Thursday, May 15, 2014

হবিগঞ্জের বাগুনীপাড়া গ্রামের কৃষক আ. কাইয়ুম সাথী ফসলে কোটিপতি

হবিগঞ্জ: রোদ-বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে কঠোর পরিশ্রমই হলো কৃষিকর্ম। যারা আরামপ্রিয় তারা এ কাজকর্ম এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু এই কষ্টের ভেতরেও যে আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে তা অনেকেই জানেন না। যারা এই কষ্টকে ধারণ করতে পারেন তারা কখনো ব্যর্থ হন না। সফলতা তাদের কাছে ধরা দেবেই। এর উদাহরণ হবিগঞ্জ সদর

উপজেলার বাগুনীপাড়া গ্রামের কৃষক আ. কাইয়ুম। কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার বিনিময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন কৃষি খামার। সেখানে সাথী ফসলের আবাদ করে পেয়েছেন আশাতীত সাফল্য। হয়েছেন শুন্য থেকে কোটিপতি। এলাকায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার এই সফলতায় কৃষি বিপ্লব ঘটেছে বাগুনিপাড়া গ্রামে।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বাগুনীপাড়া গ্রামের মো. আ. কাইয়ুম একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেছেন মাত্র ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। পৈত্রিক জমিজমা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ২ বিঘা জমিই ছিল তার সম্বল। জীবনের প্রথম দিকে সনাতন আবাদে এই জমিগুলো থেকে তেমন একটা লাভবান হতে পারতেন না তিনি। এক সময় জমিগুলোতে লাভের জন্য আখ চাষও করেছেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। তবে ১৯৯০ সালে তার ৫ শতক জমিতে বারির রুমা প্রজাতির টমেটো আবাদ করে আশাতীত সাফল্য পান। পেয়ে যান নতুন পথের সন্ধান। সেই সময়ে ৫শতক জমির টমেটো বিক্রি থেকে তার নীট লাভ হয় ৫ হাজার টাকা। 
এই মুনাফা দেখে কৃষক আ. কাইয়ুম কুষি বিভাগের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে শুরু করেন সবজি আবাদ। তবে সনাতন পদ্ধতিতে নয়। উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগাম সবজি আবাদে মনোযোগ দেন তিনি। একই জমিতে অধিক ফলন ও সারা বছর ফসল পেতে তিনি শুরু করেন সাথী ফষলের আবাদ। 

জমিতে টেংরাবাশ ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় মাচা। পৌষ ও মাঘ মাসে আবাদ করা হয় টমেটো। ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত ফসল পাওয়া যায়। চৈত্র মাসে সেখানে লাগানো হয় বরবটি। এই ফসল পাওয়া যায় বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত। আর আষাঢ় মাসে লাগানো হয় করলা। সেখান থেকেও দীর্ঘদিন ফসল পাওয়া যায়। পাশাপাশি একই মাচায় অন্যান্য সবজি আবাদ করা হয়। 
কৃষক আ. কাইয়ুম এ বছর টমেটো বিক্রি থেকে নীট আয় করেছেন ৮ লাখ টাকা। করলা থেকে আয় এসেছে ১ লাখ টাকা। বরবটি থেকে আয় আসবে ১ লাখ টাকা। বেগুন, সীম, লাউ ও চাউল কুমড়াসহ অন্যান্য ফসল থেকে আয় আসবে আরও ২ লাখ টাকা। তার খামারে প্রতিদিন কাজ করে ১২ জন শ্রমিক। তাদেরকে দেয়া হয় দৈনিক ৩শ' টাকা। যা অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশী মজুরি। খামারে তিনি জৈবিক সার বেশী ব্যবহার করেন। পোকা মাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে ব্যবহার করেন সেক্স ফেরোমন। 
কৃষক আ. কাইয়ুম জানান, এক সময় কৃষি কাজ করতে তাকে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন আর ঋণের প্রয়োজন নেই । কষ্ট করলে যে সফলতা আসবে সেই বিশ্বাস আমার ছিল। এখন অনেক লোক আমার কাছে আসে পরামর্শের জন্য। আমি সবাইকে পরামর্শ দেই। আমার এখানে যারা কাজ করে তারাও নিজেদের জমিতে ভাল সবজি আবাদ করছে। 

কৃষির আয় থেকে আ. কাইয়ুম তার সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। তার ৪ সন্তানের সকলেই এসএসসি পাশ করেছে। একজন পড়ছে কলেজে। এই আয়ে তার বাড়ীতে দালান উঠেছে। পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া ২ বিঘা জমি বেড়ে হয়েছে ১২ বিঘা। এর ৮ বিঘাতে আবাদ হয় সবজি এবং ৪ বিঘাতে আবাদ হয় ধান। ক্রয় করেছেন ১টা ট্রাক্টর, ১টা পাওয়ার ট্রিলার, ১টা মাড়াই মেশিন, ২টা অগভীর নলকুপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। তার এই সফলতায় গ্রামের প্রায় ৩শ’ কৃষক সবজির খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি নিয়মিত কৃষি বিভাগের পরামর্শ নেন এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে থাকেন। কৃষি খামার থেকে উৎপাদিত ফসল কিনতে অনেক সময় পাইকাররা ট্রাক নিয়ে আসেন আ. কাইয়ুম এর কাছে। এছাড়াও তিনি এই ফসল বিক্রি করেন, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও বি-বাড়ীয়া জেলার সরাইলে। 

আ. কাইয়ুমের জমিতে শ্রমিকের কাজ করা বাবুল, মুরাদ ও ময়না মিয়া জানায়, তারা এখানে কাজ করে ভাল পারিশ্রমিক পায়। কাজ করার পাশাপাশি নিজেদের জমিতেও সবজি আবাদ করছে তারা। 

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ ও নিউটন অধিকারী জানান, কৃষক আ. কাইয়ুম যে কোন সমস্যা দেখা দিলে কিংবা পরামর্শের প্রয়োজন হলে তিনি তাদের কাছে আসেন। এ ব্যাপারে তাকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হয়। আ. কাইয়ুম প্রমাণ করেছেন পরিশ্রক আর বুদ্ধি থাকলে দেশেই ভাল কিছু করা সম্ভব। 

হবিগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র সোম জানান, একজন কৃষক যদি বাড়িতে থেকেই বছরে ১২ লাখ টাকা মুনাফা করতে পারে সেটি কম কথা নয়। আ. কাইয়ুম পরিশ্রম আর সাধনা করে এই পর্যায়ে এসেছেন। তাকে যদি সবাই অনুসরণ করে তাহলে দেশে বেকারত্ব হ্্রাস পাওয়ার পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

No comments:

Post a Comment