Tuesday, February 22, 2022

প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যারা উচ্চারণ করেন

প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যারা উচ্চারণ করেন

প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি যারা উচ্চারণ করেন

বাংলাদেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। বলা হয়েছে- সকল সাংবিধানিক পদ, সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে হবে।

এ ছাড়া সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাসেম্বলি, সভা-সমাবেশ, সেমিনারে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করতে হবে। ২০২০ সনের ১০ই মার্চ হাইকোর্টের তরফে এক রায়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। এরই আলোকে রোববার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই স্লোগান মুক্তিযুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- কখন, কীভাবে এই স্লোগানের উৎপত্তি হয়েছিল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ’র প্রতিষ্ঠাতা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রধান সংগঠক সিরাজুল আলম খান তার ‘স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ’ বইয়ে এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৯ সনের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রথম এই স্লোগান ওঠে। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা ছিল। মধুর ক্যান্টিনের সে সভায় ১৭ই মার্চ শিক্ষা দিবস যৌথভাবে পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আহূত সেই সভায় আলোচনার একপর্যায়ে তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের (জিন্নাহ হল যা বর্তমানে সূর্যসেন হল) প্রথম বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন আহমেদ ও দর্শন বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান (৭১-এ শহীদ) প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন।

সভা চলাকালীন সময়েই অনেকটা আকস্মিকভাবে সবাইকে চমকে দিয়ে চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন এই দু’জন। সঙ্গে সঙ্গে সাত-আটজন কর্মী প্রতিধ্বনি করেন ‘জয় বাংলা’।

এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ তখন হাতে লেখা তিন পাতার একটি পত্রিকা প্রকাশ করে- যার নাম ছিল ‘জয় বাংলা’। ১৯৭০-এর ১৮ই জানুয়ারি পল্টনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় সিরাজুল আলম খান সর্বপ্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারণ করেন।

সিরাজুল আলম খান লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুও এই স্লোগানটি পছন্দ করেছিলেন। ’৭০-এর ৭ই জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে প্রথম যুক্ত করেন এই স্লোগানটি।

তিনি আরও লিখেছেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উৎপত্তি এবং জাতীয় স্লোগানে পরিণত হওয়ার এক ইতিহাস রয়েছে। নিউক্লিয়াস’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্লোগান নির্ধারণের জন্য তিনটি সেলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে একটি সেল ‘জিয়ে সিন্ধ বা জিও সিন্ধ’-এর মতো করে ‘জয় বাংলা’ শব্দটি কাজে লাগানো যায় কি-না সিরাজুল আলম খানের কাছে তা উপস্থাপন করে।

এই সেলটির মূল দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আফতাব উদ্দিন আহমেদ। সুবিধা মতো সময়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি নিউক্লিয়াস’র বিবেচনায় আসে। নিউক্লিয়াস’র সদস্যদের প্রত্যেকের ভেটো দেয়ার সুযোগ ছিল। এই ভেটো প্রয়োগের কারণে প্রায় ৮-১০ দিন সময় লাগে ‘জয় বাংলা’কে অনুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি বলে দেয়া হয়েছিল, স্লোগানটিকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য। যেন আর দশটা স্লোগানের মতো ‘জয় বাংলা’কে যত্রতত্র ব্যবহার না করা হয়।

‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা-ঢাকা’। ‘ছয় দফা- ছয় দফা, না হলে এক-দফা’। ‘এগারো দফা-এগারো দফা, না হলে এক দফা’। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।

এগুলো নিউক্লিয়াস সেলের মাধ্যমে স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যা পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিষয়ে ছাত্রলীগের দু’একজন এবং আওয়ামী লীগের সবাই (বঙ্গবন্ধু ছাড়া) ঘোর আপত্তি করতো। আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিতেও এই স্লোগান নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কেউ কেউ জয় বাংলাকে নিয়ে ভারতঘেঁষা রাজনীতি করা হচ্ছে- এই যুক্তি তুলে ধরেন।

শুধু কমিটিতেই নয়, তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আওয়ামী লীগের সকলেই ‘জয় বাংলা’র বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এমনকি তারা এই স্লোগানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগও করেন। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি উত্তর ছিল- এ নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই।

৪ঠা জানুয়ারি ১৯৭০। সেদিন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া শুরু হলে দু’একজন আপত্তি করেন এবং এই স্লোগানটি বন্ধ করার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনুরোধ জানান। ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭০-এর পল্টনের জনসভার বক্তৃতার মঞ্চটি ছিল বিশেষভাবে নির্মিত।

মঞ্চের শামিয়ানায় আটকানো হার্ডবোর্ডের উপর লাগানো কাঠের খণ্ডে উজ্জ্বল লাল রঙয়ের দুটি শব্দ। এরমধ্যে ‘জয় বাংলা’ জ্বল জ্বল করছিল। দূর থেকেই তা দেখা যাচ্ছিল। এই সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু মঞ্চে বসা অবস্থায় বললেন- ‘সিরাজ স্লোগান দে’। সিরাজুল আলম খান এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

দ্রুত মাইকের সামনে গিয়ে আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন- আসুন, সাত কোটি মানুষের পক্ষ হয়ে আমরা সকলকে জানিয়ে দেই, যার কণ্ঠে যতো জোর আছে আমরা একই সঙ্গে বলে উঠি ‘জয় বাংলা’। আজ থেকে ‘জয় বাংলা’কে আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তখন লাখো কণ্ঠে আওয়াজ উঠলো- ‘জয় বাংলা’। এখানেই শেষ নয়।

১৯৭১ সনের ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েই তার অবিস্মরণীয় বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। সিরাজুল আলম খান তার বইতে লিখেছেন- ‘জয় বাংলা’ কোনো দল বা ব্যক্তির স্লোগান নয়। এই স্লোগান ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্লোগান। এটা নিছক কোনো স্লোগান নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। যে স্লোগান বাঙালি জাতিকে করেছিল ঐক্যবদ্ধ।

No comments:

Post a Comment