Saturday, April 19, 2014

ব্যাটের গ্রাম যশোরের নরেন্দ্রপুর : সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত

যশোর: যশোর শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অজপাড়া গাঁ নরেন্দ্রপুরের মিস্ত্রিপাড়া। এটা এখন ব্যাটের গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। শতাধিক পরিবার জড়িয়ে পড়েছে এই পেশায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন ক্রিকেটের ব্যাট তৈরিতে। অনেকেই আগে পেশায় ছুতোর ছিলেন। আর্থিক দিক থেকে  তা লাভজনক না হওয়ায় সে পেশা ছেড়ে দিয়ে তারা ব্যাট তৈরি করতে শুরু করেন। এতে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার এসেছে। তাদের দেখাদেখি অনেকে ভাগ্য ফিরাচ্ছেন এই পেশা বেছে নিয়ে। তাদের তৈরি ব্যাট পৌঁছে যাচ্ছে বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। 

প্রায় ২০ বছর আগে এ গ্রামের সঞ্জিত মজুমদার এই কাজটি শুরু করেছিলেন। খুলনার ক্রীড়াসামগ্রী ব্যবসায়ীরা তাকে এই ব্যাট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেন। সঞ্চিত নমুনা এনে কয়েকটি ব্যাট তৈরি করে দেখালেও তখনো কিছু সমস্যা ছিল। এরপর ব্যবসায়ীরা তাকে উন্নতমানের ব্যাট তৈরির কলাকৌশল শিখিয়ে দেয়। কিন্তু সঞ্জিত সে শিক্ষা ধরে রাখতে পারেনি। তবে তার কাজ দেখে অনেকেই এগিয়ে এসেছে এবং তারা কাজ শুরু করে দেয়। তারা ফলও পেয়ে যায়। এখন এই পরিবারগুলোর দৈন্যতা নেই, তারা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। 

ব্যাট প্রস্তুতকারী মো. তরিকুল ইসলাম ব জানান, আমাদের বড় সমস্যা বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ থাকলে যন্ত্র বসিয়ে কাজ করতে পারতাম। তিনি জানান, হাতে কাজ করা বেশ কঠিন। 

ছোট ব্যাট, বড় ব্যাট, ভালমানের ব্যাট তৈরি হয় এখানে। প্রকৃত সিজনে (শীতকালে) মিস্ত্রিরা কাজ করেন দিন-রাত। এখন অফ সিজন স্বাভাবিক বাজার ধরে রাখতে কাজ করছেন আর আগামী দিনের জন্য জমা করছেন প্রয়োজনীয় কাঠ সাইজ করে। তবে তাদের বাজার ধরতে হয় বাইরের জেলায়। মোবাইলে অর্ডার পেয়ে রূপদিয়া বাজারে যেয়ে ট্রাকে উঠিয়ে দিতে হয়। দামও সংগ্রহ করতে হয় এইভাবে। পুরুষদের পাশাপশি মহিলারাও কাজ করেন। রং করা, স্টিকার লাগানো, আঠা লাগানো  প্রভৃতি।

ব্যাট তৈরির কারিগরদের নানাবিধ সমস্যা আছে। চলাচলের জন্য গ্রামে এখনো ভাল রাস্তা নেই। বিদ্যুতের অভাবে মেশিনের পরিবর্তে হাতেই কাজ করতে হয় অনেক পরিবারকে। পিলার আছে তার বা বিদ্যুৎ নেই বেশিরভাগ পরিবারে।

ব্যাট নির্মাতা শাহাবুদ্দিন জানান, একেক জন ব্যাট তৈরি করে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা রোজগার করি। প্রায় ১০০’ ঘর এ পেশার সাথে যুক্ত।

হিন্দু-মুসলিম শতাধিক পরিবার কাজ করে দেশের ক্রিকেট খেলার মাঠের তরুণ-যুবকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ব্যাট। তারা যে দাম পান দোকানদাররা পান তার চেয়ে বেশি। যশোরে নেই এই ব্যাটের পাইকারি বাজার। বাজারজাতের জন্যে তাকিয়ে থাকতে হয় অন্য জেলার ক্রেতার উপর। ছোট ব্যাট প্রতিশ’ খুব বেশি হলে ৩ হাজার টাকা, সাধারণ ব্যাট প্রতিশ’ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা এবং ভাল মানের কাঠের তৈরি ব্যাট প্রতিশ’ ২০ হাজার টাকা পান তারা। তবে এর জন্য পর্যাপ্ত কাঠ কেনা, শ্রম দিয়ে তৈরি করা ছাড়াও নানাবিধ বিনিয়োগ করতে হয়। তারপরও লাভ যা থাকে তা দিযে খেয়ে পরে সঞ্চয় থাকে কিছু।

স্বপন বিশ্বাস জানান, ১০-১২ বছর যাবৎ এই কাজ করে জীবন নির্বাহ করে আসছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভাল আছি।

সমস্যা থাকা সত্ত্বেও নরেন্দ্রপুরের মিস্ত্রিপাড়ার মানুষ আনন্দেই সময় কাটান ব্যাট তৈরি করে। বছরের পর বছর তারা আপন মনে নিপূণভাবে তৈরি করছেন খেলার এই সামগ্রীটি। অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের তৈরি ব্যাট পাওয়া যাচ্ছে বলেই বৈদেশিক মূদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে না। আর সরকারি সহযোগিতা, বিদ্যুৎ সমস্যা, রাস্তার সমস্যা, বাজারজাত সমস্যা না থাকলে এটি একটি বড় শিল্পে পরিণত হতে পারে। আসতে পারে সুনাম ও অর্থ দেশের জন্য। 

No comments:

Post a Comment