Friday, March 25, 2016

পণ্যের মান আর বৈচিত্র্য থাকলে মুনাফা নিয়ে ভাবতে হবে না

আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত উত্তরাঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠান রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেডের (আরএফএল) শুরু খাওয়ার পানির নলকূপ দিয়ে। এ নলকূপই এ প্রতিষ্ঠানের দেশব্যাপী পরিচিতি আনে। পরে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, পিভিসি পণ্যের উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণে আসে প্রতিষ্ঠানটি। সেই কম্পানি যুক্ত হয় আমজাদ খান চৌধুরীর প্রাণ গ্রুপের সঙ্গে। নাম হয় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, যার পণ্য এখন ৯৪টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আহসান খান চৌধুরীর মতে, চরম ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার মধ্যেও গুণগতমানের বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য উৎপাদন করতে পারলে মুনাফা নিয়ে ভাবতে হবে না। তরুণ প্রজন্মের এই ব্যবসায়ী নিজের ব্যবসা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক ফারজানা লাবনীর সঙ্গে

১৯৯২ সালে ২২ বছরের আমেরিকায় ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ালেখা শেষ করে সে দেশেই একাধিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরির ডাক পান তরুণ আহসান খান চৌধুরী। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে শিকড়ের টানে দেশে ফিরে আসেন। মনের মাঝে অদম্য ইচ্ছা, এ দেশের মানুষকে নিয়েই কিছু করা, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়বে। এমন হিসাব মেলাতেই বাবা আমজাদ খান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ডিএমডি বলেন, 'গুণগত মানের পণ্য পৌঁছে দেওয়াই সবচেয়ে বড় নীতি হওয়া উচিত। শুধু নিজে ভালো থাকব তা নয় চেষ্টা ছিল সবাইকে নিয়ে বাঁচব।'

আহসান খান চৌধুরী বলেন, 'প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ছিল আমার জন্য সবচেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম। বাবাকেও সে সময় সাহায্য করার প্রয়োজন ছিল। শুরু হয় নতুন পথচলা। বাংলার ঘরে ঘরে প্রাণের পণ্য পৌঁছে দেওয়াই ছিল আমার লক্ষ্য। পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ছিল আমার ব্যবসার অন্যতম কৌশল। ব্যবসার শুরু থেকেই নানা সমস্যা সামনে এসেছে। এখনো আছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি যে চ্যালেঞ্জকে দক্ষতা ও মেধার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে সে-ই এগিয়ে যাবে।'

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বাবা আমজাদ খান চৌধুরীর উপদেশ স্মরণ করে এই তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, 'জীবনে সফলতার জন্য সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই। এই কথাগুলো অনুসরণের চেষ্টা করি। আমি বিশ্বাস করি, যেকোনো অর্জনের পেছনে থাকতে হবে কঠিন পরিশ্রম, সততা ও অধ্যবসায়। জীবন চলার পথে পাহাড়-সমান সমস্যা আসবে। এতে বিচলিত না হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যে কাজ করি তা সততার সঙ্গে মনে-প্রাণে করি।'

ব্যবসার জন্য বাংলাদেশকে অপার সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, 'এ দেশে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে তা আমি মনে করি না। বরং অসম্ভব সম্ভাবনাময় একটি দেশ বাংলাদেশ। আমাদের দিগন্ত বিস্তৃত আবাদি ও উর্বর জমি, অবারিত নদী আর আছে কর্মঠ এক বিশাল জনগোষ্ঠী। এত সুবিধা খুব কম দেশেই রয়েছে।' তিনি বলেন, পৃথিবীর এমন অনেক দেশ আছে যেখানে মাইলের পর মাইল জমি রয়েছে; কিন্তু তাতে আবাদ হয় না। আর এ দেশে ঘরের ভেতরে টবের মধ্যে দুটি বীজ লাগালেও চারা গজিয়ে যায়। একটু পরিচর্যা করলে সেখান থেকে ফলও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের এই উর্বর জমি কাজে লাগাতে না পারা হবে আমাদের ব্যর্থতা।'

দোষারোপের সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে উল্লেখ করে আহসান খান চৌধুরী বলেন, 'নিজের ব্যর্থতার জন্য অন্যকে দায়ী করার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশের উন্নয়ন আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। রাজনীতিতেও স্থিতিশীলিতা আসবে।'

'এদেশে মানুষের অভাব নেই; কিন্তু দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পদক্ষেপ নিতে হবে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দেশের মানুষকে এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ দায়িত্ব সবার, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ওপর এর দায়টা বেশি'- বললেন আহসান খান চৈধুরী।

নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, 'গত ১০ বছরে ব্যবসায়ের ধরন পাল্টেছে। লেখাপড়া জানা উদ্যোক্তারা এখন ব্যবসায় আসছেন। এতে ব্যবসার গুণগতমানের উন্নয়ন হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বিশ্ব এখন এক মঞ্চে। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ এখন মুহূর্তের ব্যাপার। ভোক্তারাও জানতে পারছেন কোন দেশে কী পাওয়া যাচ্ছে। তাই প্রতিযোগিতাও আগের চেয়ে বেশি। যে ব্যবসায়ী গুণগতমানের বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য উৎপাদন করবেন তাঁকে মুনাফা নিয়ে ভাবতে হবে না। তাই ভোক্তার কাছে পণ্যের গুণগতমানের পণ্য পৌঁছে দেওয়াই সবচেয়ে বড় নীতি হওয়া উচিত একজন ব্যবসায়ীর।' তিনি বলেন, দেশের ভাবমূর্তি ভালো হলে পণ্য রপ্তানিতেও সুফল পাওয়া যায়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে ভিসা সুবিধা পান সে বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।

বর্তমানে খাদ্য ও প্লাস্টিক এ দুটি খাতে সর্বাধিক বহুমুখী পণ্যের সমাহার রয়েছে প্রাণের। আহসান খান চৌধুরী জানান, 'বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রডাক্ট লাইনে রয়েছে ৫০০টিরও বেশি পণ্য। হালকা প্রকৌশল শিল্পে এবং প্লাস্টিক খাতেও রয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব। এ খাতে দুই হাজারটিরও বেশি উৎপাদিত দ্রব্য রয়েছে প্রাণ গ্রুপে। আমাদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল দেশের প্রান্তিকপর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকি। এ জন্য প্রায় ৭৮ হাজার চুক্তিবদ্ধ কৃষক সরাসরি আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ১৩টি অত্যাধুনিক কারখানায় ব্যবহৃত করা হয় বিশ্বসেরা প্রযুক্তি। এসব কারখানায় সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষের। পরোক্ষভাবেও এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজে জড়িত রয়েছে বড় অঙ্কের জনগোষ্ঠী। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখের বেশি মানুষের জীবিকা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল।'

প্রাণের পণ্য বর্তমানে ৯৪টি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ সংখ্যা আরো বাড়বে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানের ডিএমডি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে গুণগতমানের পণ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই। বাজার চাহিদা বিবেচনায় পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এ জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং গবেষণার প্রয়োজন। প্রাণ গ্রুপের কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আহসান খান চৌধুরী বলেন, 'আমাদের গ্রুপের লক্ষ্য হলো লাভজনক ব্যবসায়িক কার্যক্রমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে মানুষের মর্যাদা ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি করা। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের ব্যবসায় অগ্রসর হওয়া। এ ক্ষেত্রে আমরা গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে কর্মীদের মধ্যে মহিলাকর্মীর সংখ্যা ৮০ শতাংশেরও বেশি।'

কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নে সার-বীজ সরবরাহ, উন্নত চাষের জন্য প্রশিক্ষণ এবং উৎপন্ন ফসল বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করে প্রাণ। আহসান খান চৌধুরী বলেন, 'প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং প্লাস্টিক পণ্যের পরিধি আরো বাড়াতে আমরা কাজ করছি। স্থানীয় বাজারে বিক্রি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছি। আমার ইচ্ছা প্রাণের ব্র্যান্ডে বাংলাদেশের সুনাম বাড়বে। পৃথিবী জানুক এ দেশের কৃষকের কথা।'

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জানিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ডিএমডি বলেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে

উৎপাদক, প্রক্রিয়াজাতকারী, সরবরাহকারী, ভোক্তাসহ সবার ওপর। তিনি আশা করেন, এ সমস্যার অবশ্যই সমাধান রয়েছে এবং তা হবেই। তখন বর্তমান সংকট কেটে যাবে।'
সূত্র : ১ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ কালের কণ্ঠ

No comments:

Post a Comment