Thursday, February 17, 2011

দেশীয় প্রযুক্তির যন্ত্র তৈরিতে মগ্ন বগুড়ার আমির হোসেন


।।বড়পুকুরিয়া খনির বিকল মেশিনগুলো কম খরচে সারাতে চান আমির।।

উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে কোটি কোটি টাকার ভারী মেশিনগুলো পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সম্পদ। অথচ খুব কম খরচেই মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে এসব মেশিন। শুধু দরকার সরকারের জরুরি পদপে। অনেকদিন ধরেই এ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে যন্ত্র বিজ্ঞানী আমির হোসেনের মাথায়। তবে সরকারের সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন।

বগুড়ার মেধাবী যন্ত্রবিজ্ঞানী আমির হোসেনের গল্প বেশ কয়েক বছর আগের। আবিষ্কৃত যন্ত্রাংশ সমন্বয় করে দেশীয় প্রযুক্তিতে সুলভ মূল্যের চমৎকার মেশিন তৈরি করতে পারেন তিনি। বিশেষত একবার দেখেই অবিকল মেশিন বানাতে তার জুড়ি নেই।

সেই ১৯৯১ সালের কথা। ইট ও পাথর ভাঙ্গা মেশিন তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তারপরে আর পিছন ফিরে তাকাননি। একাধারে তৈরি করে চলেছেন নতুন নতুন সব তাক লাগানো মেশিন। গত ২০ বছরে তিনি কয়েক ডজন মেশিন তৈরি করেছেন। এসব মেশিন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিরক্তকর দৈহিক শ্রমকে লাঘব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সেমাই তৈরি মেশিন, ফিসফিড, পোলট্রি ফিড ও গো-খাদ্য অটো মেশিন, মিকচার মেশিন, ভুট্টা মাড়াই ও ভাঙ্গা মেশিন, শুঁটকি মাছ ও ঝিনুক খৈল ক্রাশার মেশিন, সিলিকান ভাঙ্গা অটো মেশিন, জৈব মিশ্র সার তৈরির সেমি অটো মেশিন, ড্রাম সিডার, বীজ বপনযন্ত্র, শস্য মাড়াই যন্ত্র, প্লাস্টিক পাইপ তৈরি মেশিন। এ ছাড়াও রয়েছে বড়ই, আদা-রসুন, মরিচ ও সস তৈরির অটো ক্রাশার মেশিন, আম, আনারস, টমেটো, কমলা লেবু ক্রাশার মেশিন। এসব যন্ত্র তৈরি করে তিনি ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন। তাকে নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। সর্বশেষ দেশীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে রেলগাড়ি ও জ্বালানি তেলবিহীন গাড়ি এবং অভিনব ধানকাটা মেশিন তৈরি তাকে ব্যাপক আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

শুরুর কথা :
বগুড়া শহরের ঠিকাদারপাড়া লেনের আমির হোসেন উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন যন্ত্র আবিষ্কারের প্রেরণা। তার বাবা ধলু মেকার ছিলেন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক। ১৯৪০ সালে তার বাবা প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ গড়ে তোলেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তৎকালীন বগুড়ার ডিসির নির্দেশে ধলু মেকার সর্তকতামূলক সাইরান মেশিন তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে হস্তচালিত লেদ মেশিন তৈরি করে বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলে আলোচনায় আসেন।
১৯৮৮ সালের ১৩ নভেম্বর ধলু মেকারের মৃত্যুর পর রহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের দায়িত্ব নেন ছেলে আমির হোসেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই ৮ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান আমির হোসেন শুরু করেন অসাধ্য গবেষণা।

শিক্ষা ও প্রশিণ :
যন্ত্রবিজ্ঞানী আমির হোসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ২০০৩ সালে বিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি ও জিটিজেড থেকে কৃষি সামগ্রী উদ্ভাবনের ওপর প্রশিণ নেন। তার প্রশিণ কাজে সহায়তা করেন দ্বিতীয় মেয়ে আসমা খানম আশা ও তৃতীয় মেয়ে তাহিয়া খানম। মেয়ে আসমা খানম আশা বুয়েট থেকে বিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পদকও পেয়েছেন। প্রথম মেয়ে আমনিরা খানম এলএলবিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবাকে সাহায্য করেন। 

চমৎকার সব উদ্ভাবন
জ্বালানিবিহীন গাড়ি : আড়াইশ’ কিলোগ্রাম (কেজি) ওজনের জ্বালানিবিহীন গাড়িটি যেমন পরিবেশবান্ধব তেমনি তৈরি হয়েছে দেশীয় যন্ত্রাংশে। চালকসহ ৫ জন যাত্রী নিয়ে এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। চলার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এতে ব্যবহার করা ১২ ভোল্টের ৫টি সেকেন্ডারি সেল রির্চাজ হবে। আর ৬০ ভোল্টের ডিসি মোটর টেনে নিয়ে যাবে গাড়িটি। তেল-মবিল লাগবে না। দাম মাত্র পড়বে মাত্র আড়াই লাখ টাকা। হিটলার ও রানী এলিজাবেথের ব্যবহার করা দুটো গাড়ির অনুকরণে এর মডেল করা হয়েছে। অভিনব এ গাড়িটি এখন রয়েছে ছাড়পত্রের অপোয়। এছাড়াও নিত্য-নতুন গাড়ি তৈরির সর্বশেষ গবেষণার মধ্যে রয়েছে ১২০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন জ্বালানিবিহিন গাড়ি।

জৈব ও মিশ্র সার : দেড় থেকে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের অটো জৈব ও মিশ্র সার তৈরির মেশিন নিয়ে সারাদেশে আলোচনা চলছে। প্রকার ভেদে প্রতি মেশিন থেকে একশ’ কেজি থেকে ১ টন পর্যন্ত সার তৈরি হয়। এরমধ্যেই মেশিনটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ কৃষকরাও সুফল পাচ্ছে বেশ।

ফিস ও পোলট্রি ফিড : দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ফিস ও পোলট্রি ফিড তৈরির মেশিন ব্যবহার করছেন। বর্তমানে এর ডিজাইন আধুনিক করা হয়েছে। প্রকার ভেদে দাম পড়ছে ২৫ হাজার থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত।

যন্ত্রবিজ্ঞানী আমির হোসেনের সর্বশেষ উদ্ভাবনে তালিকায় রয়েছে অটো ব্রিকস মেশিন। গণচীনের তৈরি অটো ব্রিকস মেশিনের চেয়ে উন্নত ধরনের মেশিন তৈরি করেছেন যন্ত্রবিজ্ঞানী আমির হোসেন। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো মেশিনটি তৈরি করলেও গত ২০০৯ সালে আরও আধুনিক করা হয়েছে। আগে বিদ্যুৎ ও ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে চালানো হলেও বর্তমানে ২টি শ্যালো দিয়ে চালানো হচ্ছে। এতে ২০ জন লোকের প্রয়োজন হয়। ঘণ্টায় দেড় হাজার থেকে ২ হাজার ইট ভাঙা হচ্ছে। এতে জ্বালানি লাগবে মাত্র ৩ লিটার। দাম ধরা হয়েছে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। এটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়া যায়। এছাড়াও ধান কাটার মেশিন তৈরি কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা করবে বলে মনে করছেন তিনি। উদ্ভাবিত মেশিনটি ঘণ্টায় অর্ধবিঘা জমির ধান কাটা যাবে মেশিনটি দিয়ে। লাগবে মাত্র ২ লিটার পেট্রল। মেশিনটির ওজন ১৫ কিলোগ্রামের বেশি নয়। মূল্যও ১০ হাজার টাকার নিচে। যন্ত্রটির বিশেষত হলো ধান গাছ দাঁড়িয়ে বা পড়ে থাকা অবস্থাতেই কাটা সম্ভব। মেশিনর ডিজাইন আরও আধুনিক ও দামে আরও সস্তা করার জন্য সরকারের সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন যন্ত্রবিজ্ঞানী আমির হোসেন। বর্তমানে সোলার (সৌরশক্তি) পাওয়ারের সাহায্যে মেশিন চালানোর জন্য গবেষণা করছেন। নিরন্তন আবিষ্কারের নেশায় মগ্ন যন্ত্রবিজ্ঞানী আমিন হোসেন। তিনি বাতাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ আরও কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ মেশিন উদ্ভাবনে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমির হোসেন যা বলেন, নিরন্তন এ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি নিভৃতে। কেউ পাশে নেই। কখনও গচ্ছিত টাকায় কখনও স্ত্রীর গহনা বিক্রি কিংবা ঋণ নিয়ে তৈরি করছি এসব মেশিন। বিদেশি প্রযুক্তির গোলামে পরিণত হয়েছি আমরা। দেশীয় প্রযুক্তিতে ফেলে দেয়া যন্ত্রাংশ থেকেই তৈরি হতে পারে চমৎকার সব মেশিন। এসব মেশিন আমাদের কৃষি ও শিল্পখাতকে বদলে দিতে পারে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, সরকারি কোন পৃষ্টপোষকতা নেই, নেই সুদবিহীন ঋণের কোন ব্যবস্থা। এসব করতে পারলে দেশীয় প্রযুক্তিবিদরা দেশকে বদলে দিতে পারত।

No comments:

Post a Comment