মুন্সীগঞ্জ: বাংলাদেশের সুয়েজ খাল হিসেবে পরিচিত মুন্সীগঞ্জের তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল জৌলুসহীন হয়ে পড়ছে। নাব্যতা সঙ্কটে লঞ্চ তো দূরের কথা ছোট নৌকা চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও রাজবাড়িসহ বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও মুন্সীগঞ্জ জেলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা ও ধলেশ্বরীর সংযোগ খালটির ¯্রােতধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদী ভাঙ্গন প্রকট হচ্ছে। এই খালের মুখে লৌহজং উপজেলার ডহরী ও বড় মোকাম এলাকায় আসন্ন বর্ষায় নদী ভাঙ্গন ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
খালটি অচল থাকার কারণে কৃষি জমির সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত, বর্ষার পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় দু’পাশের গ্রাম ও কয়েক হাজার একর কৃষি জমি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির বিভিন্ন অংশ বেদখল হওয়াতে এর আকার ছোট হয়ে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ খালের এই নাজুক অবস্থার কারণে পরিবেশে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এতে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান, খালটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ড্রেজিং জরুরি হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিং না হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ¯্রােতধারা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এ খাল এখন দেখ-ভাল করছে বিএডিসি।
বিএডিসির সহাকারী প্রকৌশলী (সেচ) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘খালটির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কেউ আমাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করেনি। তাই এ ব্যাপারে আমরা কিছুই করতে পারছি না। তাছাড়া খালটি বিএডিসির আওতায় কি-না তাও আমি নিশ্চিত নই। কারণ ৩০ ফুটের বেশি প্রশ্বস্ত খাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায়।
জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, ‘তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল এবং এর সাথে যুক্ত ইছামতি নদীর গুরুত্ব উল্লেখ করে এর যৌবন ফিরিয়ে আনতে সরকারকে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।’
টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বালিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘একদা বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের মালবাহী নৌকা ও অন্যান্য নৌযান অতি সহজে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করতো এই খাল দিয়ে। এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। বেশ কয়েক বছর ধরে এই খালে লঞ্চ বা বড় নৌকা চলাচল করতে পারছে না। নাব্যতার অভাবে ছোট নৌকাও আটকে থাকে।
¯্রােত না থাকায় জমিগুলোতে যথাযথ পলি আসছে না। তাই আমরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। অন্তত কৃষকের জন্য খালটি ড্রেজিং করা জরুরি।’ খালপাড়ের অন্য বাসিন্দারা জানান, ‘এই খালের ¯্রােতধারা বন্ধ হওয়ার কারণেই ধলেশ্বরী-ইছামতিও মরে যাচ্ছে। খাল মরে যাওয়ায় তালতলা থেকে বেতকা হয়ে আবদুল্লাহপুর থেকে মিরকাদিম বন্দর পর্যন্ত খর¯্রােতা ইছামতিও মরে গেছে। ১২ মাস এই নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করতো। এখন সেই লঞ্চঘাট শুকনো স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।’
এই খালের তীরে ৬টি হিমাগার স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু খালের করুণ দশায় বিপাকে পড়েছে এসব হিমাগার। এই ৬টি হিমাগার ছাড়াও ইছামতি তীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন হিমাগার ও বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানই বিপাকে পড়েছে। এই খাল ও ইছামতি নদী ঘিরে গড়ে উঠা দেশের সর্ববৃহত আলু এবং কাঁচামালের আরত, বেতকা হাট, আবদুল্লাপুর বাজার, তালতলা বাজার, মিরকাদিম বন্দর, সুবচনী বাজার, বালিগাঁও বাজার, ডহরী বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খালটির তীরে গড়ে উঠা ধলেশ্বরী হিমাগারের পরিচালক অভিজিৎ দাস ববি বলেন, ‘খালে পানি না থাায় আলু মৌসুমে কৃষক পানি দিতে পারে না। এই খালের দু’পাশের বিস্তীর্ণ জমিতে হাজার হাজার টন আলু ও বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু নৌ-যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় তা বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাত করতে কৃষকরা নানা বিড়ম্বনায় পড়ছেন। সাথে ক্ষতির মুখে পড়ছি হিমাগার মালিকরাও।’
নদী তীরের অনেক হাট-বাজার থেকে পণ্য রাজধানী ঢাকায় যেত এই খাল ধরে। একইভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য সহজে এসব অঞ্চলে পৌঁছতে এই খাল ব্যবহার করে। খালটি চলাচল অযোগ্য হওয়ায় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার নদীপথ ঘুরে মোহনপুর, ষাটনল, জগারিয়া পাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীতে আসতে হচ্ছে। এতে গরু-ছাগল, উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারজাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়সহ ঝুকি বেড়েছে।
এ ছাড়াও এই খালের প্রবাহ পদ্মার সঙ্গে বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৩ সাল থেকে লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী থানার নদীভাঙন প্রবল হয়েছে। আগে এই খাল দিয়ে ধলেশ্বরী থেকে ধেয়ে আসা পানির স্রোত উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে নেমে পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা পদ্মার স্রোতকে আঘাত হানতো। ফলে পদ্মার স্রোত কিছুটা দুর্বল হয়ে মাঝ নদী দিয়ে মেঘনায় গিয়ে পড়তো। এখন শ্রীনগর-লৌহজং খালের প্রবাহ বন্ধ থাকায় আরিচা থেকে ধেয়ে আসা যমুনা ও গঙ্গার প্রবল স্রোতধারা পদ্মা দিয়ে সজোরে লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মাটিতে আঘাত হানছে। ফলে নদীভাঙন প্রবল হয়েছে। ফলে গত দেড় দশকে শ্রীনগর-লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার অনেক গ্রাম ও ইউনিয়ন পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়েছে। বহু লোক ভূমিহীন, গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
এই খালের প্রবাহ পদ্মার মুখে যখন বালি-পলি জমে বন্ধ হতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই তা কেটে দিলে এত বড় সর্বনাশ হতো না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানি আরিফুর রহমান।
মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ জানান, এই খালের ¯্রােতধারা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার এই খাল রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তারা আশা করেন।
No comments:
Post a Comment