Thursday, February 24, 2022

বাজারে ব্যবসায়ীদের এক ধরনের অলিখিত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে

বাজারে ব্যবসায়ীদের এক ধরনের অলিখিত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে

dr khondaker golam moazzem Khondaker Golam Moazzem is industrial economist খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণা পরিচালক সিপিডি cpd সিপিডি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ

বাংলাদেশে সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে এক ধরনের ঊর্ধ্বমুখী মূল্য প্রবণতা কয়েক মাস ধরে দেখতে পাচ্ছি। সরকারের মূল্যস্ফীতির তথ্যই বলছে ৬ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে এই প্রবৃদ্ধির সূচক। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় পণ্যেই এক ধরনের ঊর্ধ্বমুখীপ্রবণতা। তবে মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত সরকারের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ভোক্তা পর্যায়ে বড় ধরনের ফারাক রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সরকারি তথ্যের চেয়ে বাজারে মূল্য বেশি।

এ বিষয়ক একটি গবেষণায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) দেখেছে যে সাম্প্রতিককালে মূল্যবৃদ্ধির যে প্রবণতা, সেটির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি আছে অভ্যন্তরীণ কারণও। একই সঙ্গে ক্যাবের একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, কিছু পণ্যের মূল্যের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের পারিবারিক ব্যয়ের প্রবণতা অনেক বেশি। কেননা সেসব পণ্য তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যবহৃত হয়। আর সে কারণে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় অনেক বেড়ে যায় বলে ক্যাবের রিপোর্টে উল্লেখ হয়েছে।

সাধারণত মূল্যস্ফীতির এই বিষয়টিকে সিপিডির রিপোর্টে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একটি হলো বাজারসংক্রান্ত মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যা। আরেকটি হলো বাজারবহির্ভূত মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যা। বাজারসংক্রান্ত মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে যে কভিড থেকে পুনরুদ্ধার পর্যায়ে সব মানুষ নতুন করে আবার কাজে ফিরতে শুরু করেছে। মানুষের আয় বাড়ছে। হঠাৎ করে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বৈশ্বিক পর্যায়ে যেমন সত্য, তেমনি বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে কমবেশি সত্য। হয়তো সব পর্যায়ে সমানভাবে আয় বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু অবশ্যই আয়ের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির একটি প্রবণতা সাম্প্রতিককালে রয়েছে।

বাংলাদেশে অর্থনীতির এক ধরনের পুনরুদ্ধার হয়েছে। দ্বিতীয়বার কভিড সংক্রমণ বা ওমিক্রনও সেই অর্থে খুব বড় রকমের চাপে ফেলেনি। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে হঠাৎ করে পণ্যের চাহিদা তৈরি হওয়ায় কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহকারী দেশগুলোও পণ্য সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে এবং তাদের পর্যায়েও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ও রপ্তানি মূল্যবৃদ্ধির সাপেক্ষে সামগ্রিকভাবে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রবণতা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ফলে বাংলাদেশের যেসব আমদানি করা পণ্য, সেখানেও আমরা বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত দেখতে পাচ্ছি। সেটি তেল, চিনি, ডাল ও অন্যান্য আমদানি পণ্যের জন্য কমবেশি প্রযোজ্য।

বাংলাদেশের ভেতরেও কিন্তু মানুষ কাজে ফিরছে। সুতরাং তারও এক ধরনের ব্যয়প্রবণতা বেড়েছে এবং সে কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে উৎপাদিত যেসব পণ্য রয়েছে, সেটি চাল থেকে শুরু করে পেঁয়াজ ও অন্যান্য মসলাজাতীয় পণ্য—সব কটির ক্ষেত্রে কথাটি অংশত সত্য। ফলে সেখানেও সরবরাহের একটা ঘাটতি রয়েছে, হঠাৎ করে চাহিদা বৃদ্ধির একটা প্রবণতা রয়েছে। একই সঙ্গে এ কথাও সত্য, বিগত বছরগুলোতে কভিডের কারণে যে মুনাফা হারানো দেশি পণ্য বা কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দেশ ও উদ্যোক্তারা এ সময়ে বাড়তি মূল্য নিয়ে বিগত দিনের লোকসান পুষিয়ে নিতে চাইছেন। ফলে সে কারণেও তাঁদের ভেতরে এক ধরনের বর্ধিত মূল্য চাওয়ার পাশাপাশি পচনশীল নয় এমন পণ্য ধরে রাখা এবং সেখান থেকে কিছু বাড়তি মুনাফা করার প্রবণতা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশেও আমরা বাজারবহির্ভূত যে কারণগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যে যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলো হচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্য ধরে রাখা, মজুদ করে রাখা। যাঁরা বড় সরবরাহকারী, তাঁরা এগুলো ধরে রাখছেন অথবা বৃহৎ আমদানিকারকরা সুবিধাটি নিচ্ছেন।

আবার আমরা দেখি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও সেই পণ্য নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যায় না। কোনো পণ্য নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি না হয়ে বাজারে বাড়তি মূল্যে বিক্রি হলে, তা বাজারবহির্ভূত কারণে ঘটছে বলে মনে হয়। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও সেই দামে বাজারে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। একজন ভোক্তাকে বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে।

সিপিডির গবেষণায়ও আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিককালে মূল্য এবং মার্জিনের ক্ষেত্রে সব পর্যায়ে সমপরিমাণের মার্জিন রাখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সাধারণত যাঁরা পণ্যের বৃহৎ সরবরাহকারী, তাঁরা কম মার্জিন নিয়ে থাকেন। কেননা কম মার্জিনের ওপর বড় পরিমাণের সরবরাহ দিয়ে তাঁরা ব্যয় মিটিয়ে থাকেন। মুনাফা করে থাকেন। অন্যদিকে যাঁরা অল্প পরিমাণে বাজারে সরবরাহ করেন, তাঁরা একটু বেশি মার্জিন রাখেন। কেননা কম পরিমাণ সাপ্লাই দিয়ে তাঁদের ব্যয় মিটিয়ে পরিবারের জন্য আয় নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় চাল কিংবা তেলের ক্ষেত্রে বা উভয় ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, খুচরা পর্যায়ের মূল্য মার্জিন এবং ফান্ডেড মার্জিন ও ইমপোর্ট মার্জিন প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে ওঠানামা করেছে। তার মানে একজন আমদানিকারকও একজন তুচ্ছ বিক্রেতার মতো সমান পরিমাণে মার্জিন রাখছেন। সেই জায়গাটি নিয়েই আসলে আপত্তি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে হিসাব করছে। মার্জিন ও পরিবহন ব্যয়ের হিসাব নিচ্ছে। অন্যান্য ব্যয় ধরে তারা পণ্যের মূল্য ঠিক করে দিচ্ছে। কিন্তু সেটি যখন বাজারে বাস্তবায়িত হচ্ছে না, সেখান থেকে প্রশ্নটি আসে যে বাজারে কি আড়াল থেকে এক ধরনের অলিখিত নিয়ন্ত্রণ চলছে? তাহলে অলিখিত নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে কারা? বড় আমদানিকারক ব্যবসায়ী এবং অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যাঁরা বড় আকারের সাপ্লাইয়ার, তাঁরা?

এ অবস্থায় বলা যেতে পারে, শুধু সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণই যথেষ্ট নয়, বরং আমদানি পর্যায়ে এগুলোর মূল্য কী ছিল, কী মূল্যে বাজারজাত হচ্ছে, আমদানিকারক কী পরিমাণ মজুদ রাখছেন, আমদানিকারক কী মূল্যে এগুলো আড়তদার বা পাইকারি পর্যায়ে ছাড়ছেন, সেগুলো কিন্তু দেখার দরকার রয়েছে। ঠিক একইভাবে অভ্যন্তরীণ পণ্যের ক্ষেত্রেও মাঠ পর্যায়ের কৃষক, বড় কৃষক, রাইস মিলার ও অটো রাইস মিলার কী পরিমাণ মজুদ রাখছেন, কী মূল্যে বাজারজাত করছেন এবং কী মূল্যে তাঁরা কিনেছেন তার হিসাব রাখার প্রয়োজন রয়েছে।

একই সঙ্গে এটিও ঠিক যে সরকার সাম্প্রতিককালে ব্যাপকভাবে ওএমএস কর্মসূচি বৃদ্ধি করেছে, যেটি আসলে যৌক্তিক। কেননা মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষের বর্ধিত মূল্যে সক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে কিছুটা নির্ধারিত মূল্যে সরকার থেকে পণ্য কেনার আগ্রহ বাড়ছে। সরকার যৌক্তিক কারণে ওএমএস কার্যক্রম উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। ফলে প্রচুর পরিমাণে পাবলিক স্টকের দরকার পড়ছে। পাবলিক স্টকগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে রাইস মিলার ও কৃষকদের কাছ থেকে। অথবা আমদানিকারকদের কাছ থেকে। ফলে যেটি হয়েছে যে বাজারের জন্য স্বাভাবিক সরবরাহের সঙ্গে এই ওএমএস পর্যায়ের সরবরাহের ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে তার একটি মূল্যবৃদ্ধির কারণ হচ্ছে বলে অনুমান করা যায়, যদিও সরকারের স্টকে যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ রয়েছে। আমরা জানি, ১৬ থেকে ১৮ টন চাল গম মজুদ রয়েছে। সেই মজুদেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। সেই জায়গাটি কিন্তু এখানে দেখার দরকার রয়েছে। আমরা যেটি মনে করি, এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বাইরে যে ঘটনাগুলো হচ্ছে, সেই বাজারবহির্ভূত মূল্যের কারণগুলো দেখার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের কম্পিটিশন কমিশন যেটি রয়েছে, তাদের আরো সক্রিয় হওয়া দরকার।

আমরা জানি, একটি প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে, যাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে কি না তা দেখা। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে বড় সাপ্লাইয়ারদের কাছে আমাদের সরকার অথবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক ধরনের অসহায় বোধ করে। ফলে অনেক সময় অনেকটা হাত বুলিয়ে মার্কেট সাপ্লাই ঠিক রাখার একটা প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে অত্যাবশ্যকীয় গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কম্পিটিশন কমিশন জোরালো ভূমিকা রেখে থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কম্পিটিশন কমিশনের কোনো ভূমিকা আমরা দেখছি না। অথচ এটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। আমরা তাদের কাছে সঠিক ভূমিকা প্রত্যাশা করি।

সমস্যটি হচ্ছে, এই মূল্যবৃদ্ধির স্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্য নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যান্য জ্বালানিজাতীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বা ইউটিলিটির মূল্যবৃদ্ধির সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত। আমাদের কাছে এটি এই মুহূর্তের জন্য মোটেই কোনো গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নয় বলে আমরা মনে করি। আমরা শুনতে পাচ্ছি যে ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধির একটি আলোচনা চলছে। কিন্তু আমি বিগত ১০ বছরে ওয়াসার হিসাব দেখতে পাচ্ছি, ওয়াসা নিয়মিতভাবে মুনাফা করে আসছে। ওয়াসাকে ভর্তুকি দিতে হয়নি। ওয়াসা গত ১০ বছরে প্রায় এক হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এখন বলা হচ্ছে, ওয়াসা তার খরচ মেটাতে পারছে না। তার জন্য তার বর্ধিত মূল্য দরকার। আমরা মনে করি, এই যুক্তিটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই মুহূর্তে পানির মূল্যবৃদ্ধির কোনো প্রায়োজন আছে বলে মনে করি না। যদি ওয়াসার আসলে বর্ধিত মূল্যের কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে, তাহলে বর্ধিত ব্যয়টুকু ওয়াসার বিগত বছরে যে মুনাফা হয়েছে, সেখান থেকে পূরণ করতে পারে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করাও উচিত হবে না। মনে রাখা দরকার, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যে জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, সেই এলএনজির অংশ খুবই অল্প। সুতরাং অল্প পরিমাণ এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির দায়টুকু পুরো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে সম্পৃক্ত করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় মূল্যবৃদ্ধির এক ধরনের চেষ্টা চলছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও বিইআরসি এই বিষয়গুলোকে যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করবে এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির জায়গা থেকে সরকার সরে আসবে। যদি কোনো কারণে এলএনজির মূল্যের কারণে বাড়তি ভর্তুকির প্রয়োজন হয়, আশা করি সরকার সীমিত সময়ের জন্য আরো কিছুকাল ভর্তুকি অব্যাহত রাখবে। একই সঙ্গে গ্যাসের মূল্যের ক্ষেত্রে এই কথাটি সত্য বলে আমরা মনে করি। আমরা শুনতে পাচ্ছি, বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যয় অ্যাডজাস্ট করতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে এই বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির যে অগ্রগতি, সেখানে তুলনামূলকভাবে ছোট অগ্রগতি হয়েছে। সেখানে এক ধরনের অব্যবহৃত রেভিনিউ থেকে যাচ্ছে। আমাদের কাছে মনে হয়, বর্ধিত ব্যয় মেটানোর জন্য সেটি কাজে লাগাতে পারে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকার কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনা থেকে ঋণ নেওয়ার মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে সরকার ঋণও নিতে পারে। সরকার এরই মধ্যে ইইউ, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং ওআইসি থেকে যে বাজেটারি সাপোর্ট নিয়েছে, সেটি দিয়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। আমরা মনে করি, সরকার সেটি বিবেচনা করবে।

সরকার বিগত সময়ে ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে তাঁদের ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য যৌক্তিক উদ্যোগ নিয়েছে। এখন সময় এসেছে সাধারণ মানুষ, ভোক্তা, নিম্ন আয়ের মানুষকে বাঁচিয়ে ও টিকিয়ে রাখার। সুতরাং এই সময়ে সরকারের যে বাড়তি ব্যয় হবে, সেটি ভর্তুকিজনিত কারণে হোক, বর্ধিত মূল্য সমন্বয়ের কারণে হোক, সেগুলো সরকারের করা উচিত। এই ব্যয়ভারকে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত সাধারণ ভোক্তাদের বিবেচনায়। মনে রাখা দরকার, অন্যান্য গোষ্ঠীর হয়তো রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে, ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক ভয়েস রয়েছে। হয়তো নিম্ন আয়ের মানুষের সে পরিমাণ রাজনৈতিক ভয়েস নেই এবং তারা দুর্বল থাকে। এটি যাতে কোনোভাবেই মূল্যবৃদ্ধির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। বরং সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের এই দুর্বল অবস্থানটি যাতে কোনোভাবে ব্যবহৃত না হয়, সেই জায়গাটিতে সরকার যেন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষের মূল্যস্ফীতির অভিঘাতটুকু যাতে নিম্ন পর্যায়ে থাকে, সে জন্য ব্যবস্থা নেয়।

-খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

Tuesday, February 22, 2022

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন UK প্রবাসী ইকবাল

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন UK প্রবাসী ইকবাল

Iqbal Ahmed OBE is a Bangladesh-born British entrepreneur Iqbal Ahmed এ সিমার্ক গ্রুপ প্রতিষ্ঠাতা সিলেট ইকবাল আহমেদ

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চেইন শপ ওয়ালমার্ট থেকে শুরু করে ছোট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানেও মিলছে চিংড়িসহ নানা ধরনের হিমায়িত মাছ। এর মধ্যে বাংলাদেশের মাছও রয়েছে, যা সরবরাহ করছে যুক্তরাজ্যের সিমার্ক পিএলসি। এ সিমার্ক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সিলেটের ইকবাল আহমেদ। তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের হিমায়িত মাছ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্ববাজারে পৌঁছে যাচ্ছে। বদৌলতে বড় হচ্ছে সিমার্কের ব্যবসা।

১৯৭৬ সালে ম্যানচেস্টারে বাবার ব্যবসায়ে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসায়ের জগতে প্রবেশ করেন ইকবাল আহমেদ। ওই বছরেই নিজের দুই ভাই কামাল আহমেদ ও বেলাল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ইকবাল ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি (ইবকো)। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কোম্পানিটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হিমায়িত মাছ, চিংড়িসহ নানা খাদ্যসামগ্রীর আমদানি–রপ্তানি ব্যবসা শুরু করে। তারা বাংলাদেশ থেকে মিঠা ও লোনা পানির বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত মাছ, বাগদা চিংড়ি ও গলদা চিংড়ি নিয়ে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে বিক্রি করে। তারা এখন মাছসহ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও গুদামজাতকরণে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী।

১৯৯১ সালে ইকবাল আহমেদ গড়ে তোলেন সিমার্ক পিএলসি। একই বছরে তিনি চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ও হিমাগার গড়ে তোলেন। এরপর বিভিন্ন দেশে প্রক্রিয়াজাত ও হিমায়িত খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করেন। তাঁর হাতে গড়া টাইগার, সি গোল্ড, লিলি, মি প্রণ, ইবকো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এখন হিমায়িত মাছ ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। সব মিলিয়ে সিমার্ক গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার তথা মোট লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ড, যা বাংলাদেশের প্রায় ৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার সমান। তবে করোনাভাইরাস ও ব্রেক্সিটের প্রভাবে ব্যবসা কিছুটা কমেছে।

বেশ আগেই যুক্তরাজ্যের শীর্ষ ধনী তালিকায় নাম উঠেছে ইকবাল আহমেদের। রপ্তানিতে অবদান রাখার জন্য তিনি একাধিক স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে কুইন্স অ্যাওয়ার্ড পান। এ ছাড়া ২০০১–২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সামুদ্রিক মাছ রপ্তানিতে শীর্ষস্থান অর্জনের সুবাদেও রপ্তানি পদক পায় সিমার্ক।

অন্য অনেকের মতো ইকবাল আহমেদের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠাও সহজ ছিল না। তিনি বলেন, ‘ব্যবসা সময়ে সময়ে কঠিন হয়ে উঠেছে, কিন্তু কখনো হাল ছাড়িনি। ওল্ডহ্যাম ও ম্যানচেস্টারের দোকানে দোকানে আর রেস্তোরাঁয় পণ্য বিক্রি করেছি। এখানে–ওখানে দরজায় দরজায় গিয়েছি। সফলতা অর্জনের পাশাপাশি বহু জায়গায় প্রত্যাখ্যাতও হতে হয়েছে।’

ইকবাল আহমেদের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে আরও নানা খাতে ও নানা দেশে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে তাঁর রয়েছে তিনটি কারখানা। এ ছাড়া দাতব্য কাজেও রয়েছে তাঁর বিশেষ আগ্রহ। সিলেটের নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন স্কুল ও কলেজ। রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ কর্মসূচি চালাচ্ছে ইকবাল আহমেদের ফাউন্ডেশন। তিনি এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন, এখন পরিচালক।

বাংলাদেশের চিংড়ির রপ্তানি সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘গত ১০ বছরে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি। তবে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরে আয় বেড়েছে, চিংড়ি রপ্তানি কিন্তু বাড়েনি। প্রায় ২০ বছর ধরে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে। চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত এ চিংড়ি উৎপাদন করছে, রপ্তানিতেও নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা। পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু হলে রপ্তানি বছরে এক বিলিয়ন বা এক শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা জিএসপি থাকায় সহজেই আমরা বাজার ধরতে পারব। অনেক দেশের এ সুবিধা নেই, এতে তারা পিছিয়ে পড়বে।’

চিংড়ির বাজার সম্পর্কে ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মাঝারি আকারের চিংড়ির চাহিদা বেশি। আগে চিংড়ি বড় সুপার মার্কেট ও হাইপার মার্কেটে বিক্রি হতো। এখন চিংড়ি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে গেছে। ১৬-২০টি চিংড়ির ওজন ৪৫০ গ্রাম (১ পাউন্ড) হলে সেটাকে আন্তর্জাতিক মানের আকার বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে চিংড়ি চাষে এখনো বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ শুরু হয়নি। যেসব দেশ বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা সবাই তা শুরু করেছে।’

ইকবাল আহমেদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে বড় আকারের চিংড়ি উৎপাদন হয়। অনেকে মনে করেন, বড় চিংড়ি মানেই বেশি দাম, আসলে সেই দিন আর নেই। এ জন্য এমন আকারের চিংড়ি উৎপাদন করতে হবে, যেটির চাহিদা আছে আন্তর্জাতিক বাজারে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা হচ্ছে না। আমরা শুধু বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করছি, যেটা প্রতি হেক্টরে ৩০০-৪০০ কেজি উৎপাদন হয়। এ কারণে আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পারছি না।’

১৯৬৫ সালে যখন ইকবাল আহমেদের বয়স ৯ বছর, তখন তাঁর বাবা কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। ফলে কম বয়সেই তাঁকে দেশে থাকা পুরো পরিবারের হাল ধরতে হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মা ও ভাইবোনদের নিয়ে ইকবাল আহমেদও যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন। তখন ইকবালের বয়স ছিল ১৫ বছর। ওই সময় তাঁরাই ছিলেন ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যামে একমাত্র বাংলাদেশি পরিবার।

আসছে জাতীয় কি-বোর্ড, বাংলা বানানের সফটওয়্যার ও ট্রান্সলেটর

আসছে জাতীয় কি-বোর্ড, বাংলা বানানের সফটওয়্যার ও ট্রান্সলেটর

আসছে জাতীয় কি-বোর্ড, বাংলা বানানের সফটওয়্যার ও ট্রান্সলেটর

প্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার অনেক আগে শুরু হলেও তা ছিল বিচ্ছিন্ন আকারে। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু কাজ হলেও সরকারি উদ্যোগে বড় কিছু হয়নি বললেই চলে। দীর্ঘদিন ধরেই একটি জাতীয় কি-বোর্ড, বাংলা বানান পরীক্ষার সফটওয়্যার, বাংলা ওসিআর, বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটরের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

সরকার এই সমস্যা দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছিল কয়েক বছর আগেই। এবার তা আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। সরকারিভাবে তৈরি হচ্ছে জাতীয় কি-বোর্ড, বাংলা বানানের সফটওয়্যার, ওসিআর ও মেশিন ট্রান্সলেটর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে তৈরি হচ্ছে বাংলা ভাষা সফটওয়্যার প্যাকেজ। এরমধ্যেই থাকছে ওসিআর, স্পিচ টু টেক্সট অ্যান্ড টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যার, জাতীয় কি-বোর্ড, বাংলা স্টাইল গাইড, বাংলা ফন্ট ইন্টারঅপারেবিলিটি ইঞ্জিন, বাংলা স্পেল অ্যান্ড গ্রামার চেকার, বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর ইত্যাদি।

জানা যায়, এসব সফটওয়্যার উন্মুক্ত থাকবে। সরকারি বা বেসরকারি কাজে বাংলা বানানের যে দুরবস্থা সেটাও দূর হবে এতে। উন্মুক্ত এই মাধ্যম ব্যবহার করে সবাই একই বানান রীতি অনুসরণ করতে পারবেন। উপযুক্ত শব্দ যাচাই করে নেওয়ার ফলে আরও অনেক ভুলও দূর করা সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, আইসিটিতে বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে আইসিটি বিভাগের গবেষণা ও উন্নয়নের বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে অপটিক্যাল ক্যারেকটার রিকগনাইজার (ওসিআর), টেক্সট টু স্পিচসহ ১৫টি টুল তৈরি করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের বরাদ্দ ১৫৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের জন্য প্রশাসনিক আদেশ হয়েছে ২০১৭ সালে। প্রকল্প পরিচালক ওই বছরেরই এপ্রিলে নিয়োগ দেওয়া হলেও কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের আগস্টে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) এই প্রকল্পের কারিগরি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সফটওয়্যার যাচাই-বাছাই ও পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্বে থাকবে এই কমিটি। তারাই প্রকল্পর টিওআর (টার্মস অব রেফারেন্স) লেখার কাজ করেছেন। এছাড়া এই কাজের জন্য একটি ইসি কমিটিও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাষাবিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গুণীজনরা এতে জড়িত রয়েছেন। সফটওয়্যার নির্মাণ শেষ হলে ইসি তা পর্যালোচনা করে দেখবে।

জানা যায়, এই প্রকল্পের তিনটি টুল তৈরির কাজ পেয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান রিভ সিস্টেমস। প্রতিষ্ঠানটি স্ক্রিন রিডার, বাংলা স্পেল অ্যান্ড গ্রামার চেকার ও ওসিআর তৈরি করছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা রায়হান হোসেন জানান, তিনটির মধ্যে দুটির কাজ প্রায় শেষ। আরেকটা চলতি বছরের শেষ নাগাদ শেষ হবে। বাংলা স্পেল অ্যান্ড গ্রামার চেকার তৈরির কাজ প্রায় শেষ। শুধু ওয়েব এক্সটেনশনের কাজ বাকি। জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।

স্ক্রিন রিডারের বিষয়ে তিনি বলেন, করোনার কারণে কাজটি অনেক পরে শুরু হয়েছে। এখন এগিয়ে চলেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে বলে তিনি জানান। ওসিআর-এর বিষয়ে রায়হান হোসেন বলেন, এটার কাজ জুনের মধ্যে শেষ হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো সংবেদনশীল কাজ। অনেক ডাটা সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সেগুলোর নির্ভুলতা যাচাই করা, যন্ত্রের উপযুক্ত করা, বোধগম্য করা- অনেক কিছু জড়িত। বারবার পরীক্ষা করতে হচ্ছে।

প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যারা উচ্চারণ করেন

প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যারা উচ্চারণ করেন

প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যারা উচ্চারণ করেন

বাংলাদেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। বলা হয়েছে- সকল সাংবিধানিক পদ, সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে হবে।

এ ছাড়া সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাসেম্বলি, সভা-সমাবেশ, সেমিনারে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করতে হবে। ২০২০ সনের ১০ই মার্চ হাইকোর্টের তরফে এক রায়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। এরই আলোকে রোববার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই স্লোগান মুক্তিযুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- কখন, কীভাবে এই স্লোগানের উৎপত্তি হয়েছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ’র প্রতিষ্ঠাতা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রধান সংগঠক সিরাজুল আলম খান তার ‘স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ’ বইয়ে এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৯ সনের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রথম এই স্লোগান ওঠে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা ছিল। মধুর ক্যান্টিনের সে সভায় ১৭ই মার্চ শিক্ষা দিবস যৌথভাবে পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আহূত সেই সভায় আলোচনার একপর্যায়ে তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের (জিন্নাহ হল যা বর্তমানে সূর্যসেন হল) প্রথম বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন আহমেদ ও দর্শন বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান (৭১-এ শহীদ) প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন।

সভা চলাকালীন সময়েই অনেকটা আকস্মিকভাবে সবাইকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন এই দু’জন। সঙ্গে সঙ্গে সাত-আটজন কর্মী প্রতিধ্বনি করেন ‘জয় বাংলা’।

এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ তখন হাতে লেখা তিন পাতার একটি পত্রিকা প্রকাশ করে- যার নাম ছিল ‘জয় বাংলা’। ১৯৭০-এর ১৮ই জানুয়ারি পল্টনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় সিরাজুল আলম খান সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন।

সিরাজুল আলম খান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুও এই স্লোগানটি পছন্দ করেছিলেন। ’৭০-এর ৭ই জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে প্রথম যুক্ত করেন এই স্লোগানটি।

তিনি আরও লিখেছেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎপত্তি এবং জাতীয় স্লোগানে পরিণত হওয়ার এক ইতিহাস রয়েছে। নিউক্লিয়াস’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্লোগান নির্ধারণের জন্য তিনটি সেলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে একটি সেল ‘জিয়ে সিন্ধ বা জিও সিন্ধ’-এর মতো করে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি কাজে লাগানো যায় কি-না সিরাজুল আলম খানের কাছে তা উপস্থাপন করে।

এই সেলটির মূল দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমেদ। সুবিধা মতো সময়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি নিউক্লিয়াস’র বিবেচনায় আসে। নিউক্লিয়াস’র সদস্যদের প্রত্যেকের ভেটো দেয়ার সুযোগ ছিল। এই ভেটো প্রয়োগের কারণে প্রায় ৮-১০ দিন সময় লাগে ‘জয় বাংলা’কে অনুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি বলে দেয়া হয়েছিল, স্লোগানটিকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য। যেন আর দশটা স্লোগানের মতো ‘জয় বাংলা’কে যত্রতত্র ব্যবহার না করা হয়।

‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা-ঢাকা’। ‘ছয় দফা- ছয় দফা, না হলে এক-দফা’। ‘এগারো দফা-এগারো দফা, না হলে এক দফা’। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।

এগুলো নিউক্লিয়াস সেলের মাধ্যমে স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যা পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিষয়ে ছাত্রলীগের দু’একজন এবং আওয়ামী লীগের সবাই (বঙ্গবন্ধু ছাড়া) ঘোর আপত্তি করতো। আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিতেও এই স্লোগান নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কেউ কেউ জয় বাংলাকে নিয়ে ভারতঘেঁষা রাজনীতি করা হচ্ছে- এই যুক্তি তুলে ধরেন।

শুধু কমিটিতেই নয়, তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আওয়ামী লীগের সকলেই ‘জয় বাংলা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এমনকি তারা এই স্লোগানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগও করেন। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি উত্তর ছিল- এ নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই।

৪ঠা জানুয়ারি ১৯৭০। সেদিন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া শুরু হলে দু’একজন আপত্তি করেন এবং এই স্লোগানটি বন্ধ করার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনুরোধ জানান। ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭০-এর পল্টনের জনসভার বক্তৃতার মঞ্চটি ছিল বিশেষভাবে নির্মিত।

মঞ্চের শামিয়ানায় আটকানো হার্ডবোর্ডের উপর লাগানো কাঠের খণ্ডে উজ্জ্বল লাল রঙয়ের দুটি শব্দ। এরমধ্যে ‘জয় বাংলা’ জ্বল জ্বল করছিল। দূর থেকেই তা দেখা যাচ্ছিল। এই সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু মঞ্চে বসা অবস্থায় বললেন- ‘সিরাজ স্লোগান দে’। সিরাজুল আলম খান এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

দ্রুত মাইকের সামনে গিয়ে আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন- আসুন, সাত কোটি মানুষের পক্ষ হয়ে আমরা সকলকে জানিয়ে দেই, যার কণ্ঠে যতো জোর আছে আমরা একই সঙ্গে বলে উঠি ‘জয় বাংলা’। আজ থেকে ‘জয় বাংলা’কে আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তখন লাখো কণ্ঠে আওয়াজ উঠলো- ‘জয় বাংলা’। এখানেই শেষ নয়।

১৯৭১ সনের ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েই তার অবিস্মরণীয় বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। সিরাজুল আলম খান তার বইতে লিখেছেন- ‘জয় বাংলা’ কোনো দল বা ব্যক্তির স্লোগান নয়। এই স্লোগান ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্লোগান। এটা নিছক কোনো স্লোগান নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। যে স্লোগান বাঙালি জাতিকে করেছিল ঐক্যবদ্ধ।