Sunday, April 27, 2014

আমজাদ খানের ব্যতিক্রমী তরমুজ চাষ

হবিগঞ্জ: বাইরে সবুজ আর ভিতরে লাল টকটকে এবং  রসে টুই টুম্বুর যে ফলটি আমাদের কাছে পরিচিত তার নাম ‘তরমুজ’। গরমকালে সুমিষ্ট এই ফলের ব্যাপক চাহিদা। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি এই ফলের রয়েছে ঔষধীগুণ। কিন্তু প্রচলিত এই তরমুজের বাইরে রং-বেরঙের আর সুস্বাদু তরমুজ চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন হবিগঞ্জের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক আমজাদ হোসেন খান। 

বাংলাদেশের সব স্থানে কমবেশি তরমুজ চাষ হয়। তবে এ বছর হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার হরিনখোলা গ্রামের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক আমজাদ খান প্রচলিত তরমুজের বাইরে ‘মধুবালা তরমুজ’ নামে হলুদ রঙের এক ধরনের তরমুজ চাষ করে তাক লাগিয়েছেন সবাইকে। এই তরমুজের লাভ থেকে তার ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়েছে। তার দাবি এই ‘মধুবালা তরমুজ’ তিনিই প্রথম বাংলাদেশে চাষ করেছেন।

কৃষক আমজাদ হোসেন খান শুধু মধুবালাই নয়, তার খামার চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন রঙের তরমুজ। এগুলো হল- জেসমিন, সুপার সাইন বয়, টারজন, ফেয়ারী, ১৭০৪ ও সুপার ড্রাগন প্রজাতির তরমুজ । সুপার ড্রাগনের বাইরে নীল এবং ভিতরে হলুদ। হলুদ রংঙের তরমুজ মধুবালা যেমন সুস্বাদু তেমনি আকর্ষণীয়। অল্প টাকা খরচ করে তিনগুণ লাভ হওয়ায় হলুদ তরমুজ চাষ করতে আগ্রহী হয়ে এলাকায় কৃষকরা তার কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন। 
আর কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, হলুদ তরমুজ লাভজনকের পাশাপাশি বাজারে এর চাহিদা বেশি। আমজাদ হোসেন খান এ বছর তিনি ৩ একর জমিতে আবাদ করেন ব্যতিক্রমধর্মী তাইওয়ান থেকে আগত হলুদ তরমুজ মধুবালা। এতে তার ব্যাপক ফলন হয়। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং বিক্রি হয়েছে ৮ লাখ টাকার বেশী। মধুবালা তরমুজ ক্ষেত থেকে তুলে আনার পর ওজন অনুযায়ী গ্রেডিং করা হয়। পরে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় বাজারে এবং ঢাকার কাকরাইলে। এই তরমুজ ৪০ থেকে ১শ’ টাকায় বিক্রি হয়।

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার সদরের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন খান প্রায় তিন বছর পূর্বে শুরু করেন তরমুজ চাষ। প্রথমদিকে তরমুজের ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় তিনি বৃহৎ পরিসরে চাষ করার চিন্তা করেন। এর ধারাবাহিকতায় এ বছর ব্যতিক্রমধর্মী তাইওয়ান থেকে আনা হলুদ মধুবালাসহ ব্যতিক্রমধর্মী প্রজাতির তরমুজ আবাদ শুরু করেন।

কৃষক আমজাদ হোসেন খান এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বর্ষা মৌসুমে বিশেষ পলিথিনের মাধ্যমে হলুদ তরমুজ চাষ করার জন্য। ইতোমধ্যে চারা প্রস্তুত হয়েছে। রমজান মাসে যাতে ফলন আসে সেই লক্ষে তিনি ১০ একর জমিতে ফলাবেন এই তরমুজ। আগামী মৌসুমে তরমজু চাষ করবেন ২০ একর ভুমিতে।

নিজের তেমন জমি না থাকায় তিনি হরিনখোলা গ্রামে ৩০ একর জমি লীজ নিয়ে তোলেন কৃষি খামার। তার তরমুজ বাগানে এলাকার  ৩০ থেকে ১শ’ জন শ্রমিক কাজ করছেন। শ্রমিকরা জানিয়েছেন তরমুজ বাগানে কাজ করে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালভাবে জীবন-যাপন করছেন। 

আমজাদে হোসেন খানের দেখাদেখি হরিনখোলাসহ চৌমুহনী ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় শুরু হয়েছে তরমুজ আবাদ। বর্তমানে ঐ এলাকার  দেড় হাজার কৃষক এই তরমুজ চাষে জড়িত। যেখানে হবিগঞ্জ জেলায় তরমুজ আবাদ হয় ৩শ’ হেক্টর জমিতে, সেখানে চৌমুহনী ইউনিয়নেই আবাদ হয় ১৮০ হেক্টর জমি। 

কৃষক আমজাদ হোসেন তরমুজের পাশাপাশি টমেটো আবাদেও সফলতা অর্জন করেছেন। এ বছর তিনি ১ লাখ কেজি টমেটো সিঙ্গাপুরে রফতানি করেছেন। গত বছর পেয়েছিলেন ৪০ হাজার কেজি। আগামীতে তরমুজ রফতানিরও ইচ্ছা রয়েছে তার। গত বছর টমেটো আবাদ করে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক রৌপ্য পদক। পরে তাকে অনেক প্রতিষ্ঠান দেয় সম্মাননা। এ বছর তার টার্গেট রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক। সেটি তিনি অর্জন করতে চান তরমুজ চাষের সফলতা দিয়েই।

আমজাদ খান জানান, কৃষি খামারে তিনি ক্যামিক্যাল ব্যবহার না করে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। তিনি সেখানে ১ হাজার সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ বসিয়েছেন। কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলেও সুযোগ পেলেই প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। কৃষি বিভাগ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায়ই বিভিন্ন লোকজন পরিদর্শন করেন তার খামার।

আমজাদ হোসেন খান আরও জানান, তরমজু চাষের জন্য প্রচুর বৃষ্টি হলে ভাল হয়। বৃষ্টি কম হলেও সেচ দিয়ে তা পোষানো যায়। তরমুজ আবাদে পোকা ও ফ্রুট ফ্লাই-এর আক্রমণের পাশাপাশি পচন রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। নিবিড় পরিচচর্যার মাধ্যমে এই অসুবিধা দূর করা সম্ভব।

আমজাদ হোসেন খান ২ সন্তান নিয়ে এখন সুখেই জীবন-যাপন করছেন। অথচ এক সময় তাকেও অর্থ কষ্টের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছিল। 

হরিনখোলা গ্রামের উজ্জল মিয়া জানায়, আমজাদ খান সাহেবের তরমুজ খেতে সবাই পছন্দ করে। আমরাইও এই তরমুজ খেয়েছি। খুবই সুস্বাদু। বর্তমানে তার কৃষি খামারে আমি নিয়মিত কাজ করে পরিবারকেও সহায়তা করতে পারছি। মাধবপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ আতিকুল হক জানান, হলুদ রঙের মধুবালা তরমুজ একটি হাইব্রিড জাত। বাংলাদেশে এই তরমুজ তেমন একটা আবাদ হয়নি। অপ্রচলিত ও সুস্বাদু হওয়ায় এর চাহিদা বাজারে বেশি। আমজাদ হোসেন খানকে এই তরমুজ চাষে কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে। 

মাধবপুর উপজেলার উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ঋষিকেশ ভট্টাচার্য্য জানান, মধুবালা তরমুজ ১ থেকে সাড়ে ৩ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। ফুল আসা থেকে পরিপক্ক হতে এই ফলের সময় প্রয়োজন ১ মাস। অন্যান্য জাতের তুলনায় এই ফসলের উৎপাদন বেশী হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোপাল চন্দ্র দাস জানান, আমাদের কৃষিতে অনেক সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মত উদ্যোমী লোকের অভাব রয়েছে। আমজাদ হোসেন খানের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাকে অনুসরণ করে আরও কৃষক এগিয়ে আসবে বলে তিনি আশাবাদী।

হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রভাষক সুভাষ চন্দ্র দেব জানান, তরমুজের বৈজ্ঞানিক নাম ‘সিটরোনাস ভালগারিস’। এই ফল প্রচুর ক্যালসিয়াম ও লৌহসমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার। ঔষধি গুণ সম্পন্ন এই ফল ও বীজ মাথা ঠাণ্ডা রাখে এবং দেহকে শীতল রাখে। আমজাদ হোসেন খানের এই তরমুজ চাষে সফলতা অনেক মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

No comments:

Post a Comment