বরগুনা: বরগুনার আমতলী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহ আলম প্রায়শই অভিযোগ করেন, গ্রাম কিংবা শহরের স্থানীয় মানুষগুলোর কাছে গেলে তাদের প্রথম তারা জিজ্ঞাসা করতো, আপনারা ‘কী দেবেন?’ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর-আইলার পর উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের মধ্যে এক ধরনের ত্রাণ নির্ভরশীলতা তৈরী হয়েছিল। ক্রমে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। সেসময়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন, অপরিকল্পিত ও অপরিমিত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ স্থানীয় মানুষের স্বভাবই পাল্টে দেয়। ফলে দুর্নামের ভাগীদার হয়েছে সাধারণ মানুষ।
এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটাতে কৃষি, মৎস্য বিভাগ, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী, ভূমি দপ্তর, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারী সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ও আরপাঙ্গাশিয়া দু’টি ইউনিয়নে রিকল নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এনএসএস নামের একটি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা। রিকল প্রকল্পের আওতায় আসা মানুষগুলোর জীবন ও মানসিকতায় পরিবর্তনও এসেছে ব্যাপক। তারা এখন আর হাত পাতেন না। বাইরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বসে না থেকে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা নিরুপন করেন এবং নিজেদের সক্ষমতা দিয়েই তা সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন।
রিকল প্রকল্পে উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশাখালী ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ ২৭টি সিবিও’র (কমিউনিটি বেজড অরগানাইজেশন/ উপকারভোগী সংগঠন) অন্তর্ভূক্ত হয়ে তাদের সমস্যা নিরুপন করেন ও তার সমাধানে সোস্যাল ম্যাপ তৈরী করেন। প্রতি সপ্তাহে সংগঠনের সভা ডেকে করণীয় নির্ধারণ করেন। প্রথমে তারা নিজেদের সম্পদ, সামর্থ ও সহযোগিতা দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালান। প্রয়োজনে সহায়তা নেন মূল সংস্থা এনএসএসর। সরকারী বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাসমূহের সাথে উপকারভোগী সংগঠনগুলোর (সিবিও’র) সংযোগ তৈরী করে দেয় এনএসএস। এভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তার মাধ্যমে ঐ দুই ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার এখন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ছুঁতে যাচ্ছে।
এনএসএস’র নির্বাহী পরিচালক অ্যাড. শাহাবুদ্দিন পান্না জানান, স্থানীয় মানুষগুলোর ত্রাণ মুখোপেক্ষি মনোভাব দূর করতেই মূলত আমরা সরাসরি সহায়তা দেই না। বছরের পর বছর ত্রাণ সহায়তা দেয়া বা পাওয়া সম্ভব নয়। তাদেরকে সংকট মোকাবেলায় সক্ষম করাই আমাদের লক্ষ্য। এনএসএস ঐ জনগোষ্ঠির মধ্যে জরুরী প্রয়োজনে নলকূপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা, হাঁস-মুরগী, গবাদিপশু, সার-বীজ অর্থসহায়তা প্রভৃতি দিয়েছে ঠিকই তবে তা কারা পাবে তা বাছাই করেছে সিবিও’র সদস্যরা। এখানে নিজে না নিয়ে যার বেশী প্রয়োজন তাকে দেয়ার একটা মানসিকতা তৈরী করতে সফলতা পাওয়া গেছে। এমনকি সিবিও’র বাইরেও মানবিক কারণে সহায়তা প্রদান করছেন সদস্যরা।
মানুষের অধিকার নিয়েও কাজ করছে ঐ সিবিওগুলো। ইতোমধ্যে খাসজমিতে ভূমিহীনদের প্রাপ্যতা ও জলমহালের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করছে তারা। জানালেন, আমতলীর পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মতিয়ার রহমান। উপজেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাড. এম এ কাদের মিয়া বলেন, রিকল প্রকল্পটি প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর মানুষদের সচেতন করেছে। আন্দোলন করতে শিখিয়েছে। তারা এখন আর বসে থাকে না। পথে নামা শিখেছে। প্রয়োজনে আমাদের মতো সামাজিক-রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরও তাদের আন্দোলনে শরিক করছে।
আমতলীর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান খান জানান, দূযোর্গপ্রবন এলাকা হিসেবে স্থানীয়রা সবসময়েই ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করেন। আমাদের মাধ্যমে সিবিও’র সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা আপদকালীন সময়ের জন্য খাদ্যভান্ডারও তৈরী করেছেন। দূযোর্গে তৎপরতামূলক মহড়া করছেন নিয়মিত। দূর্যোগে নিজেকে রক্ষাসহ অপরকে রক্ষা করার সক্ষমতাও তাদের হয়েছে।
আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশখালী ইউনিয়নের প্রতিটি পরিবারে এনএসএস হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরী করিয়েছে এবং এ কাজে আনুসাঙ্গিক মালামাল দিয়েছে। এটি একটি ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ। এ কারণে উপজেলার ঐ দু’টি ইউনিয়নে ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো রোগও কমে গেছে জানালেন, আমতলীর উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. একরামুল কবির।
স্বাবলম্বীতার জন্য নিজের সক্ষমতা প্রয়োজন। আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশখালী ইউনিয়নের স্থানীয় মানুষগুলোকে এই উপলব্ধি এনে দেয়ার জন্য এনএসএস’র কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য বললেন আমতলীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ। তিনি আরও বলেন, এ কার্যক্রমে আশপাশের ইউনিয়নের লোকজনও সচেতন হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment