Friday, March 25, 2016

বিপণন বিশেষজ্ঞ এসিআই সৈয়দ আলমগীর

স্বাধীনতার পর থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া ব্যবসার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলো এদেশেরই এক কৃতি পুরুষ-সৈয়দ আলমগীর। বাজার বিশেষজ্ঞ বলে যার সুখ্যাতি ইতোমধ্যেই দেশ থেকে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভোক্তাদের চাহিদা নিরূপণসহ সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে কিভাবে স্বল্পমূল্যে তা সকলের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় তার সফল এক কিং-মেকার সৈয়দ আলমগীর। খাবার ছাড়াও যে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীতে হালাল বিশেষণ দিয়ে বাজার দখল করা যায় তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন এ্যারোমেটিক সাবানে ১০০% হালাল সাবান শ্লোগান দিয়ে। তাইতো তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘ফিলিপ কটলার।’
মার্কেটিং-এর যুগান্তকারী বইসমূহের লেখক ফিলিপ কটলারের নাম কে না শুনেছে? তার ‘প্রিন্সিপালস অব মার্কেটিং’ বইটি ‘বাইবেল অব মার্কেটিং’ হিসেবে স্বীকৃত। সারাবিশ্বের প্রত্যেক মার্কেটিং গ্রাজুয়েট ফিলিপ কটলারের নাম জানে। কারণ সারাবিশ্বের প্রায় সব মার্কেটিং শিক্ষার্থীকেই ‘প্রিন্সিপালস অব মার্কেটিং’ বইটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়তে হয়।

মার্কেটিং গুরু কটলার তার বইতে বিশ্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সফলতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। অবিশ্বাস্যভাবে বাংলাদেশের মত একটি ছোট্ট দেশের একটি দৃষ্টান্তও এই বইয়ে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ফিলিপ কটলারের প্রিন্সিপালস অব মার্কেটিং বইয়ের সর্বশেষ ১৩তম সংস্করণের ৭৬ পাতায় একটি কেসস্টাডি ‘১০০ ভাগ হালাল সাবান’-এ বাংলাদেশের নামটি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এই প্রথম কোন বাংলাদেশী বিপণন বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আলমগীর-এর নাম অন্তর্ভূক্ত হলো যিনি বর্তমানে এসিআই লিঃ এর কনজ্যুমার ব্রান্ডের নির্বাহী পরিচালক ও এসিআই সল্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। এ কেস স্টাডিটি এমন একটি বইয়ে সংযুক্ত যেটির স্বীকৃতি সারাবিশ্বে সমাদৃত এবং যেটি বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটি গর্বের বিষয়। এই বইটি সারাবিশ্বের অসংখ্য ছাত্র’র মাঝে পড়াবার কারণে সৈয়দ আলমগীর সারাবিশ্বের মার্কেটিং ও বিজনেস বিষয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছাত্র ও ব্যবসায়ীক নেতৃবৃন্দের কাছে পরিচিত হবেন। দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তাঁর জীবনের সাফল্য আর সংগ্রামের নেপথ্য কথা।

সৈয়দ আলমগীরের জন্ম নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করেন। ২০০৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব নিউ ক্যাসেল থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৭৬ সালে রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন বহুজাতিক কোম্পানি বিপিআইতে, যেটি বর্তমানে অ্যাভেনটিস নামে পরিচিত। পরবর্তী ১৬ বছর তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মদক্ষতায় অ্যাভেনটিসের বিপণন বিভাগেরও নেতৃত্ব দেন।

১৯৯২ সালে তিনি যোগ দেন যমুনা গ্র“পে মার্কেটিং ডিরেক্টর পদে। সেখানে তিনি কয়েকটি নতুন পণ্য বাজারে আনেন। তার মধ্যে পেগাসাস সুজ, যমুনা ওয়েলডিং, যমুনা নিটিং অ্যান্ড ডায়িং এবং অ্যারোমেটিক কসমেটিক। তিনিই বাংলাদেশে হালাল সাবানের প্রবক্তা। সাবানও যে ১০০ ভাগ হালাল হতে পারে এই  শ্লোগান নিয়ে অ্যারোমেটিক সাবান পায় আকাশছোঁয়া সাফল্য।

১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তিনি যোগ দেন এসিআই শিল্পগোষ্ঠীর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডের প্রধান হিসেবে। এসিআইতে যোগ দেওয়া সম্পর্কে সৈয়দ আলমগীর বলেন, আমি যখন এসিআইতে যোগ দিই তখন এসিআই অ্যারোসল ও স্যাভলন ছাড়া অন্য কোনো পণ্য ছিলো না। তখন এটি ছিলো একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি। কোম্পানির শেয়ারও কম ছিলো। রেকিট অ্যান্ড কোলম্যান কোম্পানির কাছে মার খাচ্ছিলো এসিআই। কিন্তু, এটি ভালো কোম্পানি ছিলো। বাজারে সুনাম ছিলো। ভালো পণ্য ও ভালো টিম ছিলো না। এখানে এসে ভালো টিম করতে আমাকে অনেক চিন্তা করতে হয়েছে।

বর্তমানে এসিআই একটি কনজ্যুমার সামগ্রী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এটিকে বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে আসতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে ইউকে বেসড মাল্টিন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি আইসিআই, বাংলাদেশে আইসিআই বাংলাদেশ মেনুফ্যাকচারিং লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯২ সালে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বা সংক্ষেপে এসিআই লিমিটেড হয়। পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে ক্রেতা সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দেশের অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান। মোট ২৯ ধরনের ব্যবসা রয়েছে এসিআইয়ের। এসব ব্যবসা পরিচালিত হয় ফার্মাসিউটিক্যালস, অ্যাগ্রো, কনজ্যুমার ব্র্যান্ড এবং ডিস্ট্রিবিউটর এই চার ভাগে। এসিআই সবসময় কোয়ালিটি, কাস্টমার ফোকাস, ইনোভেশন, ফেয়ারনেস, ট্রান্সপারেন্সি, কন্টিনিউয়াস ইমপ্র“ভমেন্ট; এই ছয়টি নীতি মেনে চলে। আমাদের ভিশন হলো মূল্যবোধ, দক্ষতা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা। সে কারণে আমরা মানুষের জন্য কল্যাণকর ব্যবসাগুলোতেই যাই। এতে আমাদের ব্যবসায়িক সাফল্য আসছে। বর্তমানে এসিআই অত্যন্ত লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। মান ও দায়বদ্ধতার দিক থেকে বিদেশি কোম্পানির চেয়ে পিছিয়ে নেই দেশীয় বহুজাতিক এসিআই। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে এসিআইয়ের মোটেও অসুবিধা হয় না।

এসিআইয়ের বর্তমান অবস্থা এবং সাফল্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৈয়দ আলমগীর বলেন, এসিআই বহুজাতিক কোম্পানি আইসিআইয়ের স্থানীয় রূপান্তর। এক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানির বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা ঐতিহ্যগতভাবে ধারণ করে তা মেনে চলি। একটি সমাজসচেতন কোম্পানি হিসেবে আমাদের কার্যক্রমের কোথাও যাতে দুর্নীতি না হয়, সেদিকে আমরা খেয়াল রাখি। তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম সারা বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পগ্র“প নিয়ে একটি জরিপ করেছে। সেই জরিপে এসিআই এখন বিশ্বের ১০০ শীর্ষ  উদীয়মান কোম্পানির একটি। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল সম্মান। তিনি বলেন, এসিআই অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এসিআইতে এখন কাজ করছে ৭ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। আগামিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শিল্পবান্ধব পরিবেশ থাকলে এসিআই আরও অনেক লোকের কর্মসংস্থান করবে।

তিনি বলেন, এসিআইতে যোগ দেওয়ার পর আনলাম কোলগেট, এসিআই মশার কয়েল, গোদরেজ, ডাবর, টেটলি চা, এসিআই লবণ, আটা, ভোজ্য তেল, চিনি, মসলা, খাদ্যশস্য ও দুধজাত পণ্য। তিনি বলেন, যমুনা গ্র“পে হালাল শব্দটি যোগ করলেও এসিআই পণ্যে ‘পিওর’ শব্দটি যোগ করেছি। ভেজালের ভিড়ে আমি পিওর বা খাঁটি শব্দটি নির্বাচন করেছি। এতে সাফল্যও এসেছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, পণ্য বাজারজাত করতে চটকদার বিজ্ঞাপনে আমি বিশ্বাসী নই। বিজ্ঞাপন তো থাকবেই, একইসঙ্গে পণ্যের গুণগত মানও ঠিক রাখতে হবে। এ ছাড়া কেউ বাজারে টিকতে পারবে না। সৈয়দ আলমগীর বলেন, আগে বাজারে ভালোমানের লবণ ছিলো না। তাই আনলাম এসিআই লবণ। এর শ্লোাগান এসিআই লবণ মেধা বিকাশে সাহায্য করে। নতুন প্রতিটি পণ্যেই আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। 

এসিআই’র সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) নানা কাজে এসিআইয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। তবে সঠিকভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স দেয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বড় সিএসআর। আমরা যদি ভ্যাট-ট্যাক্স ঠিকমত দিই, তাহলে সরকারই জনকল্যাণকর কাজগুলো ভালোভাবে করতে পারবে। এছাড়া ব্যবসার নিট লাভ থেকে নতুন একটি কারখানা খোলা হলে আরও এক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এটিও সামাজিক দায়িত্বশীলতার অংশ। আমরা এ ধরনের দায়বদ্ধতায় বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে তিনি গত বছর ঘটে যাওয়া সাভারের রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন সে সময় আমরা আমাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি হতাহতদের পাশে দাঁড়াতে।

হালাল সাবানের ধারণা প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৯৫ সালে তিনি ১০০ ভাগ হালাল সাবানের ধারনাটি প্রবর্তন করেন। অ্যারোমেটিক হালাল সাবানটি ১০০ ভাগ ভেজিটেবল ফ্যাট থেকে প্রস্ততকৃত এবং কোনপ্রকার পশুচর্বি ছাড়াই তৈরি-যা হিন্দু ও মুসলিম ক্রেতাসাধারনের কাছে গৃহীত হয়। অসংখ্য সফলতার মধ্যে তার ১০০ ভাগ হালাল সাবানের প্রস্তাবনাটি সবার কাছে গৃহীত হয় এবং প্রথম বছরেই ১৪ ভাগ মার্কেট শেয়ার দখল করে যেটি আসলেই একটি চমৎকার সাফল্য। অতঃপর অন্যান্য সাবান প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও দাবি করতে থাকে যে তাদের সাবানেও কোন পশুচর্বি নেই। কোন বিষয়টি তাকে হালাল সাবানের ধারনাটি তৈরি করতে সহায়তা করেছে জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর জানান, প্রথমত প্রয়োজন থেকেই ধারণাটি মাথায় আসে। গণমানুষের প্রয়োজন, চাহিদা। আমার মনে সব ভালো ধারণাগুলি এই জায়গাটি থেকেই প্রোথিত। তিনি বিশ্বাস করেন বিশ্বাস তৈরি হয় সততা থেকে। বিশ্বাস হলো সম্পর্কের ভিত্তি। অসততা বিশ্বাসকে ভেঙ্গে ফেলে এবং ভোক্তাগনের সাথে সম্পর্কটি তার ভিত্তি হারায়।

এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘৯৫ সালে আমি যখন অ্যারোমেটিক সাবানে শতভাগ হালাল ধারণাটি প্রবর্তন করলাম, তখন প্রাথমিকভাবে অনেকেই এটিকে সন্দেহের চোখে দেখে। কারণ হালাল শব্দটি শুধুমাত্র খাবারের বেলায়ই প্রযোজ্য হয়ে থাকে। সেই শ্লোগান সাবান বা অন্য কিছুতে ব্যবহৃত হলে তা কি ভোক্তারা গ্রহণ করবে? অনেকেই এই শ্লোগান ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে থাকেন। আমিও আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকি। একপর্যায়ে দেখা যায় ভোক্তারা আইডিয়াটি গ্রহণ করেছে এবং পরবর্তী সময়ে এটি সফল মার্কেটিং উদ্যোগ হিসেবে পরিচিতিও পেয়েছে। বিপণনের ক্ষেত্রে অবশ্যই সহজ সূত্রে বিশ্বাসী হতে হবে। বাজার সম্পর্কে জানতে হবে। বাজারে যেতে হবে, মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের প্রয়োজন বুঝতে হবে। আমি এখনও নিয়মিত বাজারে যাই। 

তার মতে, বাজারে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে ভোগ্যপণ্য    প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে সৃজনশীল ও ভোক্তামুখী বিপণন কৌশল নিয়ে এগোতে হবে। কোম্পানির খরচ কমানো ও পণ্যের দাম বাড়ানোর গতানুগতিক পথে না গিয়ে পণ্যের চাহিদা ও বিক্রি বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। একবারে মোটা অঙ্কের লাভ করার মানসিকতা নিয়ে কখনও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সফলতা পাওয়া যায় না। একজন উৎপাদককে অবশ্যই ভোক্তার ‘নিড গ্যাপ’ (প্রত্যাশিত চাহিদা) খুঁজে বের করতে হবে। সেই নিড গ্যাপের সমাধান দিতে হবে মানসম্মত পণ্য দিয়ে। একজন সফল বিপণনকর্মীকে নিত্যনতুন ধারণা ও ভোক্তার মনস্তত্ত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করতে হয়। উদ্ভাবনী কৌশলের মাধ্যমে ব্র্যান্ডের অবস্থান সুদৃঢ় এবং সরবরাহ ব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়ে পণ্য আরও বেশি মানুষের নাগালে পৌঁছে দেয়ার কৌশল অবলম্বন করতে হয়।

ব্র্যান্ডিংয়ে সাফল্য অর্জনের উপায় বলতে গিয়ে সৈয়দ আলমগীর মানচিত্রকে আরো বলেন, ইউর সলিউশন নিড টু বি বেস অন ফ্যাক্ট, নিড টু বি বেস অন ট্রু। ভোক্তারা পণ্যের সুনাম শোনার পর ব্যবহার করেও যখন এর প্রমাণ পাবে, তখনই প্রকৃত ব্র্যান্ডিং হয়ে যায়। শুধু ব্যাপক বিজ্ঞাপন দিলেই ব্র্যান্ডিং হয় না। ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কোয়ালিটি, অ্যাপিয়ারেন্স, ব্র্যান্ড নেম, প্রাইস ইত্যাদি মূল উপাদানগুলো কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে হয়। এছাড়া বাংলাদেশে ব্র্যান্ডিংয়ের অবারিত সুযোগ আছে। আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে একটি ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে ১৫ থেকে ২০ বছর লেগে যায়, সঙ্গে প্রচুর বিনিয়োগ। কিন্তু আমাদের দেশে ভালোভাবে করলে পাঁচ বছরেই একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের ছেলেরা ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহারে উৎসাহী হচ্ছে। প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে আমরা একটা ব্র্যান্ড প্রমিজ দিয়ে থাকি। প্রমিজগুলো হতে হবে নির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত, পরিমাপযোগ্য, গণনাযোগ্য এবং অর্জনযোগ্য।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সৈয়দ আলমগীর বলেন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ বলা যাবে না। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংকের অতিরিক্ত সুদের হার অর্থনীতির প্রধান তিন সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই সমস্যাগুলো আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। এখন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য ভালো, মূল্যস্ফীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। ব্যাংকের সুদের হার এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি তবে মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে আছে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়ছে, তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বে একটি সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে বৈদেশিক সহায়তা বেড়েছে। প্রত্যাশার চাইতেও বেশি হারে রেমিট্যান্স আসছে দেশে। এছাড়া আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণও কম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সঠিক পদক্ষেপের অভাব এবং দক্ষতাগত সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছি না আমরা। তবে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রয়েছে।

সৈয়দ আলমগীর বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সঙ্কটের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব খারাপ নেই। দেশে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এই ধারা আগামিতেও অব্যাহত থাকবে বলেই বিশ্বাস করেন সৈয়দ আলমগীর। তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্প আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি। বিদেশি মুদ্রা অর্জনেরও এটি বড় খাত। এই শিল্পটি অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। ছেলে-মেয়েরা গার্মেন্টে কাজ করছে। তারা অর্থনীতিতে অনেক বড় অবদান রাখছে। ‘তৈরি পোশাকখাতে জিএসপি সুবিধা বন্ধ করায় অর্থনীতির কোনোই ক্ষতি হবে না’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা পোশাকখাতে যে জিএসপি সুবিধা পাই, তাতে খুব একটা লাভ হয় না। কারণ, ক্রেতারা জিএসপি সুবিধার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন হিসেবে আদায় করে নেয়। সৈয়দ আলমগীর বলেন, ডলারের রিজার্ভ সন্তোষজনক। বিনিময় হারও ভালো। তাই আমাদের অর্থনীতি ভালো অবস্থানেই রয়েছে।

দেশের উন্নয়নের জন্য ভালো অবকাঠামো প্রয়োজন। অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে দেশ এমনিতেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সরকার যদি রাস্তাঘাট, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ এমনিতেই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের শিল্পকারখানা রাজধানীকেন্দ্রিক। এ-কারণেই রাজধানী ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। শিল্পকারখানাকে ঢাকার বাইরে সরিয়ে ফেলতে হবে। এজন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পজোন তৈরি করে, ঢাকার সাথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। রাস্তাঘাট তৈরি করে ধীরে ধীরে শিল্পকারখানাগুলো সেখানে সরিয়ে নিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুললেই হবে না। এর সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থাও করতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যবস্থাও রাজধানীকেন্দ্রিক।     সন্তানের লেখাপড়া, স্বাস্থ্যসেবা এবং সহজে অন্যান্য নাগরিক সুবিধা হাতের নাগালে পাওয়ার কারণেই সবাই ঢাকায় থাকতে চান। ঢাকার বাইরে এগুলো হাতের কাছে নিয়ে আসতে পারলে কেউ আর ঢাকায় থাকতে চাইবে না। সরকারকে এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সৈয়দ আলমগীর বলেন, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের নগরমুখিতা কমাতে হবে। গ্রামাঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কাজের সন্ধানে মানুষের ঢাকায় আসা কমে যাবে।

বেসরকারি কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে বেসরকারি কোম্পাানিগুলোর উৎপাদন কমে গেছে। এতে কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। প্রতিকূল অবস্থার কারণে অনেকেই নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। ইউটিলিটি সাপোর্ট পেলে উৎপাদকরা যেমন উৎপাদনে আগ্রহী হতো। এতে নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠত, দেশ লাভবান এবং সমৃদ্ধ হতো। সৈয়দ আলমগীর’র মতে এ থেকে উত্তরণ পেতে হলে সরকারকে শিল্পবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নইলে দেশে কোনোদিনই শিল্প বিকাশ হবে না।

সৈয়দ আলমগীর’র মতে, কৃষির ওপর সরকারকে জোর দিতে হবে। এখাতের সমস্যাগুলো সমাধানে নিতে হবে জরুরি পদক্ষেপ। কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ালে আগামিতে এখাতই হতে পারে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। সেই অনুপাতে রফতানি খুবই কম। রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় ডলারের ওপর চাপ পড়ছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে ডলারের দাম ক্রমেই হচ্ছে ঊর্ধ্বমুখি। তিনি বলেন, সরকার অনেক অনাবশ্যক খরচ বাড়িয়েছে। অনুৎপাদনশীল খাতে খরচের বিষয়ে সরকারকে আরো সংযত হবে। এখন এই অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হলে সরকারকে মিতব্যয়ী হতে হবে। কমিয়ে ফেলতে হবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়। তিনি বলেন, রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। রেমিটেন্স বাড়ানোর প্রতি জোর দিতে হবে। নইলে মূল্যস্ফীতি বাড়তেই থাকবে। 

রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে তিনি বলেন, যেসব দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, সে দেশগুলো সামনের দিকে এগুতে পারছে না। বাংলাদেশও এখন রাজনৈতিক সংকটের দিকেই যাচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে। ‘দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচবো’-এই কথাটি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মনে রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়ন ও স্বার্থের কথা চিন্তা করে বড় দুই দলকেই সহনশীল হতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। সৈয়দ আলমগীর বলেন, একশ্রেণীর মানুষ দেশে বিদেশে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাই সরকারকে প্রমাণ করতে হবে তাদের অপপ্রচার সঠিক নয়।

কর্মজীবনের বাইরে সৈয়দ আলমগীর বিপণন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেন। এছাড়া অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতেও পড়িয়ে থাকেন। পেশাগত কাজের বাইরে তিনি তার এলাকায় নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। সৈয়দ আলমগীরের প্রত্যেক ভাই-বোন উচ্চশিক্ষিত। প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত। তার পিতা সৈয়দ নবীনেওয়াজ ১৯১৯ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। তিনি এলাকার প্রথম শিক্ষিত মুসলমান।

সৈয়দ আলমগীর তিন কন্যা সন্তানের জনক। প্রথম কন্যা জিনিয়া জাফরিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে মেডিসিনে এমআরসিপি ও এফআরসিএস দুটোরই সেকেণ্ড পার্ট পরীক্ষার প্রস্তুতিতে রয়েছেন। মেজ মেয়ে অনিয়া আফরিন কানাডায় মাস্টার্স শেষ করে সেখানে রজার্স-এর চাকরি করছেন। ছোট মেয়ে রাইসা অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে দন্তবিষয়ক বিষয়ে অধ্যয়নরত। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি অত্যন্ত সুখী একজন মানুষ।

ফিলিপ কটলারের বইতে বাংলাদেশী দৃষ্টান্ত

মার্কেটিং যুগান্তকারী বইসমূহের লেখক ফিলিপ কটলারের নাম কে না শুনেছে? তার প্রিন্সিপালস অব মার্কেটিং বইটি “বাইবেল অব মার্কেটিং” হিসেবে স্বীকৃত। এটি বিস্ময়কর কোন ঘটনা নয় যে সারাবিশ্বের প্রত্যেক মার্কেটিং গ্রাজুয়েট ফিলিপ কটলারের নাম জানে। কারন সারাবিশ্বের প্রায় সব মার্কেটিং শিক্ষাথীদেরকেই প্রিন্সিপালস অব মার্কেটিং বইটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়তে হয়।

মার্কেটিং গুরু কটলার তার বইতে বিশ্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সফলতার দৃষ্টান্তসমূহ উল্লেখ করেছেন। অবিশ্বাস্যভাবে বাংলাদেশের মত একটি ছোট্ট দেশের একটি দৃষ্টান্ত ও এই বইয়ে অন্তভুক্ত হয়েছে। ফিলিপ কটলারের প্রিন্সিপালস অব মার্কেটিং বইয়ের সর্বশেষ ১৩তম সংস্করনের ৭৬ পাতায় একটি কেসস্টাডি “১০০ ভাগ হালাল সাবান” এ বাংলাদেশের নামটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই প্রথম কোন বাংলাদেশী, বিপনন বিশেষজ্ঞ জনাব সৈয়দ আলমগীর এর নাম অন্তর্ভক্ত হলো যিনি যমুনা গ্র“পের পরিচালক ও এসিআই লিঃ এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। এ কেস স্টাডিটি এমন একটি বইয়ে সংযুক্ত যেটির স্বীকৃতি সারাবিশ্বে সমাদৃত এবং যেটি বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় একটি গর্বের বিষয়। এই বইটি সারাবিশ্বের অসংখ্য ছাত্রদের মাঝে পড়াবার কারনে জনাব আলমগীর সারাবিশ্বের মাকেৃটিং ও বিজনেস বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছাত্র ও ব্যবসায়ীক নেতৃবৃন্দেও কাছে পরিচিত হবেন।১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারী তিনি যমুনা গ্র“পে গ্র“প মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। 

তিনি যমুনা গ্র“পের বিদ্যমান নতুন উন্মোচিত পেগাসাস সু, যমনা ওয়েল্ডিং ইলেকট্রনিক্স, এরোমেটিক কসমেটিকস লিঃ, যমনা ডাইং এ্যান্ড নিটিং লিঃ সহ ৭টি কোম্পানীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি ১০০ ভাগ হালাল সাবানের ধারনাটি প্রবর্তন করেন। অ্যারোমেটিক হালাল সাবানটি ১০০ ভাগ ভেজিটেবল ফ্যাট থেকে প্রস্ততকৃত এবং কোন প্রকার পশুচর্বি ছাড়াই তৈরী যা হিন্দু ও মুসলিম ক্রেতাসাধারনের কাছে গৃহীত হয়। অসংখ্য সফলতার মধ্যে তার ১০০ ভাগ হালাল সাবানের প্রস্তাবনাটি সবার কাছে গৃহীত হয় এবং প্রথম বছরেই ১৪ ভাগ মার্কেট শেয়ার দখল করে যেটি আসলেই একটি চমৎকার সাফল্য। অতঃপর অনান্য সাবান প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও দাবী করতে থাকে যে তাদের সাবানেও কোন পশুচর্বি নেই।

সৈয়দ আলমগীর জন্মেছেন নেত্রকোনার কেন্দুয়াতে। পড়াশোনা করেছেন কেন্দুয়ার জেএইচসি ইন্সটিটিউশনে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৭৫ সালে আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। 

তিনি অতঃপর বিপিআই (বর্তমানে অ্যাভেন্টিস) তে যোগদান করেন এবং বিভিন্ন ব্যবস্থাপকের পদসমূতে অসীন ছিলেন। এরপর তিনি এফএমসিজি সেক্টরেই তার ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারী তিনি যমুনা গ্র“পে গ্র“প মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যমুনা গ্র“পের বিদ্যমান নতুন উন্মোচিত পেগাসাস সু, যমনা ওয়েল্ডিং ইলেকট্রনিক্স, এরোমেটিক কসমেটিকস লিঃ, যমনা ডাইং এ্যান্ড নিটিং লিঃ সহ ৭টি কোম্পানীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। অসংখ্য সফলতার মধ্যে তার ১০০ ভাগ হালাল সাবানের প্রস্তাবনাটি সবার কাছে গৃহীত হয় এবং আসলেই একটি চমৎকার সাফল্য। 

ধারনাটির প্রবক্তা সৈয়দ আলমগীর এক আলাপচারিতায় জানাচ্ছিলেন কিভাবে তার মাথায় হালাল সাবানের ধারনাটি আসে। কোন বিষয়টি তাকে হালাল সাবানের ধারনাটি তৈরী করতে সহায়তা করেছে জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর জানান, প্রথমত প্রয়োজন থেকেই ধারণাটি মাথায় আসে। গনমানুষের প্রয়োজন, চাহিদা। আমার মনে সব ভালো ধারণাগুলি এই জায়গাটি থেকেই প্রোথিত। তিনি বিশ্বাস করেন বিশ্বাস তৈরী হয় সততা থেকে। বিশ্বাস হলো সম্পর্কের ভিত্তি। অসততা বিশ্বাসকে ভেঙ্গে ফেলে এবং ভোক্তাগনের সাথে সম্পর্কটি তার ভিত্তি হাবায়। 

তার আরেকটি অর্জন হচ্ছে এসিআই সাবানের প্রস্তাবনাটি যেটি ২০০৮ সালে “বেস্ট ফুড এ্যান্ড বেভারেজ ব্র্যান্ড” এর স্বীকৃতি লাভ করে। তিনি উল্লেখ করেন এসিআই লবণে মেধাশক্তি বৃদ্বি পায় এবং এসিআই একটি মেধাবী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। 

সৈয়দ আলমগীর একজন পরিপূর্ন মানুষ হতে চেস্টা করেন। জ্ঞান আহরনের প্রতি তার শ্রদ্ধা অপরিসমীম। তিনি বিশ্বাস করেন শুধুমাত্র জ্ঞানই পারে সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দিতে। 

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে জনাব আলমগীর বলেন, যেকোন আইডিয়াই একটি চমৎকার আইডিয়া এবং জীবন অনেক ছোট একেকটি আইডিয়া প্রমাণের জন্য। সুতরাং চেস্টা করতে দোষ কী!

বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামো জরুরি

বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল। এই সুযোগে সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আনতে খুবই আন্তরিক। কিন্তু, বিদেশি বিনিয়োগ সেই তুলনায় বাড়ছে না। অবকাঠামো তৈরি করতে না পারলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে না। অবকাঠামো তৈরি করা খুবই জরুরি। তাই সরকারকে আগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র খুব শিগগিরই আমুল পাল্টে যাবে। 

এসিআই-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আলমগীর এ অভিমত দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে রিটেইলিং বা বিপণন ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছেন। ঈর্ষণীয় স্থানে নিয়ে গেছেন বিপণনকে। 

একটি শ্লোগানই কোনো পণ্যকে মার্কেট লিডারে পরিণত করতে পারে, বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই তা প্রমাণ করেছেন। প্রায় দুই দশক আগে তিনি সৃষ্টি করেন এক কালজীয় স্লোগান, ‘একশ ভাগ হালাল’। এই স্লোগান দিয়ে তিনি দেশে হৈ চৈ ফেলে দেন। আলোচিত এই স্লোগানই অ্যারোমেটিক সাবান অন্যসব নামি ব্রান্ডের সাবানগুলোকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। স্লোগানটির কারণেই তখন অ্যারোমেটিক সাবান মার্কেট লিডারে পরিণত হয়। তার এই সাফল্যের কারণেই তাকে বাংলাদেশের ফিলিপ কটলার বলা হয়। অবশ্য ফিলিপ কটলারও তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ফিলিপ কটলার তার সর্বশেষ গ্রন্থের একটি চ্যাপ্টারে সৈয়দ আলমগীরের সাফল্য এবং তার কার্যক্রম নিয়ে লিখেছেন। 

সম্প্রতি সৈয়দ আলমগীর এসিআইর তেজগাঁও কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি, অবকাঠামো, উন্নয়ন-অগ্রগতি এবং সম্ভাবনা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডি ডটকম-এর প্ল্যানিং এডিটর আহমেদ রাজু। 

সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘দেশে আপাতত কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। তাই অর্থনীতি যেভাবে এগোনোর কথা, সেভাবে এগোচ্ছে না। সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিনিয়োগ বাড়ছে না। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন তা নেই। তাই বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না।’ 

তবে সরকার যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে- তা খুবই আশাব্যঞ্জক বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘দেশে অনেক সংকট আছে। তার মধ্যেও আমাদের অর্থনীতি খুব একটা খারাপ নেই। দেশে অনেক উন্নয়নকাজ হচ্ছে। উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামীতেও এটি অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।’ 

তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির প্রধান শক্তি হচ্ছে- গার্মেন্টস শিল্প। এই খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা আয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অর্থনীতির চাকা এই শিল্পটি-চালু রেখেছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা কাজ করছে গার্মেন্টে। অর্থনীতির চাকা তারাই চালু রেখেছে। তারাই বড় অবদান রাখছে অর্থনীতিতে।’ 

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা চালু করার কথা ভাবছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জিএসপি সুবিধায় আমাদের খুব একটা লাভ হয় না। কারণ, জিএসপি সুবিধার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন হিসেবে আদায় করে নেয় ক্রেতারা। তাই জিএসপি সুবিধা বন্ধ করায় বাংলাদেশের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তারপরও এই সুবিধা চালু হলে ভালো।’

ডলারের রিজার্ভ নিয়ে সন্তষ্টি প্রকাশ করেন সৈয়দ আলমগীর। তবে বিনিময় হার নিয়েও তিনি তেমন অসন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, ‘ডলারের দাম কমায় যারা শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করেন, তাদের জন্য ভালো। কিন্তু যারা বিদেশে পণ্য রপ্তানি করছেন, তারা একটু অসুবিধায় আছেন। অন্যদিকে বিদেশ থেকে যারা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন-তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তার পরও আমাদের অর্থনীতি অনেক ভালো অবস্থানেই রয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘একটি দেশের œয়নের জন্য প্রয়োজন ভালো অবকাঠামো। ভালো অবকাঠামো করতে পারলে একটি দেশ এমনিতেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আগামীতে সরকার দেশের ভেতর দিয়ে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা। তখন দেশ এমনিতেই এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।’ 

তিনি বলেন, ‘রাজধানীকে কেন্দ্র করেই দেশের বেশিরভাগ শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। তাই সবাই রাজধানীতেই থাকতে চান। ফলে রাজধানীর লোকসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে ঢাকা দিনদিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে, নগরীর ভেতর এবং আশপাশ থেকে শিল্পকারখানা বাইরে সরিয়ে ফেলতে হবে। এজন্য নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।’ 

তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম শিল্পজোন তৈরি করতে হবে। তার আগে সেখানে গড়ে তুলতে হবে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাস্তাঘাট তৈরি করে শিল্পকারখানা সেখানে ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলতে হবে।’ 

সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও সেখানে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকার বাইরে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। ভালো স্বাস্থ্যসেবা, সন্তানের লেখাপড়া এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধা পাওয়ার কারণেই সবাই ঢাকায় থাকতে চান। ঢাকার বাইরে এগুলো মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে, কেউ ঢাকায় থাকতে চাইবেন না। তাই সরকারকে এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘এখন কাজের সন্ধানে মানুষ প্রতিদিন ঢাকায় আসছে। কারণ, গ্রামে কাজ নেই। গ্রামে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। এতে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ফলে মানুষ আর কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসবে না। একই সঙ্গে উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।’ 

সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ এসিআই পণ্য ব্যবহার করছেন। যমুনা গ্রুপে আমি যখন ছিলাম তখন হালাল সাবান বাজারে নিয়ে এসেছিলাম। সেই সাবান দেশের কোটি কোটি মানুষ ব্যবহার করেছেন।’ 

সৈয়দ আলমগীর এখন আটা-ময়দা, লবণ, কয়েল এবং খাদ্য সামগ্রী নিয়ে কাজ করছেন। এগুলোও দেশের ঘরে ঘরে ব্যবহার হচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘এসিআই অ্যারোসল মার্কেটের ৮৬ শতাংশ এবং স্যাভলন ৮০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার দখল করে আছে। গুণগত মানের কারণেই এসিআই লবণ পরপর তিনবার সেরা ব্র্যান্ড হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে। 

‘এসিআই পণ্যের গুণগত মান এবং প্যাকিং প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানের।’ পণ্যের বাজারজাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে যেসব পণ্য ব্যবহার করতে পারব, আমি সে পণ্যই ক্রেতাদের দিতে চাই।’ পণ্যের মূল্য নির্ধারণেও ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি তারা মাথায় রাখেন বলে জানান তিনি। ক্রেতারা সাধ্যমতো যেন পণ্য কিনতে পারেন, সে দিকটি মাথায় রাখেন তারা। 

সৈয়দ আলমগীর জানান, কিছুদিন আগে বিপণন নিয়ে ভারতের মুম্বাই শহরে এশিয়ান রিটেইলিং কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিশ্বের ৪০টি দেশের আড়াইশ’ প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। কংগ্রেসে তাকে বাংলাদেশের বেস্ট রিটেইলিং লিডার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। 

মার্কেটিংয়ের গুরু ফিলিপ কটলার তার সর্বশেষ গ্রন্থ প্রিন্সিপ্যাল অব মার্কেটিং-এ সৈয়দ আলমগীরের কার্যক্রম এবং তার সৃষ্ট একশ’ ভাগ হালাল স্লোগানটা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বাংলাদেশে বিপণনে সৈয়দ আলমগীরের অসামান্য সাফল্য হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন তার গ্রন্থে। তিনি ল্লেখ করেছেন, ‘শুধু একটি মাত্র স্লোগান কীভাবে একটি পণ্যকে বিক্রির শীর্ষে নিয়ে যায়। বিশ্বের লাখ লাখ বিপণনের ছাত্রছাত্রী সৈয়দ আলমগীরের সাফল্য সম্পর্কে পড়বে।’

সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘এসিআই কিছু মূল্যবোধ মেনে চলে। কারণ তারা মনে করে, যেসব মানুষের কোনো মুল্যবোধ নেই, তাদের কোনো মূল্য নেই। এসিআইয়ের প্রত্যেক কর্মকর্তার টেবিলে একটি কিউবেটর আছে। তাতে মূল্যবোধগুলো লেখা আছে। মূলবোধগুলো হচ্ছে-স্বচ্ছতা, আদর্শ, সঠিক ওজন, সঠিকমূল্য এবং গুণগত মান। এই মূল্যবোধের মাধ্যমে এসিআইয়ের প্রত্যেকটি কর্মী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলে তিনি জানান। 

বাংলাদেশ নিয়ে খুবই আশাবাদী সৈয়দ আলমগীর। তার মতে বাংলাদেশের মানুষ খুব বুদ্ধিমান। চরম বিপদেও ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের মানুষ। তার দাবি-বিশ্বের কোথাও এটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। 

কর্মবীর এই মানুষটি আগামীতে দেশের মানুষের কল্যাণে আরো অনেক বড় কাজ করতে চান। মানুষের কাছাকাছি গিয়ে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিতে চান। মানুষের সেবা করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনে কাজ করতে চান। 

No comments:

Post a Comment