অর্থনৈতিক রিপোর্টার: বিশ্বব্যাংকের 'ডুইং বিজনেস-২০২০' সূচকে সবচেয়ে ভালো করা ২০টি দেশের তালিকায় এসেছে বাংলাদেশের নাম। ৮ ধাপ এগিয়ে এবার বাংলাদেশ উঠে এসেছে ১৯০ দেশের মধ্যে ১৬৮ নম্বরে। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬ নম্বরে। তবে 'ডুয়িং বিজনেস' সূচকে আগামী বছর বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ৯৯ দেশের মধ্যে বা ডাবল ডিজিটে প্রবেশের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে 'ডুইং বিজনেস ২০২০' প্রতিবেদন প্রকাশকালে তিনি এ কথ বলেন। এ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. নজিবুর রহমান, প্রধান সমন্বয়ক (এসডিজি) আবুল কালাম আজাদ, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক ও অর্থ সচিব মো. আবদুর রউফ তালুকদার।
সালমান এফ রহমান বলেন, অতীতে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খুব সামান্যই পরিবর্তিত হয়েছে। এবার অবশ্য ৮ ধাপ এগিয়েছে। আগে কখনো এত পয়েন্ট জাম্প আমরা করতে পারিনি। এছাড়া সবচেয়ে ভালো করা ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। এটিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নতির প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে বেশি দিন হয়নি। বিশেষ করে, এ বছর আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরই এই প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে সূচকের অগ্রগতি বা অবনতি সংক্রান্ত তথ্য নথিবদ্ধ করার শেষ সময় ছিল এপ্রিল মাস। সুতরাং আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না।
সালমান এফ রহমান বলেন, গত ৩/৪ বছর ধরেই এ নিয়ে কাজ হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হচ্ছিল না। নিয়মটা হল, এপ্রিল মাসের মধ্যে প্রতি বছরের যা রিফর্মস হয়, সেই রিফর্মসের উপর ভিত্তি করে তারা অক্টোবরে ফলাফল দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিশ্ব ব্যাংক যখন র্যাংকিং শুরু করে, বাংলাদেশ খারাপ অবস্থানে ছিল।
সালমান এফ রহমান বলেন, তারপরও আমাদের প্রত্যাশা আরো বেশি ছিল। কারণ আমরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক পরিবর্তন এনেছি। তবে এই পরিবর্তনের সুফল মাঠপর্যায়ে পুরোপুরি যায়নি, কারণ মধ্যম ও নিচু সারির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা এই পরিবর্তন স¤পর্কে অবহিত হননি অথবা মানিয়ে নিতে পারেননি। আমরা এখন এই পরিবর্তনের প্রায়োগিক বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছি। যাতে সকল উপকারভোগী বাস্তবিক অর্থেই এই পরিবর্তনের সুফল পান। পামাপাশি আমরাও যেন সূচকে পূর্ণ নম্বর পাই। এছাড়া আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। যেগুলো বাস্তবায়িত হলে আমাদের অবস্থানে ব্যাপক উন্নতি হবে। কিন্তু আইন সংশোধনের কাজ সময়সাপেক্ষ কেননা এক্ষেত্রে সরকারকে সকল আংশীজনের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হয় ও তাদের উদ্বেগ ও পরামর্শ আমলে নিতে হয়।
অগ্রগতির জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ৮ ধাপ এগিয়ে এলেও আমরা মনে করব না এটা আমাদের অনেক বড় অর্জন। আমাদের লক্ষ্য আগামী বছর আমরা উল্লেখযোগ্য একটা অগ্রগতি চাই। আমরা টার্গেট করব যেন ডাবল ডিজিটে আসতে পারি।
এক প্রশ্নের জবাবে এসসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আপনি যদি প্রতিবেদনটা দেখেন, ১০টা মানদ-ের মধ্যে অন্তত ৬০টি ইস্যুতে রিপোর্ট করতে হয়। প্রতিটাকেই কিন্তু গুরুত্ব দিতে হবে। সবগুলো ক্ষেত্রেই আমাদের উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। সবাই মিলে আন্তরিকভাবে কাজ করে গেলে আরো ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একটি দেশের অর্থ-বাণিজ্যের পরিবেশ ১০টি মাপকাঠিতে তুলনা করে এই সূচক তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বুঝতে ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তথ্য। এই ১০টি মাপকাঠি হল- নতুন ব্যবসা শুরু করা, অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি পাওয়া, বিদ্যুৎ সুবিধা, সম্পত্তির নিবন্ধন, ঋণ পাওয়ার সুযোগ, সংখ্যালঘু বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা, কর পরিশোধ, বৈদেশিক বাণিজ্য, চুক্তি বাস্তবায়ন ও দেউলিয়া হওয়া ব্যবসার উন্নয়ন। সব মিলিয়ে ১০০ ভিত্তিক এই সূচকে বাংলাদেশের মোট স্কোর হয়েছে এবার ৪৫, যা গতবারের চেয়ে ৩.০৩ পয়েন্ট বেশি। গতবছর ৪১.৯৭ ছিল।
বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ১০টি মাপকাঠির মধ্যে ৬টিতেই বাংলাদেশের স্কোর গতবারের চেয়ে বেড়েছে। এর মধ্যে ঋণ পাওয়ার সুযোগে স্কোর বেড়েছে ২০ শতাংশ পয়েন্ট। ৪টি মাপকাঠিতে এবারের স্কোর গতবারের সমান। শুধু অবনতি হয়েছে দেউলিয়া হওয়া ব্যবসার উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ব্যবসা করা সহজ হয়েছে। বাংলাদেশের এতটা এগিয়ে আসার কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক বলছে, ব্যবসা শুরু করতে আগের চেয়ে খরচ কমেছে বাংলাদেশে। রাজধানী ঢাকাসহ শহর এলাকায় বিদ্যুৎ প্রাপ্তি সহজ হয়েছে। এছাড়া ঋণপ্রাপ্তির যাবতীয় তথ্য এখন সহজে, আরো বিস্তারিত আকারে পান উদ্যোক্তারা। তারপরও ব্যবসার পরিবেশে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। আফগানিন্তানের অবস্থান ১৭৩ তম। স্কোর ৪৪.১। এবারের সূচকে দেশটির অবনতি হয়েছে ৬ ধাপ।
ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষস্থানে আছে। ভারত সারা বিশ্বে ৬৩তম স্থানে আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করায় ভারতের অবস্থানের ১৪ ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া ভুটান এ সূচকের ৮৯তম (স্কোর ৬৬), নেপাল ৯৪তম (৬৩.২), শ্রীলঙ্কা ৯৯তম (৬১.৮), পাকিস্তান ১০৮তম (৬১), মালদ্বীপ ১৪৭তম (৫৩.৩), মিয়ানমার ১৬৫তম (৪৬.৮) অবস্থানে রয়েছে।
এবারের প্রতিবেদনে অর্থ-বাণিজ্যের পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড; সূচকে তাদের স্কোর ৮৬.৮। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর ও হংকং। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলো হল- ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জর্জিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে ও সুইডেন। গতবারের মত এবারও সূচকে সোমালিয়ার পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। আফ্রিকার এই দেশটির স্কোর ২০।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ডাবল-ডিজিটে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন সংস্কার ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে কো¤পানিজ অ্যাক্ট, ব্যাংক্রাপ্টসি অ্যাক্ট, আরবিট্রেশন অ্যাক্ট ও ইমারত নির্মান বিধিমালা, ইত্যাদি। এছাড়া সিকিউর্ড ট্রানজেকশন বিল প্রণয়ন, কমার্শিয়াল ডিসপিউট রিজ্যুলিউশন কোর্ট প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রিস্ক প্রোফাইল তৈরির মাধ্যমে বর্ডার কমপ্ল্যয়েন্স-এ কার্যকরি পরিদর্শন ব্যবস্থা প্রনয়ণ করতে হবে।