পাবনা: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পনগরী পাবনা বিসিকের বন্ধ কারখানাগুলো ফের চালু হতে শুরু করেছে। বন্ধ শিল্প ইউনিটগুলো চালু হওয়ায় শিল্পনগরীটিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা পাবনা বিসিক শিল্পনগরী এখন সম্ভাবনার পথে হাঁটছে।
১৯৬২ সালে পাবনা সদর উপজেলার ছাতিয়ানী এলাকায় ১০৯ দশমিক ৬৮ একর জমির ওপর প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পাবনা বিসিক শিল্পনগরী’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে বর্তমানে ৯২ দশমিক ০৯ একর জমিতে ৪৬৮টি শিল্প ইউনিটের জন্য প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতি একর জমির ইজারা মূল্য ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে যা আছে : এই শিল্পনগরীতে রাইস মিল, ডাল মিল, ফ্লাওয়ার মিল, সেমাই ও সুজি মিল, আইসক্রিম-বেকারি মিল, হালকা প্রকৌশল কারখানা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি ইউনিটসহ বেশ কয়েকটি আয়ুর্বেদিক ও কেমিক্যাল কারখানা, দুটি প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং কারখানা, একটি ইলেক্ট্রনিক্স কারখানা, একটি টেক্সটাইল মিল, ৭টি টুইস্টিং কারখানা, একটি ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য চালু শিল্প ইউনিটগুলোতে বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
অধিকাংশ শিল্প ইউনিট চালু : বিসিক সূত্র জানায়, শিল্পনগরীতে মোট শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ১৬৯টি। বর্তমানে চালু রয়েছে ১৫৭টি ইউনিট। বন্ধ রয়েছে মাত্র ৮টি এবং নির্মাণাধীন রয়েছে ৪টি শিল্প ইউনিট। এ ছাড়া গত এক বছরে বন্ধ থাকা ৫টি শিল্প কারখানা পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে বলেও কর্মকর্তারা জানান।
সূত্র আরও জানায়, পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৭৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে এই শিল্পনগরীতে বছর উৎপাদন হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী। বিভিন্ন খাতে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয় হচ্ছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এই শিল্পনগরীতে বর্তমানে মোট ৪ হাজার ৪৪০ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বন্ধ ৮টি শিল্প ইউনিট : মামলাজনিত কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ৮টি শিল্প ইউনিট। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট টেক্সটাইল মিল ১৫ বছর, পাবনা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১২ বছর, তৃষ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১২ বছর, গোল্ডেন ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১০ বছর, শিপ্রা টেক্সটাইল মিল ১১ বছর, টেকনোটেক টেক্সটাইল মিল ১০ বছর, শুভ রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১১ বছর ও উডল্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড এর ২ নাম্বার ইউনিটটি প্রায় ১২ বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে।
বছরের পর বছর ধরে এই কারখানাগুলো বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাবিবুর রহমান জানান, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াই এর প্রধান কারণ। এর ফলে একদিকে যেমন বন্ধ কারখানাগুলো উৎপাদনে যেতে পারছে না, অন্যদিকে যারা উৎপাদনে যেতে পারবে না সেই স্থানগুলোও আগ্রহী কারখানাকে স্থানান্তর সম্ভব হচ্ছে না। মামলাগুলো নিষ্পত্তি হলে মালিকানা হস্তান্তর করা সম্ভব হবে। নতুন মালিকরা দ্রুত কারখানাগুলো চালু করে উৎপাদনে যেতে পারবেন।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রম : বিভিন্ন কারখানা স্থাপন ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে বিভিন্ন ট্রেডে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স, উডওয়ার্ক, ওয়েল্ডিং, ফিটিং কাম মেশিন শপ, সেলাই, ব্লক অ্যান্ড বুটিক প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারিসহ বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিসিকের নৈপুণ্য বিকাশ কেন্দ্রের নামে এই প্রশিক্ষণে বর্তমানে ২০ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন।
কর্মকর্তা-কর্মচারী : পাবনা বিসিকে অফিস রয়েছে দুটি। একটি হলো শিল্পনগরী অফিস ও অপরটি শিল্প সহায়ক অফিস। শিল্পনগরী অফিসে দুইজন কর্মকর্তার জায়গায় আছেন একজন। কর্মচারী ৬ জনের স্থলে আছেন ৫ জন। শিল্প সহায়ক অফিসে কর্মকর্তা ১১ জনের মধ্যে আছেন ৫ জন। ৮ জন কর্মচারীর মধ্যে আছেন ৭ জন।
সমস্যা : সম্ভাবনার পরেও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে পাবনা বিসিকে। পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর স্টেট অফিসার জেএন পাল জানান, বর্তমানে শিল্পনগরীতে বরাদ্দযোগ্য কোনো প্লট না থাকায় শতাধিক নতুন আবেদনকারীকে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ১০৯ দশমিক ৬৮ একর জমির উপরে স্থাপিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শিল্পনগরীতে অভ্যন্তরীণ রাস্তার পরিমাণ ৪.৪০ কিলোমিটার ও ড্রেনের পরিমাণ ৮ কিলোমিটার। প্রয়োজনীয় মেরামতের অভাবে রাস্তাগুলো যান চলাচলের প্রায় অনুপোযোগী। ড্রেনগুলো দিয়ে ঠিকমতো বর্জ্য নিষ্কাশন হয় না। বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খাতে মাত্র ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা খুবই অপ্রতুল ও হাস্যকর। পাবনা শিল্পনগরীর কার্যালয় থেকে রাস্তা ও ড্রেন মেরামতের জন্য বারবার প্রাক্কলন প্রেরণ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।
যা করা প্রয়োজন : পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাবিবুর রহমান ও স্টেট অফিসার জেএন পাল জানান, শিল্পনগরীটি সম্প্রসারণের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে ইতোপূর্বে সাইট সিলেকশনসহ প্রয়োজনীয় বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ, উদ্যোক্তা আর বিনিয়োগকারীদের সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা, আরও অধিক জায়গা অধিগ্রহণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারিভাবে বিসিকের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা ও পাবনা বিসিকের মধ্যে ব্যাংকের একটি শাখা স্থাপনসহ সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা পেলে শিল্পনগরীটি দেশের মধ্যে সেরা অবস্থানে উঠে আসবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছেন।
No comments:
Post a Comment