Saturday, October 12, 2019

সুজনের সেমিনার, ব্যাংকিং খাত নিয়ে উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ বন্ধ করতে হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার: ব্যাংকিং খাত নিয়ে উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সংগঠনটির মতে, এই খাত সংস্কার না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ খারপের দিকে চলে যাবে। শুধু অর্থমন্ত্রীর টোটকা দাওয়াই দিয়ে খেলাপিঋণের ক্যানসার সারানো যাবে না। খেলাপিঋণ সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। গতকাল জতীয় প্রেস ক্লাবে সুজন আয়োজিত ‘ব্যাংকিং খাত নিয়ে উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ বন্ধ করুন: ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করুন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই আহ্বান জানানো হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। 
সুজন-এর সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় আলোচনা অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহীম খালেদ, লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু নাসের বখতিয়ার, অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইনাম আহমেদ চৌধুরী, সংরক্ষিত আসনের বিএনপি সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। 
প্রবন্ধে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তিনি আর খেলাপিঋণ এক টাকাও বাড়তে দেবেন না। অতএব, একজন চার্টার্ড একাউন্টেন্টের চাল প্রয়োগ করে তিনি মন্দঋণ রাইট-অফ করার পদ্ধতি সহজ করে দিয়েছেন, যাতে ক্লাসিফাইড লোনের এই শিথিল পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিভিন্ন ব্যাংক ‘মন্দঋণ রাইট-অফ করা’ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। রাইট-অফ করা মন্দঋণ বাড়ার মানেই হলো এর ফলে ক্লাসিফাইড লোন ওই পরিমাণ কম দেখানো যাবে। তিনি মন্দঋণ আদায়ের জন্যে খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে দুই শতাংশ ঋণ প্রাথমিক কিস্তিতে পরিশোধ করে যে দশ বছরের সময় দেয়ার ব্যবস্থা করলেন, সে সুবিধা নিয়মনিষ্ঠ ঋণ ফেরতদাতারা পান না।
কিন্তু এ-ধরনের পরিবর্তন খেলাপিঋণ সমস্যাটিকে আড়াল করার পন্থা হলেও মন্দঋণ আদায় করার কোনো নিষ্ঠাবান প্রয়াসের মাধ্যমে জোরদার করার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো একজন ‘ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী’ তার ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী বন্ধুদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দরদ দেখিয়ে উল্টোপাল্টা পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন।
প্রবন্ধে আরো বলা হয়, গত ২০১৪-১৯ মেয়াদের সরকারের সময়েও খেলাপিঋণের অবস্থা সংকটজনক থাকা সত্ত্বেও কোন রহস্যজনক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠনের ইস্যুটাকে বারবার এড়িয়ে গেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতাগ্রহণের ৯ মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনো তিনি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেননি, কিন্তু কেন? এদ্দিনে তার বোঝা উচিত যে অর্থমন্ত্রীর টোটকা দাওয়াই দিয়ে খেলাপিঋণের ক্যানসার সারানো যাবে না। দেশে বেশিরভাগ ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয়। যার মূল কারণ খেলাপি ঋণ। এমন অবস্থায় প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সুপারিশ করার জন্যে অবিলম্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করার দাবি জানানো হয়। 
দেশে ব্যাংকঋণ নিয়ে একটা ‘পাতানো খেলা’ চলছে দাবি করে প্রবন্ধে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, সমস্যার প্রকৃত রূপটি সরকার, ব্যাংকার এবং ঋণখেলাপি সবারই জানা আছে। সমস্যার সমাধানের উপায় সম্পর্কেও এই তিন পক্ষের সবার স্পষ্ট ধারণা আছে। কিন্তু জেনে শুনেই সরকার সমাধানের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করছে না। ফলে, এখনো দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা রয়ে গেছে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের কাছে আটকে থাকা বিপুল খেলাপিঋণ। এই ঋণখেলাপিদের প্রায় সবাই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’, মানে যারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে, তারা তাদের ঋণ ফেরত দেবেন না। কারণ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং আর্থিক প্রতাপ দিয়ে তারা শুধু ব্যাংকিং খাত নয় দেশের সংসদকেও দখল করে ফেলেছেন।
এক পরিসখ্যান তুলে ধরে জানানো হয়, গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের ৬১.৭ শতাংশই ব্যবসায়ী। তাদের সিংহভাগই ব্যাংকের মালিক/পরিচালক। সংসদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য পকৃতপক্ষে ঋণখেলাপি হলেও বিভিন্ন পন্থা অনুসরণ করে তারা তাদের খেলাপিঋণ আড়াল করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, বলে অভিযোগ করা হয়।

মূল প্রবন্ধে মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেশের খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। আসলে দেশের খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের ৩০ শতাংশই খেলাপি। এই সমস্যা সমাধানে শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। শীর্ষ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে হবে। খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল করে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ঋণ ১০ খেলাপিকে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাতিল জরুরি। দেশে এত ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তাই ব্যাংকগুলো একীভুত করতে হবে।
মইনুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নাকি এখন ৭টি ব্যাংকের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। ব্যাংকের মালিকানায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ অন্য কোনো দেশে চালু আছে কি না, আমার জানা নেই।
অধ্যাপক মইনুল বলেন, ব্যাংক পরিচালকদের নিজেদের মধ্যে ঋণ নেয়া বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসকে বেআইনি ঘোষণা করতে হবে। যাতে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতাকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে না পারে।
এই অর্থনীতিবিদ খেলাপি ঋণ কমাতে কয়কটি পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ জন খেলাপিকে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। ব্যাংকিং খাতের জন্য আলাদা ন্যায়পাল নিয়োগ, মন্দ ঋণ আদায়ের জন্য ‘ডেট রিকভারি বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ গঠন, অর্থঋণ আদালতে কোনো ঋণ খেলাপির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় হলে জামানত বা বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করার জন্য মামলা করার যে নিয়ম রয়েছে, তা বাতিল করা, প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের নাম এক বছরের বেশি তালিকাভুক্ত হলে ওই প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি তার পাসপোর্ট জব্দ করা ইত্যাদি।

আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি কেউ কাউকে পছন্দ করে না। কিন্তু ঋণ খেলাপি সৃষ্টিতে সবাই একমত। এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে গর্ববোধ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলেও ৮ শতাংশের কাছাকাছি জিডিপি ছিল। তিনি কখনো এসব নিয়ে গর্ববোধ করতেন না। আয় বৈষম্য কমিয়ে আনতে বলতেন। আর বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে উন্নয়নের পারিমাপক হিসেবে ধরা হচ্ছে। চোর ডাকাতের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। চরম বৈষম্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ৯৫ জনকে শোষণ করে ৫ জনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তিনি ‘সমাজ পরিবর্তনের ডাক’ দিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান। তা না হলে এই সমস্যা থেকে বেড় হওয়া যাবে না।

সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘যুবলীগ নেতা সম্রাট আঞ্জুমানের কাছে ২ কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছিল, একবছর কাজ আটকে ছিল। পরে প্রধানমন্ত্রীর কানে এ খবর পৌঁছানোর পর এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। তাই রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে। রাজনীতি যদি শুদ্ধ না হয় তাহলে কিছুই ভালো হবে না। জিডিপিতে উন্নয়ন দেখছি, কিন্তু আমি তো আমাদের অবস্থানের কোনো উন্নয়ন দেখি না। ব্যাংকিং খাত এখন দুর্বৃত্তদের কবলে। 

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, যার যা ইচ্ছা, তাই করছে। ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে। কিন্তু কিছুই বলার ক্ষমতা আমাদের নেই। বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বের মধ্যে এক নম্বর ঋণখেলাপির দেশে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভালো হয়, যদি আমরা ব্যাংকে টাকা না রাখি। মানুষ বোকার মতো ব্যাংকে টাকা রাখছে। আর ঋণখেলাপিদের সুবিধা করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, ক্যাসিনোর সম্রাট একজন, ব্যাংকের সম্রাট আরেকজন। এই সম্রাটকে ধরতে পারলে সবকিছু ঠিক হবে।

বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ব্যাংকের ওপর থেকে যখন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়, তখন দেশের অর্থনীতি ধসে পড়ে। এই সরকার ঋণখেলাপিবান্ধব সরকার। তিনি বলেন, রাজনীতি করা এখন একটি বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তার প্রমাণ ক্যাসিনো সম্রাট যুবলীগ নেতা ঈসমাইল হোসেন সম্রাট। তিনি বলেন, এই সম্রাট আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের একজন নেতা হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সে কিন্তু এমপি বা মন্ত্রী কেউ নন। শুধু রাজনীতি করে নায়ক হয়েছেন। গত কয়েক বছরে যত বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলো এই সরকারের সময়ে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, রাজনৈতিক কর্মী যখন ব্যাংক চালাতে আসবে, তখন অবশ্যই ব্যাংকের নিয়ম পালন করা সম্ভব নয়। সরকার রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাংক পর্ষদে নিযুক্ত করে সবচেয়ে বড় ভুল করেছে বলে তিনি মনে করেন।

No comments:

Post a Comment