ডেস্ক রিপোর্ট: দেশে সামগ্রিকভাবে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতিতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। তবে পুষ্টি পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি ঘটেনি।
বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মতে তীব্র অপুষ্টির কারণে দেশে প্রতি বছর ৬৫ হাজার শিশু মারা যায়। বর্তমানে ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ৫ লাখ শিশু অপুষ্টিজনিত নানা রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত। তারা মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব শিশুর চিকিৎসা সেবার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই।
স্বীকৃত যে, বরিশালসহ উপকূলীয় এলাকায় অপুষ্টির প্রকোপ সর্বাধিক। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে পঞ্চগড় জেলায় অপুষ্টির শিকার শিশুর সংখ্যা কম নয়। এখানকার শিশুরা অপুষ্টিজনিত নানা রোগব্যধিতে আক্রান্ত। তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার তেমন একটা ব্যবস্থা নেই।
রাজধানী ঢাকায় হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও এসব শিশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাই দেশের অন্যত্র শিশুর অপুষ্টিজনিত রোগব্যধির চিকিৎসা সীমিত হওয়াই স্বাভাবিক।
তাছাড়া পুষ্টি নিয়ে তেমন কর্মসূচিও নেই। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে কোনো কাজ করছে না। তা প্রকাশ পেয়েছে পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন ডা. মোজাম্মেল হকের কথায়। তার মতে এখানে অপুষ্টিজনিত রোগব্যধি তেমন একটা নেই। তিনি মনে করেন পুষ্টিহীনতার অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্য ঘাটতি। অজ্ঞতাও এর জন্য দায়ী। সজিনা ও কচু শাকে যে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে তা ক’জনে জানেন। এসব শাক-সবজি খেলে শুধু শিশু নয়, মায়েদেরও পুষ্টির ঘাটতি মেটে।
তেঁতুলিয়া উপজেলায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, শিশু ও মায়েদের ভিড়। তারা অনেকেই অপুষ্টির শিকার। উপজেলার কোম্পানিজোতে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী ফ্লোরেন্স হেলেন জানান, শিশুদের জিং জাতীয় ট্যাবলেট দেয়া হয়। এখানে পুষ্টি নিয়ে তেমন কোন কাজ হয় না। মায়েদের রক্তশূন্যতা দেখা দিলে আয়রন ট্যাবলেট দেয়া হয়। শিশুদের কৃমিনাশক ওষুধ দেয়া হয়। কৃমির কারণেও পুষ্টির অভাব দেখা দেয়।
পঞ্চগড়ে পুষ্টি নিয়ে হতাশা থাকলেও কোথাও কোথাও আলোর ঝলক দেখা যায়। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছেÑ পুষ্টিহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই পঞ্চগড়ের ১০টি গ্রামে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, পঞ্চগড়ে খলিদাপুর, কুমারপাড়া, নানিয়াপাড়া, সিপাইকামাত সরকারপাড়াসহ ১০টি গ্রামের অধিকাংশ মা-শিশু সারা বছরই অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছিলেন।
জাপানের আজিনমতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় ‘আজিনমতো পুষ্টি প্রকল্প’ নামে প্রকল্পে কাজ করছে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তারা মা ও শিশুদের পুষ্টির অবস্থা বাড়ানো, পুষ্টি উন্নয়ন বিষয়ক সচেতনতা ও ধারণা বৃদ্ধি, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধমে মারাত্মক অপুষ্টির শিকার মায়েদের পুষ্টি অবস্থার উন্নয়ন, দরিদ্র মায়েদের পুষ্টি অবস্থা স্থায়ীভাবে উন্নতি করা, আয়ের সুযোগ তৈরি করা, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের বাড়িতে পুষ্টিকর রান্নার মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া তারা এ প্রকল্প সফল করতে মা ও শিশুকে সপ্তাহে ৬ দিন রান্না করা খাদ্য সরবরাহ করছে।
পঞ্চগড়ে স্বেচ্ছাসেবী এই প্রতিষ্ঠানটি পুষ্টি নিয়ে কাজ করাতে সারাদেশে আশাব্যঞ্জক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, দেশের ১১ থেকে ১৬ বছর বয়েসী ৪৩ শতাংশ কিশোরী রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। এদের বেশির ভাগই আবার অল্প বয়সে বিয়ে করে গর্ভধারণ করে। এতে গর্ভের শিশুটিও অপুষ্টির শিকার হয়। এ চালচিত্র পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের প্রত্যেকটি জেলার।
অপুষ্টি থেকে শিশুদের মুক্ত করতে না পারলে তারা নানা রোগব্যধির শিকার হওয়াই স্বাভাবিক। স্মরণ রাখা দরকার আজকের শিশু ভবিষ্যতের নাগরিক, তারা পুষ্টির অভাবে নানা রোগ-ব্যধির শিকার হলে তা জাতির জন্য অমঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, অপুষ্টির কারণে প্রধান ৬টি রোগ হয়। রোগগুলো হলো হাড্ডিসার রোগ, গা ফোলা রোগ, রাতকানা রোগ, রক্তস্বল্পতা রোগ, জিহবা ও ঠোঁটের কোণে ঘা, আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা।
পুষ্টিবিদ ডা. শাহাজাদা সেলিম জানান, আমাদের দেশের অধিকাংশ শিশু আয়রণজনিত খাবারের অভাবে এ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য এবং পরিবারে পুষ্টিজ্ঞানের অভাব। জন্মের ৪ থেকে ৬ মাস পর আয়রণ সমৃদ্ধ বাড়তি খাবার না খেয়ে শুধু বুকের দুধ খেলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ সময় শুধু মায়ের দুধে আয়রণের অভাব পূরণ হয় না। কলিজা, মাংস, মাছ, মোটরশুঁটি, শিম, বরবটি, ডাল, বাদাম, সবুজ শাক-সবজিতে প্রচুর আয়রণ থাকে। এগুলো খেলে আয়রনের অভাব সহজে পূরণ করা যায়।
উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। শুধু অপুষ্টির কারণে প্রতি মিনিটে ১০টি শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছিলো ২০০৬ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে। জাতিসংঘের এমডিজি বা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হাত থেকে শিশুদের রক্ষায় একটি বাৎসরিক লক্ষ্যও স্থির করে দেয়া হয়েছিলো। সেই লক্ষ্য অর্জনে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের সংকল্পও ব্যক্ত করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।
২০১২ সালের ৮ আগস্ট লন্ডনে বিশ্ব পুষ্টি সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা বলেন, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অপুষ্টি কোন একক দেশের সমস্যা নয়। এর প্রভাব বিশ্বের সর্বত্র। তাই এসব বিষয়ে বৈশ্বিক জাতীয় পরিকল্পনা ও কৌশল বাস্তবায়নে গোটা বিশ্বের সম্পদের ব্যবহার, অভিজ্ঞতা বিনিময়, গবেষণা ও প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ ও কাজ করতে হবে। বাংলাদেশও এই অঙ্গীকারে শামিল।
দেশের ২৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টি ও রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। এদের ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ না নিলে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই পরিপূর্ণতা লাভ করবে না। এ কথা স্মরণ রেখেই সরকারকে পুষ্টি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে।
No comments:
Post a Comment