য নৌযান অতি সহজে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করতো এই খাল দিয়ে। এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। বেশ কয়েক বছর ধরে এই খালে লঞ্চ বা বড় নৌকা চলাচল করতে পারছে না।  নাব্যতার অভাবে ছোট নৌকাও আটকে থাকে। 

¯্রােত না থাকায় জমিগুলোতে যথাযথ পলি আসছে না। তাই আমরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। অন্তত কৃষকের জন্য খালটি ড্রেজিং করা জরুরি।’ খালপাড়ের অন্য বাসিন্দারা জানান, ‘এই খালের ¯্রােতধারা বন্ধ হওয়ার কারণেই ধলেশ্বরী-ইছামতিও মরে যাচ্ছে। খাল মরে যাওয়ায় তালতলা থেকে বেতকা হয়ে আবদুল্লাহপুর থেকে মিরকাদিম বন্দর পর্যন্ত খর¯্রােতা ইছামতিও মরে গেছে। ১২ মাস এই নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করতো। এখন সেই লঞ্চঘাট শুকনো স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।’

এই খালের তীরে ৬টি হিমাগার স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু খালের করুণ দশায় বিপাকে পড়েছে এসব হিমাগার। এই ৬টি হিমাগার ছাড়াও ইছামতি তীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন হিমাগার ও বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানই বিপাকে পড়েছে। এই খাল ও ইছামতি নদী ঘিরে গড়ে উঠা দেশের সর্ববৃহত আলু এবং কাঁচামালের  আরত, বেতকা হাট, আবদুল্লাপুর বাজার, তালতলা বাজার, মিরকাদিম বন্দর, সুবচনী বাজার, বালিগাঁও বাজার, ডহরী বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

খালটির তীরে গড়ে উঠা ধলেশ্বরী হিমাগারের পরিচালক অভিজিৎ দাস ববি বলেন, ‘খালে পানি না থাায় আলু মৌসুমে কৃষক পানি দিতে পারে না। এই খালের দু’পাশের বিস্তীর্ণ জমিতে হাজার হাজার টন আলু ও বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু নৌ-যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় তা বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাত করতে কৃষকরা নানা বিড়ম্বনায় পড়ছেন। সাথে ক্ষতির মুখে পড়ছি হিমাগার মালিকরাও।’

নদী তীরের অনেক হাট-বাজার থেকে পণ্য রাজধানী ঢাকায় যেত এই খাল ধরে। একইভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য সহজে এসব অঞ্চলে পৌঁছতে এই খাল ব্যবহার করে। খালটি চলাচল অযোগ্য হওয়ায় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার নদীপথ ঘুরে মোহনপুর, ষাটনল, জগারিয়া পাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীতে আসতে হচ্ছে। এতে গরু-ছাগল, উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারজাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়সহ ঝুকি বেড়েছে। 

এ ছাড়াও এই খালের প্রবাহ পদ্মার সঙ্গে বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৩ সাল থেকে লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী থানার নদীভাঙন প্রবল হয়েছে। আগে এই খাল দিয়ে ধলেশ্বরী থেকে ধেয়ে আসা পানির স্রোত উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে নেমে পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা পদ্মার স্রোতকে আঘাত হানতো। ফলে পদ্মার স্রোত কিছুটা দুর্বল হয়ে মাঝ নদী দিয়ে মেঘনায় গিয়ে পড়তো। এখন শ্রীনগর-লৌহজং খালের প্রবাহ বন্ধ থাকায় আরিচা থেকে ধেয়ে আসা যমুনা ও গঙ্গার প্রবল স্রোতধারা পদ্মা দিয়ে সজোরে লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মাটিতে আঘাত হানছে। ফলে নদীভাঙন প্রবল হয়েছে। ফলে গত দেড় দশকে শ্রীনগর-লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার অনেক গ্রাম ও ইউনিয়ন পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়েছে। বহু লোক ভূমিহীন, গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। 
এই খালের প্রবাহ পদ্মার মুখে যখন বালি-পলি জমে বন্ধ হতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই তা কেটে দিলে এত বড় সর্বনাশ হতো না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানি আরিফুর রহমান। 

মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ জানান, এই খালের ¯্রােতধারা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার এই খাল রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তারা আশা করেন।