Thursday, January 23, 2014

হবিগঞ্জের শুটকি রপ্তানি হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে

হবিগঞ্জ: হবিগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেটবাসীর অত্যন্ত প্রিয় খাবার হল শুটকি মাছ। প্রতিদিনের খাবার তালিকায় একটি শুটকির আইটেম না থাকলে কেমন জানি খাবার অসম্পুর্ণ থেকে যায়। কয়েকদিন খাবার তালিকায় এই আইটেমটি না থাকলে তারা রীতিমত হাঁফিয়ে উঠেন। তখন রুচির পরিবর্তনের জন্য হলেও চাই শুটকির তরকারী। তবে তাদের কাছে বেশী পছন্দ হলো হাওড়ের দেশী বা মিঠা পানির মাছের শুটকি। সিলেটবাসী পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকেন না কেন তাদের এই শুটকি চাই-ই চাই।

দেশীয় মাছের এই শুটকির ব্যাপক চাহিদায় হবিগঞ্জের হাওড় অঞ্চলে গড়ে উঠেছে শুটকি শিল্প। শুটকি উৎপাদন করে হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গ ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার প্রায় দুই হাজার পরিবার স্বচ্ছলতা পেয়েছে। আর শুটকি বিপননের সাথে জড়িত থেকে আরও কয়েক হাজার মানুষ জীবিকা অর্জন করছেন। এই শুটকি মাছ দেশের সীমানা ছেড়ে ব্রিটেন, আমেরিকা, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে নিয়মিত। অনেকেই ডাক বিভাগের মাধ্যমে প্রতিদিনই শত শত কেজি শুটকি বিদেশে পাঠাচ্ছেন। দেশ থেকে প্রবাসে যাওয়ার সময় প্রায় সকলের লাগেজই থাকে এই শুটকি মাছ।

বর্ষা শেষে হেমন্তের শুরুতেই যখন কমতে থাকে তখন হাওড় ও বিলের আহরিত মাছ দিয়ে শুটকি তৈরি করা হয়। এখানকার শুটকিতে কোন কেমিক্যাল মেশানো হয় না। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে হাওড়ে মাচান তৈরি করে এই শুটকি উৎপাদন করা হয়। এই শিল্পের সাথে জড়িত অধিকাংশরাই হলেন মহিলা। পুরুষ লোকজন মাছ আহরনের কাজে জড়িত থাকলেও প্রক্রিয়া করণের সাথে জড়িত থাকেন মহিলারা। ফর্মালিনমুক্ত এখানকার শুটকি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ ছাড়াও ইউরোপ,আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। 

হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার হাওর ও বিল বেষ্ঠিত এলাকা। এখানকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়সহ স্থানীয় বাসিন্দারা হাওর-বিল থেকে মাছ ক্রয় করে এনে শুটকি উৎপাদন করেন। এই দুই উপজেলায় প্রায় ২ হাজার পরিবার এ পেশার সাথে জড়িত। আশ্বিন মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত শুটকি উৎপাদনের মৌসুম হিসেবে ধরে নেয়া হয়। আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ প্রথমে পরিস্কার করে কাটা হয়। পরে লবণ মেখে তা ডাঙ্গায় মাচান তৈরি করে শুকানো হয়। এই কাজে শুটকি উৎপাদনকারী পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও গ্রামের কর্মহীন পুরুষ, কিশোরী ও মহিলা শ্রমিকরা কাজ করে। এ পেশায় জড়িত ও সংশি¬ষ্টরা স্বচ্ছলভাবে জীবন-যাপন করছেন। আর অনেকেই এ ব্যবসা করে নিজের ও পরিবারের ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছেন। 

হবিগঞ্জের শুটকি দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এর কদর রয়েছে। বানিয়াচং উপজেলার বাঘহাতা, গাজীপুর, শান্তিপুর, ভাটিপাড়া, সুনারু, নাগুরা ও আজমিরিগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাও, নোয়াগড়, বিরাট, কোদালিয়া, বদলপুর রয়েছে শুটকি প্রক্রিয়াজাত করণের রয়েছে অসংখ্য ডাঙ্গা। ডাঙ্গায় দেশীয় প্রজাতির পুঁটি, চিংড়ি, কাকিয়া, শইল, গজার, টাকি, বাইম, টেংরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির শুটকি তৈরি করা হয়। 

আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বিরাট গ্রামর শুটকি উৎপাদনকারী মোবারক মিয়া জানান, প্রতিকেজি ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা এবং বড় মাছের শুটকি ১ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। শুটকি ব্যবসায়ী আজমান আলী জানান, শুটকির মৌসুম ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে শুটকি রাখার মত কোন গুদাম নেই। সরকারি ভাবে কোন গুদামের ব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই শুটকি সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। তিনি আরও জানান, হবিগঞ্জে হাওড়ের মিঠা পানির মাছের শুটকি ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে আসা সামুদ্রিক মাছের শুটকিও বিক্রি হয়। তবে সামুদ্রিক মাছের চেয়ে মিঠা পানির শুটকির চাহিদাই বেশী। 

আজমিরীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুরে আলম সিদ্দিকী জানান, হবিগঞ্জের শুটকির বহু সুনাম রয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশ-এর কদর রয়েছে। তিনি জানান, কৃষি অফিস থেকে শুটকি উৎপাদনকারীদের বিভিন্ন সময়ে টেকনিক্যাল সার্পোট দিয়ে থাকি। তবে সরকারিভাবে যদি কোন ধরণের সুযোগ দেয়ার সুবিধা থাকে তাহলে অবশ্যই তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। 

বানিয়াচঙ্গ উপজেলার সবিদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম জানান, হাওড়ে যখন মাছ আহরণের মৌসুম শুরু হয় তখন মাছের দাম অনেক কমে যায়। তখন সেই মাছ বিক্রি না করে শুটকি করা হয়। এর মাধ্যমে তার এলাকায় শত শত লোক জীবিকা নির্বাহ করছেন। বাইর থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে শুটকি নিয়ে যান।

বানিয়াচঙ্গ উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল খান জানান, হাওড়ের মাধ্যমে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন তারাই এই শুটকি শিল্পের সাথে জড়িত। এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। তবে লোকজন যদি ব্যাপক হারে পোনা মাছ নিধন না করতো তাহলে আরও বেশী পরিমাণ শুটকি উৎপাদন করা যেত। 

এখন হবিগঞ্জে শুটকির ভরা মৌসুম। হবিগঞ্জ থেকে বানিয়াচঙ্গে যাওয়ার পথে রাস্তার পাশেই দেখা যাবে শুটকি তৈরির কাজ করছেন অনেক পুরুষ আর মহিলা। যদি সরকারি পৃষ্ঠ-পোষকতা পাওয়া যায় তাহলে শুটকির বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে বলে শুটকি উৎপাদনকারীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 

No comments:

Post a Comment