আহসান খান চৌধুরী | নভেম্বর ০৪, ২০১৫
আয়তনে পৃথিবীর ক্ষুদ্র একটি দেশ হলেও ভৌগোলিক অবস্থান, উর্বর মাটি ও বিশাল জনগোষ্ঠীর কারণে সম্ভাবনাময় ‘নেক্সট ইলেভেন’-এর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বাংলাদেশ। এ দেশের সন্তানেরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। দেশের সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোর মধ্যে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প সম্প্রতি বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। এ শিল্পে বাংলাদেশের ‘প্রাণ’ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের ১১৮টি দেশে পৌঁছে গেছে। রপ্তানিতে অবদান রাখায় পরপর ১০ বছর জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশি বহুজাতিক শিল্প হিসেবে ‘প্রাণ-আরএফএল’ বহুদূর এগিয়েছে।
তিন দশকেরও বেশি সময়ের পথচলায় প্রাণ-আরএফএল শিল্প পরিবার আজ বেশ সমৃদ্ধ। খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক ও কাস্ট আয়রন পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ পণ্য আমরা বাজারজাত করছি। সম্প্রতি আমরা পোশাকশিল্প, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক, বাইসাইকেল, হিমায়িত খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন শুরু করেছি। বিশ্ব বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের তৈরি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে আমাদের পণ্য। গর্বে বুক ভরে যায় এই ভেবে যে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, যুক্তরাজ্য, দুবাই, মালয়েশিয়ার বিখ্যাত সুপার শপের তাকগুলোয় প্রাণের পণ্য শোভা পায়। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত সস কোম্পানি বায়রন বে চিলির সস বানাচ্ছে প্রাণ। ভারতের ডিমার্ট, যুক্তরাজ্যের উইলকিনসন, যুক্তরাষ্ট্রের ডলারামা, ডেনমার্কের নভোনর্ডিক, ফ্রান্সের ক্যারিফোর, অস্ট্রেলিয়ার উলওয়ার্থ, স্পেনের ইসিআই, মধ্যপ্রাচ্যের রামিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য তৈরি করছে ‘প্রাণ-আরএফএল’ গ্রুপ।
আমাদের পথচলা শুরু হয় ১৯৮১ সালে রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তখন ঢালাই লোহা দিয়ে বিভিন্ন কৃষি ও সেচ উপকরণ তৈরি করা হতো। এরপর কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হই আমরা। ১৯৮৫ সালে নরসিংদীতে স্বল্প পরিসরে কলা, পেঁপে, আনারস, রজনীগন্ধা ইত্যাদি চাষ করা শুরু করি। শুরু হলো এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড, তথা প্রাণ-এর যাত্রা। কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা লক্ষ করি, দেশে অনেক পণ্য উৎপন্ন হলেও মৌসুমের সময় পণ্যের দাম কমে যায় এবং ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন কৃষক। এ ছাড়া সংরক্ষণের অভাবে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তাই কৃষিপণ্য উৎপাদনের চেয়ে আমরা তা সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে উদ্যোগী হই। ক্রমান্বয়ে একটু একটু করে এগোতে থাকি আমরা। ১৯৯৩ সালে নরসিংদীতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য একটি কারখানা স্থাপন করি। সেখানে বিভিন্ন ফলমূলের জুস, শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত করা শুরু করি। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে আমরা বিভিন্ন ড্রিংকস, সস, জেলি, চানাচুর, চিপস, চকলেট, বেকারি, দুগ্ধজাত পণ্য বাজারজাত করতে থাকি।
কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে লক্ষ করলাম কৃষি বিষয়ে আমাদের দেশের কৃষকদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণও তাঁদের হাতে যথাযথভাবে পৌঁছায় না। চিন্তা করলাম, এসব বিষয়ে যদি কৃষকদের সহায়তা দেওয়া যায়, তাহলে জমিতে কয়েক গুণ বেশি ফলন সম্ভব। তাই আমরা কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করে কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ সরবরাহ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে থাকি। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, চুক্তিবদ্ধ কৃষকেরা বেশ ভালো করছেন। একই জমিতে আগের চেয়ে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে পণ্য সংগ্রহে ক্রমান্বয়ে আমরা কৃষকদের সঙ্গে সম্পৃক্তি বাড়াতে থাকি। বর্তমানে আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন প্রায় ৮০ হাজার চুক্তিভিত্তিক কৃষক। তাঁদের চাষ করা পণ্য ক্রয়ে আমরা কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে পণ্যের বাজারদর যাচাই করি। এরপর যথাযথ মূল্য পরিশোধ করে তাঁদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করি। কৃষকদের কাছ থেকে আম, টমেটো, বাদাম, ডাল, আনারস, পেয়ারা, চাল, মসলা প্রভৃতি সংগ্রহ করা হয়। এতে কৃষকেরাও লাভবান হচ্ছেন, আমরাও মানসম্পন্ন পণ্য পাচ্ছি।
ছোট ছোট পণ্যের পসরা সাজিয়ে প্রাণ-আরএফএল আজ সারা বিশ্বের ডাইনিং টেবিলগুলোয় ও আড্ডাগুলোয় পৌঁছে গেছে। একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে বিশ্ববাসীর আবেগ অনুভুতির সঙ্গে। আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ আজ বিশ্ববাসীর কাছে ‘বাংলাদেশের প্রাণ’
সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে আমরা বেশ কয়েক বছর যাবৎ দুগ্ধশিল্পে গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনাময় এই খাত নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। এ শিল্পের উন্নয়নে আমরা খামারিদের পশুপালন-বিষয়ক প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও ওষুধ, রোগ প্রতিষেধক টিকা, কৃত্রিম প্রজনন, গবাদিপশুর খাবার ইত্যাদি সরবরাহ করছি। এ ছাড়া প্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয়ে কৃষকদের আমরা আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছি। নাটোর, পাবনা ও রংপুরে অবস্থিত আমাদের তিনটি ডেইরি হাব-এর মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করি।
আমাদের করপোরেটব্রত, ‘দারিদ্র্য ও ক্ষুধা জীবনের অভিশাপ। আমাদের লক্ষ্য লাভজনক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি করা।’ জাতিসংঘ কর্তৃক ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) গৃহীত হয়েছে, তা অর্জনে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ব্যাপক অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৭টি লক্ষ্য অর্জনে প্রাণ-আরএফএল সরাসরি অবদান রাখবে। সব ধরনের দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা দূর করা এসডিজির প্রথম এবং দ্বিতীয় লক্ষ্য। প্রাণ-আরএফএল এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে। ইতিমধ্যে প্রাণ-আরএফএল দেশের প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক তাঁদের জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রাণ-আরএফএলের ওপর নির্ভরশীল।
নারীর সম-অধিকার এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা এসডিজির পঞ্চম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রাণ-আরএফএল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। আমাদের কারখানাগুলোয় শতকরা ৮০ ভাগের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছেন। নারীর সম-অধিকার অর্জন এবং ক্ষমতায়নে এটি বিরাট ভূমিকা রাখছে। প্রাণ-আরএফএল তার করপোরেট মিশন অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে ক্রমান্বয়ে অবদান রেখে চলেছে। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা সহযোগিতা করছি। এসডিজির নবম লক্ষ্য টেকসই শিল্পায়ন ও উদ্ভাবন। এ ক্ষেত্রেও আমরা অবদান রাখছি। আমাদের কারখানাগুলোয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) ব্যবহার করছি। ফলে, পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দূষণ রোধ হচ্ছে। আমরা পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য নিয়মিত গবেষণা করছি এবং সময়ে সময়ে পণ্যে অভিনবত্ব নিয়ে আসছি।
কৃষিক্ষেত্রে এ দেশের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে কৃষিনির্ভর শিল্প উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান এবং খাদ্যের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে বিশ্বমানের ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া স্থল ও সমুদ্রবন্দরে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। রপ্তানি বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন দেশে শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা দূর করার জন্য তৎপরতা চালাতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বিশ্ব আজ বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। মুহূর্তেই ক্রেতারা বিভিন্ন দেশের পণ্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। বাজারে এখন প্রতিযোগীর অভাব নেই। তাই ব্যবসায় ভালো করার সবচেয়ে বড় নীতি হচ্ছে মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করা। এ নীতি অনুসরণ করলে দেশীয় পণ্য বিশ্ব বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।
ছোট ছোট পণ্যের পসরা সাজিয়ে প্রাণ-আরএফএল আজ সারা বিশ্বের ডাইনিং টেবিলগুলোয় ও আড্ডাগুলোয় পৌঁছে গেছে। একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে বিশ্ববাসীর আবেগ অনুভূতির সঙ্গে। আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ আজ বিশ্ববাসীর কাছে ‘বাংলাদেশের প্রাণ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। এভাবেই আমরা বিশ্বে বাংলাদেশের উপস্থিতি জানান দিতে চাই।
আহসান খান চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ
No comments:
Post a Comment