ডেস্ক রিপোর্ট: কয়েক দশক আগেও গ্রামীণ নারীরা ঘরকন্যার কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগী পালন করে বাড়তি দু’পয়সা আয়-উপার্জন করতো। হালে নারীরা পোল্ট্রি শিল্পকে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। পোল্ট্রি শিল্প ছাড়াও নারী শ্রমিকরা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কৃষি কাজে। আগে সাধারণত গ্রামের পুরুষরা মাঠে কাজ করত। নারীরা তখন ঘরকন্যার পাশাপাশি কৃষি কাজে পুরুষের সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো (তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের ক্ষেত্রে আলাদা চিত্র)। ইদানীং দেশের অনেক জায়গায় প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কাজে নারীরা এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর জনপদে নারী শ্রমিকরা কৃষি কাজে পুুরুষের সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্প ও কৃষি কাজে নারীর এই অংশগ্রহণে নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলছে।
দেশে মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ। এদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। ৬৮ শতাংশ নারী কৃষি, পোল্ট্রি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কৃষি কাজে বীজ বপণ থেকে শুরু করে সার দেয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, এমনকি ফসল কাটায় নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকে আবার বাড়ির পাশে কিংবা উঠানে অনাবাদি জায়গায় শাক-সবজি, ফল-ফলাদির আবাদ করে সংসারে বাড়তি রোজগারের একটা পথ করে নিচ্ছে। এতে পরিবারের ভরণপোষণের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও তারা অনবদ্য ভূমিকা রাখছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে চা-শিল্পের মতো সমৃদ্ধ খাতের পিছনেও পাহাড়ি নারী চা শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন থেকে শুরু করে আজকে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান রয়েছে।
২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। এ সময়ে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য খাত, পশু, হাঁস-মুরগি পালন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১১৬ শতাংশ।
প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের কোন হিসেব নেই। এমনকি কৃষি কাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও করা হয় না। মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়।
ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব নারীর অবদানের স্বীকৃতি আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষিতে নারী শ্রমিক বা কিষানীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামীণ নারীর শ্রম নির্ঘণ্ট শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষ যারা কাজ করছে এবং কাজ করছে না কিন্তু কাজ খুঁজছে- এমন জনগোষ্ঠীর অংশকেই শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে ১ কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান। কৃষিতে নতুন কর্মসংস্থান নতুন কাজের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেও এ খাতের গতিশীলতা, ন্যায্য মজুরি অথবা কৃষিশ্রমিকের বাজারে প্রবেশগম্যতা কিছুতেই নিশ্চিত করে না। শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের কৃষকদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতথ্য থাকলেও কিষাণীদের কোনো সংখ্যাতথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে নেই। নারী কৃষিশ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষক হিসেবে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিও শ্লথ হয়ে পড়বে। কর্মজীবী নারী সংগঠনের নেতারা কৃষিশ্রম আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে একটি শ্রম কমিশন গঠন করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে। কৃষকের অধিকার আদায়ে কৃষি শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা ও সেই সঙ্গে একটি কৃষি কমিশনও গঠন করতে হবে। তারা বলেন, কৃষি খাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টিতে, অথচ কৃষি কাজে নারীর স্বীকৃতি নেই। আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষিব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষিশ্রমিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব। তারা নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সরকারি কৃষি কর্মকান্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিক তথা কিষাণীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন।
কৃষিতে নারী শ্রমিকদের অধিকার জাতীয় জীবনে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কতগুলো আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এতে মানুষ ও নাগরিক হিসেবে নারীর সমান অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালে ঘোষিত নারীর প্রতি বিরাজমান সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের দলিল যা সংক্ষেপে সিডও সনদ নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল 'অন্ন জোগায় নারী' এ স্লোগানটি। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে নারী উন্নয়নের সামগ্রিক রূপরেখা হিসেবে ‘বেইজিং ঘোষণা ও প্লাটফরম ফর অ্যাকশন’ গৃহীত হয়। নারী উন্নয়নের বৈশ্বিক নির্দেশিকা হিসেবে এ প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের আলোকে নিজ নিজ দেশে নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ এবং সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সব পরিমন্ডলে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করা। সেই সঙ্গে গৃহ, কর্মক্ষেত্র ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব পরিসরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং দায়দায়িত্ব সমবণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠিত করা। এরই আলোকে ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে।
দেশে প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে বৈষম্য থেকে এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর কাজের সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি আবশ্যক। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবে। এছাড়াও পোল্ট্রি খাতে নারী শ্রমিকের সংযোজন এ খাতকে আরো গতিশীল করে তুলবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিও দেখতে হবে।
No comments:
Post a Comment