Saturday, April 23, 2016

স্বপ্নবাজ এক নায়কের কথা

স্বপ্নবাজ এক মানুষ তিনি। স্বপ্ন দেখেই বসে থাকেন না। স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমে পড়েন কাদাজলে। সফল হয়ে তারপর ওঠেন। এমন এক স্বপ্নবাজের নাম সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। দেশের প্রথম সারির একজন শিল্পপতি। ব্যবসাক্ষেত্রের একজন সফল নায়ক। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে দুবাইভিত্তিক রাস আল খাইমা (আরএকে) গ্রুপ। ৭০ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ১৯৭৭ সালে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসা এখন কয়েকশ’ কোটি টাকায় ছাড়িয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি বিভিন্ন পণ্য দেশ ছাড়িয়ে দখল করে নিয়েছে ইউরোপ আমেরিকার বাজার। একান্ত আলাপে একরামুজ্জামান তার জীবনের বাঁক নেয়া নানা মোড়ের আদ্যপান্ত জানিয়েছেন।
  
হতাশ নয়, আশাই যার পথচলা। আর আশা নিয়ে পথচলাতেই তার প্রতিষ্ঠিত আরএকে সিরামিক আজ দেশের সিরামিক শিল্পের প্রতিকৃত। আরএকে সিরামিক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ একরামুজ্জামান সততা, নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সফল ব্যবসায়ী রূপে। দেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দেশে শত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে দেশসেবায়ও রাখছেন অনন্য ভূমিকা। সেরা করদাতা হিসেবেও সরকার করেছে পুরস্কৃত। একে একে গড়ে তুলেছেন সিরামিকস, ফার্মাসিউটিক্যালস, ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, সিকিউরিটি সার্ভিস, টাইলস অ্যান্ড স্যানেটারিওয়্যার, পেইন্টস, পাইলিং, কয়েল কোম্পানি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পরসোলিন, স্পিনিং, প্যাকেজিং এবং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিসহ নানা শিল্পকারখানা।

সিরামিক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যারস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিডব্লিউএমএ) হিসাব মতে, দেশে এখন সিরামিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫০-এর অধিক। এর মধ্যে সিরামিক টেবিলওয়্যার, টাইলস ও স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই তিনটি শিল্পকে একত্রে সিরামিক খাত বলা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। দেশে সিরামিক পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে আরএকে সিরামিক একাই ২০ শতাংশ বজার দখল করে আছে।
সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান বলেন, সততা, বিশ্বাস আর কর্মীবাহিনীর ওপর আস্থা রেখেই ব্যবসাকে এত দূরে আনতে সক্ষম হয়েছি। বলেন, ব্যবসা করতে হলে মেইন সোর্স হলো ব্যাংক। ব্যাংক যদি লোন না দেয় তাহলে ব্যবসা দাঁড় করানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ ব্যাংক আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। ব্যবসা চলে সুনামের ওপর। আর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এর জন্য ব্যবসায়ীদের সততা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তিনি বলেন, জার্মানি থেকে আমেরিকা চলে যেতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। এখন বুঝতে পারছি তা না করে ভালই করেছি। বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনা। যিনি তা ধরতে পারছেন না তার জন্যই সমস্যা। এ দেশের সবচেয়ে বড় সুবিধাজনক দিক হলো এখানে স্কিল, আনস্কিল ও শীর্ষ থেকে দিনমজুর পর্যন্ত জনশক্তি পাওয়া যায়। অর্থাৎ অল লেভেল অব পিপলস অ্যাভেলেবল। তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের খারাপ দিক হচ্ছে নিরাপত্তা। মানুষ নিজেদের নিরাপদ বোধ মনে করে না। এ বিষয়টি ওভারকাম করতে পারলে এ দেশে বিনিয়োগের অভাব হবে না।
১৯৭৭ সালে বিকম পরীক্ষা দেন সৈয়দ একরামুজ্জামান। কৃতকার্য হতে পারেননি। মন খারাপ। আপসেট হয়ে পড়েন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চলে যান দেশের বাইরে। জার্মানিতে। চাকরি নেন। ছোট চাকরি। তাই কোন সুবিধা করতে পারেননি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। তখন ১৯৮২ সাল। 

জার্মানি থেকে ফিরে এলেও তিনি সঙ্গে নিয়ে আসেন সে দেশের মহান শিক্ষা-শ্রমের প্রতি আনুগত্য আর মর্যাদা। কঠিন পরিশ্রম, সময়ের মর্যাদা, নিয়মানুবর্তিতা এবং সত্য বলা। সততা তো আছেই সবার ওপরে। চাকরি বাদ দিয়ে ব্যবসা করবেন এটাই ছিল সিদ্ধান্ত। কিন্তু অর্থাভাবে সে সময়ে তা সম্ভব হয়নি। দেশে আসার পর পরিবার থেকে চাপ আসে বিয়ে করার। একসময় পরিবারের কথায় বিয়েও করেন। কিন্তু এভাবে বেকার থাকবেন আর কত দিন। বিয়ের পর আবার মনস্থির করেন বিদেশ চলে যাবেন। জার্মানিতেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু কপালে তা ছিল না বলেই তিনি চলে যান দুবাইয়ে। ১৯৮৩ সাল। 

দুবাইয়ের রকউল ফ্যাক্টরিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি পেয়ে যান। চাকরি করতে থাকেন মনোযোগ দিয়ে। প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপিয়ান ম্যানেজমেন্টে চলত। এটাই হয়তো তার টার্নিং পয়েন্ট। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েই শ্রমের প্রতি আনুগত্য নিয়ে কাজ করতে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি ছিল রুগ্‌্‌ন। বেতনও কম। তিনি যোগ দেয়ার ক’মাসের মধ্যেই একে টেনে তুলেন তিনি। সবার দৃষ্টি কাড়েন। প্রমোশন হয় তার। জুনিয়র এক্সিকিউটিভ থেকে একেবারে গোটা আবুধাবির ইনচার্জ। দায়িত্ব পেয়ে তিনি আরও জোরে কাজ চালাতে থাকেন। 

এরই মধ্যে তিনি হন কন্যাসন্তানের জনক। সেখানে কোনোরকমে সংসার চালাতে থাকেন তিনি। দুবাইয়ে সুনাম কুড়ানোর পর তাকে সৌদি আরবেরও দায়িত্ব দেয়া হয়। যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়ে। তার পরও স্ত্রী-কন্যার দিকে তাকিয়ে তিনি চাকরি করতে থাকেন। না বেশিদূর তিনি যেতে পারেননি। একদিন ফোন করে চাকরি ছেড়ে দেন। সিদ্ধান্ত নেন ব্যবসা করবেন। নিজের মতো করে ব্যবসা সাজাবেন। কিন্তু হাতে তেমন টাকাও নেই। দুবাইয়ের ফুজাইরা শহরের একটি মার্কেটে ছোট্ট দোকান দিয়ে বসেন। মাত্র ৭০ হাজার টাকা পুঁজি। গার্মেন্ট পণ্যের ব্যবসা। এ ব্যবসা জমাতে পারছেন না। 

এরই মধ্যে একদিন ব্যাংকক হয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ব্যবসার জন্য কিছু পুঁজি বাবা-মায়ের কাছ থেকে আনা। পকেটে তখন ৩০০ ডলার। ব্যাংককে তৈরি পোশাকের দাম দেখে তিনি পুরো ৩০০ ডলার দিয়েই কাপড় কিনে শিপমেন্ট করেন। এটাই তার প্রথম শিপমেন্ট। এই ৩০০ ডলারের কাপড় বিক্রি হয় ১৫০০ ডলারে। প্রতিবারই এ রকম লগ্নি করে পুঁজি ৩-৪ গুণ হয়ে ফিরে আসছে। এখন বেশি টাকার মালামাল আমদানি করছেন। লাভও করছেন বেশি। মাসে তখন লাভ হতে থাকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার দেরহাম করে। আর ওই সময়ই তার লাইফ স্টাইল পরিবর্তন হতে থাকে। আল আহলি ট্রেডিং নামে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শাখাও খুলে বসেন ইউএই-এর বিভিন্ন শহরে। এ সময় তিনি গার্মেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি শুরু করেন ডিপার্টমেন্টাল শপ। 
এছাড়া দুবাইয়ে তিনি প্রথম শুরু করেন ভিডিও গেমের ব্যবসা। এ ব্যবসায় তিনি নাম্বার ওয়ান হয়ে যান। চারদিকে তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে। ওদিকে রকউল কোম্পানির সেই বস তাকে ফলো করতে থাকেন। ব্যবসা ভাল দেখে তিনিও খুব খুশি। তার এ বসের নাম ড. খাতের মাসাদ। এভাবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একচেটিয়া ব্যবসা। এমনই হয় তার ক্ষেত্রে। শুরু হয় ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ। হঠাৎ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু তত দিনে তার ব্যবসার অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে।

হঠাৎ তার মনে হলো বস ড. খাতের মাসাদের কথা। ছুটে যান বসের কাছে। বস তার ব্যবসার পার্টনার হন। ফান্ড দেন। কিন্তু ব্যবসায় যে ধস শুরু হলো তাতে আর প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ব্যবসা সেখানে বন্ধ করে দেন। পার্টনারদের টাকা ফেরত দিয়ে দেন। এভাবেই তার কেটে যায় আরও ৪ বছর। সময়টা ১৯৯৪ সাল। আরএকে সিরামিক দুবাইয়ে কারখানা চালু করে ব্যবসা শুরু করেন।

প্রথমে বাংলাদেশে দুবাই থেকে আরএকের টাইলস রপ্তানি শুরু করেন তিনি। আর দুবাইতেও বিক্রি শুরু করেন। টাইলস তখন বাংলাদেশে প্রায় নতুন। ’৯৪ সালের শেষ দিক থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ হয় আরএকের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। কিন্তু সৈয়দ একরামুজ্জামানের মনে কষ্ট কাজ করত। ভাবত দেশের এত টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এ থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়?

এসব ভাবতে ভাবতে একদিন আরএকে সিরামিকের সিইও ড. খাতের মাসাদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্লান্ট স্থাপনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন একরামুজ্জামান। এক মিটিংয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাকা হয়। এরপর মাত্র ১১ মাস সময়ের মধ্যে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে আরএকে সিরামিকের বর্তমান ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০১ সালে পূর্ণমাত্রায় এর উৎপাদন শুরু হয়। উন্নত মান, চমৎকার ডিজাইন, বিপুলসংখ্যক ভ্যারাইটিজ ও প্রতিযোগিতামূলক দাম হওয়ার কারণে অল্প সময়ের ব্যবধানে আরএকে হয়ে ওঠে লিডিং কোম্পানি এবং এ সেক্টরের সর্বাধিক বিক্রীত পণ্য। আনপলিশ, পলিশ, ওয়াল এবং ফ্লোর টাইলস- এর জন্য আরএকের রয়েছে এক হাজারেরও বেশি ডিজাইন। শুধু টাইলস নয়- আন্তর্জাতিক মানের স্যানিটারিওয়্যার, ইউরিন্যাল বেসিন, প্যান এবং বিভিন্ন এক্সেসরিজও উৎপাদন করছেন তারা।

আরএকের উৎপাদন ক্যাপাসিটি প্রতিদিন ৩ লাখ স্কয়ার ফিট। স্যানিটারিওয়্যার তৈরি হচ্ছে দৈনিক ৫০০০ পিস। এভাবে আস্তে আস্তে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে থাকেন সৈয়দ একরামুজ্জামান। তৈরি করেন আরএকে ফার্মাসিউটিক্যালস, যা একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। যেখানে ৪৮ প্রকার ওষুধ তৈরি হচ্ছে। যা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

এদিকে হবিগঞ্জ এলাকাকে বদলে দিয়েছেন তিনি। সেখানে গড়ে তুলেন আরএকে পেইন্টস কারখানা। এ প্রতিষ্ঠানটিও এখন সাকসেসফুল কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এখন প্রায় বার্জারের সমান মার্কেট তৈরি করতে পেরেছে আরএকে পেইন্টস। আরএকে পেইন্টস কারখানায় ৪৬ প্রকারের রঙের পেইন্ট উৎপাদন হচ্ছে। আরও রয়েছে মশার কয়েল তৈরির কারখানা। ইতিমধ্যে যা মানুষের মধ্যে চাহিদা তৈরি করেছে। রয়েছে আরএকে পাওয়ার প্লান্ট, যা থেকে জাতীয় গ্রিডেও বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে। আরএকে রাকিন ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানটিও ইতিমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে। এটি একটি ডায়নামিক রিয়েল স্টেট কোম্পানি। ইতিমধ্যে মিরপুরে ২১০০ ফ্ল্যাটের কাজ চলছে। ১৭ সালের ভেতরে এর কাজ সম্পন্ন হবে। ৫০ বিঘা জমির ওপর হচ্ছে রাকিন স্যাটেলাইট টাউন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে নেয়া হয়েছে আরও একটি প্রজেক্ট। যেখানে ৫০০০ ফ্ল্যাটের মডেল টাউন হবে। যেখানে থাকবে অত্যাধুনিক স্কুল, কলেজ, শপিং মল, হাসপাতালসহ নানা সুবিধা।

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে স্টার সিরামিক নামে নতুন আরেকটি কারখানা করা হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে আড়াই লাখ স্কয়ার ফিট টাইলস। ইতিমধ্যে যার চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এ ছাড়া সেখানে চালু হয়েছে স্যানিটারিওয়্যার কারখানা। এ ছাড়া স্টার পরসোলিন নামে একটি কারখানার কাজ চলছে। এ কোম্পানিটিও জয়েন্ট ভেঞ্চারে প্রতিষ্ঠিত। এর পার্টনার রয়েছে ফ্রান্স এবং সুইস কোম্পানি। সৈয়দ একরামুজ্জামান দৈনিক অর্থনীতি প্রতিদিন ও বাংলাভিশনের একজন পরিচালক। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করেন আরএকে সিকিউরিটি অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী দিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, বাসাবাড়ি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করছে তার এ কোম্পানি। এসবের মধ্যে রয়েছে গার্ড সার্ভিস, বডি সার্ভিস (ভিআইপি, সিআইপি ও ব্যক্তিগত সিকিউরিটি), হাইরাজ বিল্ডিং সিকিউরিটি, ক্যাশ ক্যারিং। 

এছাড়া রয়েছে ম্যানপাওয়ার সার্ভিস, স্পেসালাইজড সার্ভিস ও মেইনটেনেন্স সার্ভিস। নিত্যনতুন চিন্তা করেন একরামুজ্জামান। তারই প্রতিফলন দেখা যায় তার কাজে। সমপ্রতি তিনি পাইলিং কোম্পানি করেছেন। যাতে রয়েছে মডার্ন পাইলিং সিস্টেম। যে সিস্টেমে ৬ মাসের কাজ করতে লাগবে মাত্র দুদিন। রয়েছে পল্লী প্রপার্টি ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এ কোম্পানির মাধ্যমে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে গাজীপুরে নতুন প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে। যেখানে থাকবে ৯০০ ফ্ল্যাট, শপিং মল ও ফোর স্টার হোটেল। হবিগঞ্জে রয়েছে প্যাকেজিং কারখানাও। এভাবেই একরামুজ্জামান হবিগঞ্জে গড়ে তুলেছেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। আর এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস হলো উত্তরায়। আরএকে টাওয়ার। যেখানে বসে তিনি সব ব্যবসার খবরাখবর নিচ্ছেন। কর্মীদের খবর নিচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল ১১টায় অফিসে আসেন। একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস করেন। এ সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন লোকদের সময় দেন।

একরামুজ্জামানের এক ছেলে এক মেয়ে। পুত্র সৈয়দ কামরুজ্জামান ইউকেতে মাস্টার্স করে এখন পেইন্টস কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেয়ে সাঈদা শায়লিন জামান প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং দিকটা দেখাশোনা করেন।

একরামুজ্জামান বলেন, স্ত্রী নাঈমা জামান আমার জীবনের চলার পথের সাহসী এক যোদ্ধা। যিনি আমাকে সব সময় সাহস যুগিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি এগোনোর পেছনে জার্মান জীবনটা আমাকে হেল্প করেছে। আমি জার্মানিতে নিম্ন পর্যায়ে কাজ করে এসেছি। আর এ কারণেই সব মানুষকে আমি মূল্যায়ন করি। আমার কাছে সবাই মানুষ। আর আমাকে ছেড়েও কোন স্টাফ যায় না। যারা দিনের পর দিন আমার সঙ্গে কাজ করছেন। এমনও স্টাফ আছেন যারা ২০০০ টাকা বেতন থেকে শুরু করে এখন ২ লাখ টাকা বেতন পাচ্ছেন। অর্থাৎ মানুষকে সম্মান করা আমার ধর্ম। আজীবন তা করে যাবো। নীরবে-নিভৃতে সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন।

একরামুজ্জামানের ইচ্ছা তার নিজ এলাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল করার। যেখানে ঢাকা থেকে মানুষ যাবে সেবা নিতে। আর দেশের বড় বড় সব ডাক্তারকে সেখানে আনা-নেয়ার জন্য থাকবে নিজস্ব হেলিকপ্টার। এ ছাড়া নাসিরনগরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করারও ইচ্ছা তার। একরামুজ্জামানের নিজ গ্রাম চাপড়তলায় কোনো স্কুল ছিল না। সেখানে তার পিতার নামে উচ্চবিদ্যালয় করা হয়েছে। এ ছাড়া দানশীল একরামুজ্জামান নানাভাবে গরিব- অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। শুধু নিজ এলাকা নয়, দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে অসহায় লোকজন এলে তিনি তার উদার হস্ত বাড়িয়ে দেন। এছাড়া এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প করে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।

একরামুজ্জামান বলেন, সারা জীবনই স্ট্রাগল করেছি। এখনও করছি। একটা সফলতা দিয়ে আরেকটা সফলতাকে বিট করার মধ্যেই আমার আনন্দ।

পরিচ্ছন্ন ইমেজের কারণে সহজেই এলাকার মানুষের মধ্যে স্বীয় অবস্থান করে নেন। নিজের উপজেলা নাসিরনগরকে মডেল উপজেলা করার স্বপ্ন লালন করেন তিনি। বলেন, সুযোগ পেলে আমি অবশ্যই এ কাজটি করব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাতে লোকজন নাসিরনগরকে দেখতে আসেন। এলাকার প্রতি টান থেকেই প্রতি সপ্তাহেই ছুটে যান এলাকায়। ঘুরে বেড়ান নাসিরনগরের প্রতিটি গ্রাম। মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ান। মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনে সঙ্গে সঙ্গে তার সমাধান দেন। একজন ব্যবসায়ী, একজন সমাজসেবী এবং একজন সফল মানুষ হিসেবে একরামুজ্জামান এক ইতিহাস। তার কাছে এসে খালি হাতে কেউ ফিরে গেছেন এমন নজির নেই। তিনি বলেন, আমার একটা চ্যারিটি ফান্ড রয়েছে। যে ফান্ড কাজ করে শুধু মানুষের জন্য। এনজয় করি জনসেবাকে।

একরামুজ্জামান বলেন, আরএকে সিরামিকস যখন বাংলাদেশে এনেছিলাম তখন আমার মানসিক যে চাহিদাটা ছিল, তা হলো- বাংলাদেশে নতুন একটা ব্যান্ড পরিচিত করাবো। আজকে আরএকে সিরামিকস আসার পরে অনেক সিরামিকস ফ্যাক্টরি বাংলাদেশে হয়েছে। একটা বিপ্লব কিন্তু বাংলাদেশের সিরামিকস কোম্পানিতে আসছে। আমরা আগে হাজার হাজার কোটি টাকার সিরামিকস আমদানি করতাম। সেখানে আজ আমরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পন্ন। এখন আমরা রপ্তানিও করছি। আমরা মডারেট মিডল ক্লাসের জন্য কাঁচপুর প্রজেক্ট করছি। এখানে আমাদের ফ্ল্যাটের রেট সিক্স থাউজেন্ট প্লাস (প্রতি স্কয়ার ফুট)। কাঁচপুরে আমরা বিক্রি করব সাড়ে ৩ হাজার করে (প্রতি স্কয়ার ফুট)। প্রায় অর্ধেক দাম।

ব্যবসার সার্বিক দিক নিয়ে তিনি বলেন, যেমন আমি ফার্মাসিউটিক্যাল করেছি, টেবিল ওয়ার সিরামিক করছি, পেইন্ট করেছি, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি করেছি, আরও বেশ কিছু করেছি। এত কিছু না করে যদি একটা-দুইটা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে থাকতাম, আরও বেশি নজর দিতাম আমার মনে হয় আরও বেশি ভালও করতে পারতাম। আরএকে সিরামিকসের এক্সপানশন প্লান এখন চলছে। এর বাইরে ঢাকা সিলেট রোডে স্টার সিরামিক যেটা করেছি; ওটাও বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি।

জানা যায়, দেশের পুঁজিবাজারেও ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানি হিসেবে পরিচিত আরএকে সিরামিক। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দর ৬০ থেকে ৭০ টাকায় ওঠানামা করছে। ২০১০ সালে এই কোম্পানিটি দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়।

No comments:

Post a Comment