মুন্সিগঞ্জ: দেশে আলু উৎপাদনের সর্ববৃহৎ জেলা মুন্সিগঞ্জে এখন আলুর ভরা মৌসুম। রাস্তার দু’পাশে আলু আর আলু। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই বিস্তৃত জমিতে শুধুই আলু। কিন্তু দরপতনের কারণে এবং ক্রেতার অভাবে এই ভরা মৌসুমেও কৃষকরা জমি থেকে আলু খুব একটা তুলছেন না।
অন্যান্য বছর এ সময়ে জমিতে আলু বেচা-কেনার হিড়িক পড়ে যেতো। কিন্তু এবার জমিতে ক্রেতা নেই। ফলে এলাকার চাষীরা তাদের কষ্টার্জিত আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। জেলার টঙ্গিবাড়ি, লৌহজং, সিরাজদিখান ও সদর উপজেলায় আলুর জমি ঘুরে আলু চাষীদের হতাশাগ্রস্ত দেখা গেছে।
মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল জানান, আলুর দরপতনে মুন্সিগঞ্জের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। অনেক প্রান্তিক চাষী নিঃস্ব হয়ে যাবে। এসব পরিস্থিতি উল্লেখ করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে আলুর রপ্তানিসহ এর বহুমুখী ব্যবহারে প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, মুন্সিগঞ্জে আলু প্রসেসিং জোন করা এবং প্রান্তিক কৃষক যাতে আলুর ন্যায্য মূল্য পায় সে লক্ষ্যে এবং পটেটো-বেজ্ড শিল্প স্থাপন এবং পর্যাপ্ত হিমাগার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাজারজাতের জন্য নৌ এবং সড়ক পথ আরো উপযোগী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক কাজী হাবিবুর রহমান জানান, মুন্সিগঞ্জ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে আলু আবাদ হয়। তাই বাজারে চাহিদার তুলনায় আলু আমদানি বেশী হচ্ছে। তবে হিমাগারে আলু সংরক্ষণ হওয়া শুরু হলেই আলুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি মনে করেন, আলুর বহুমুখী ব্যবহার ও বিদেশে রফতানির পাশাপাশি কৃষকের লোকসান কমিয়ে আনতে আলুর চাষ কমাতে হবে। তিনি বলেন, আলুর পরিবর্তে পিঁয়াজ, রসুন, গম, সরিষা, ভুট্টা, তিল, কাউন চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই কৃষি বিভাগ কাজ শুরু করেছে। গত কয়েক বছর ধরে কৃষকদের আলু আবাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে আনতে বিকল্প চাষাবাদ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাচ্ছে না। এ ছাড়া তিনি কৃষকদের ঘরে বা মাচা করে স্থানীয় কৌশলে আলু সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ৩৫ হাজার ২০১ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মুন্সিগঞ্জের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয় ৩৭ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমিতে। জেলায় মোট ৬৪ হাজার ৯৪৬ হেক্টর আবাদী জমি রয়েছে। অর্থাৎ মোট জমির ৫৮ দশমিক ১৫ শতাংশে আলু উৎপাদন হয়েছে।
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬ লাখ ৯২ হাজার ২০ টন হলেও ধারণা করা হচ্ছে ১২ লাখ টনেরও বেশী আলু উৎপাদন হবে।
গত মৌসুমে ৩৭ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে ফলন হয়েছিল ১২ লাখ ৫০ হাজার ৭০৪ টন। এখানে কৃষকের আলু উৎপাদনে কেজি প্রতি খরচ পড়েছে ৭ টাকা থেকে ৯ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে আলুর দর মাঠে কেজি প্রতি সাড়ে ৪ টাকা। আড়তে কেজি প্রতি ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা। খুচরা বাজারে কেজি প্রতি ৮ টাকা। জেলার ৭১টির মধ্যে সচল ৬৫টি হিমাগারে আলুর ধারণ ক্ষমতা ৪ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। জেলার ৭৮ হাজার কৃষক আলু চাষের সাথে সরাসরি জড়িত। আলুচাষীরা জানান, এখানে মানসম্মত হিমাগার আরো প্রয়োজন। বিশেষ করে বীজ সংরক্ষণের বিশেষ কোন হিমাগার এখানে নেই।
বিএডিসি ডিলারদের জেলা সভাপতি মোবারক হোসেন জানান, শিগগির যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে আলুভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল মুন্সিগঞ্জ জেলা তথা দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
জেলা আলু চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসোন জানান, বিঘা প্রতি অন্তত ১৫ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে কৃষকদের।
এ দিকে আলুর দরপতনে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ফড়িয়াদের হাত রয়েছে বলে মনে করছেন মুন্সিগঞ্জের কৃষকেরা।
সদর উপজেলার সাতানিখিলের কৃষক আব্দুল মালেক জানিয়েছেন, ফড়িয়ারা সিন্ডিকেট করে দাম আরো কমানোর চেষ্টা করছে। মাঠে এখন আলু বিক্রি করাই যাচ্ছে না। কোনভাবেই ক্রেতা মিলছে না।
কিন্তু সদর উপজেলার কাটাখালীর কহিনূর হিমাগারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উত্তম সাহা বলেছেন, সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। এবারো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আলুর আবাদ বেশী হয়েছে। লাগাতার হরতাল ও অবরোধে উত্তরাঞ্চলের অনেক আলু হিমাগার থেকে বের হতে পারেনি। বাজারজাত সংকটের কারণে অনেক জমির আগাম আলু জমি থেকে উঠাতে বিলম্ব করা হয়। এসব কারণে এক সাথে সব আলু বাজারে আসছে। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ আলু বাজারে আসায় এই দরপতন ঘটেছে।
সদর উপজেলার নূরাইতলী গ্রামের ফড়িয়া বা আলু ক্রেতা মো. আব্দুল হালিম ও মনির হোসেন ব্যাপারী জানান, তারা দাম কমানোর জন্য নয় চাহিদার তুলনায় আমদানি বেশী হওয়ায় আলু কিনছেন না।
জানা গেছে, অন্যান্য বছর ফড়িয়ারা যেখানে চাষীদের পেছনে পেছনে ছুটতেন এবার তাদের দেখাই মিলছে না। দাম কমানোর জন্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এমনটি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ কৃষক।
কৃষক বেলায়েত হোসেন বলেন, আলু উত্তোলনের জন্য শ্রমিক খরচ রয়েছে। কিন্তু দাম এতটাই পড়ে গেছে যে, আলু উত্তোলন করে এবং আড়তে নেয়ার পর যে দাম পাওয়া যাবে তাতে পোষাবে না।
কৃষিবিদ কাজী হাবিবুর রহমান মনে করেন, দ্রুত আলুর বাজার স্থিতিশীল করার জন্য জরুরিভিত্তিতে ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে আলু বিতরণ করা প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment