বিশেষ
শুধু মুনাফা তার লক্ষ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল, দেশের বিশেষত গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করা। শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামটাই এর বড় উদাহরণ। প্রতিষ্ঠানের নাম 'প্রাণ', যার বিস্তৃতরূপ 'প্রোগ্রাম ফর রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট ন্যাশনালি'। বাংলায় প্রাণ বলতে বুঝিয়েছেন 'প্রগতি রূপায়ণে অগ্রণী নবোদ্যম'। নামকরণের মতো সব উদ্যোগেই সৃজনশীলতার জন্য অনুপম উদাহরণ হয়ে থাকবেন মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী। এ দেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অগ্রদূত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন 'প্রাণ'-এর এই 'প্রাণপুরুষ'।
আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুতে তার পরিবার ও স্বজনরা হারিয়েছেন তাদের প্রাণের মানুষকে। দেশ হারাল একজন সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তাকে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা হারিয়েছেন তাদের 'আইডল' ব্যক্তিত্বকে। প্রাণ-আরএফএলের ৬৮ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী হারিয়েছেন তাদের অভিভাবককে। তার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর গতকাল ব্যবসায়ী নেতারা 'প্রাণ' কার্যালয়ে গেছেন তার স্বজনদের সমবেদনা জানাতে। প্রাণ-আরএফএলের ওয়েবসাইটে এক শোকবার্তায় বলা হয়েছে, তিনি সবার জন্য চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। তিনি এমন একটি 'শিল্প গ্রুপ' প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, যা শুধু তার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
আমজাদ খান চৌধুরীর সহধর্মিণী সাবিহা আমজাদ। এই দম্পতির ৪ সন্তান। তারা হলেন- আজার খান চৌধুরী, আহসান খান চৌধুরী, ডা. সেরা হক এবং উজমা চৌধুরী। তাদের মধ্যে আহসান খান চৌধুরী গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং উজমা চৌধুরী গ্রুপের পরিচালক। আমজাদ খান চৌধুরীর ছোট ছেলে ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরী গতকাল সমকালকে বলেন, তার বাবা একজন সফল মানুষ ছিলেন। নিরলসভাবে কাজ করতেন। বাবার ছায়া মাথার ওপর থেকে সরে গেল। আহসান খান বলেন, তার বাবার দুটি স্বপ্ন ছিল। তার একটি আগামী ১৮ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। নাটোরে তিন বিঘা জমিতে একটি হাসপাতাল করা হচ্ছে। আরেকটি স্বপ্ন ছিল- বাংলাদেশের ডেইরি শিল্পের উন্নয়ন। এ স্বপ্ন সফল হয়েছে। তা তিনি গর্বভরে প্রত্যক্ষ করেছেন।
আমজাদ খান চৌধুরীর মেধা, মনোবল, দূরদর্শিতা ও সদিচ্ছার কারণে প্রাণ এখন দেশের সর্ববৃহৎ খাদ্য ও পুষ্টি কোম্পানি। প্রাণের পণ্য দেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। পাশাপাশি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ ১১৪টি দেশে রফতানি হচ্ছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যে প্রাণের জুস, কোমলপানীয়, স্ন্যাকস, বিস্কুট, কনফেকশনারিসহ নানা খাদ্যপণ্য বিপুল জনপ্রিয়। ১০টি ক্যাটাগরিতে ২ শতাধিক খাদ্যপণ্য রফতানি করছে প্রাণ ফুডস। দেশে-বিদেশে প্রাণের ভোক্তা প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। 'প্রাণ'-এর পর সাফল্য এনেছে তাদের আরএফএলের প্লাস্টিক সামগ্রী।
আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার কারণে ইতিমধ্যে নানা স্বীকৃতি পেয়েছে প্রাণ গ্রুপ। নিরাপদ খাদ্যপণ্য তৈরির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হ্যাজার্ড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ারফুল পয়েন্ট বা 'হ্যাচাপ' স্বীকৃতি রয়েছে প্রাণের। ১৯৯১ সালে রফতানি বাজারে প্রবেশ করে প্রাণ। প্রথমে ফ্রান্সে রফতানি হয়। শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯১-২০০০ থেকে টানা ১০ বছর 'জাতীয় রফতানি ট্রফি' অর্জন করে 'প্রাণ'। বাংলাদেশের প্রথম খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি হিসেবে 'আইএমএস' সনদ তার প্রমাণ। আইএমএস হচ্ছে, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা মূল্যায়নে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড। ২০১১ সালে 'প্রাণ' এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ব্র্যান্ড মালয়েশিয়ায় 'ইউডিসি বিজনেস অ্যাওয়ার্ড' পায়। একই বছরে তারা এইচএসবিসি 'এক্সপোর্ট এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড' অর্জন করে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ দেশের সফলতম ব্র্যান্ড। আরএফএলের প্লাস্টিক পণ্য এখন ঘরে ঘরে। আরএফএল পণ্যের মধ্যে রয়েছে টিউবওয়েল, পানির পাম্প, পিভিসি পাইপ, ফিল্টার, ভবন নির্মাণসামগ্রী, প্রকৌশল, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক, কিচেন সামগ্রীসহ অনেক কিছু।
যেভাবে শুরু: সেনাবাহিনীতে ২৫ বছর চাকরি করার পর আমজাদ খান চৌধুরী অবসর নেন ১৯৮১ সালে। তিনি প্রচণ্ডভাবে অনুভব করতেন, আমাদের দেশে রয়েছে উর্বরা জমি, প্রচুর নদীনালা এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমী এক বিশাল জনগোষ্ঠী। এ সবকিছুই কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের সুবিধা হচ্ছে মূল্য সংযোজিত কৃষিজাত পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান সৃষ্টি করা। এ জন্যই 'প্রাণ-আরএফএল'-এর যাত্রা শুরু। আমজাদ খান চৌধুরী রংপুরে ১৯৮১ সালে রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল)-এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ নির্মাণ শুরু করেন। এর জন্য পুঁজি ছিল তার পেনশনের টাকা আর স্ত্রীর পৈতৃক সম্পত্তি ও ব্যাংকে গচ্ছিত কিছু টাকা। এ দিয়ে প্রথমে অকশনের কিছু মেশিনপত্র কেনেন, যা দিয়ে হালকা কৃষি উপকরণ তৈরি করা হয়। যদিও সেই মেশিনগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কম ছিল; কিন্তু সেগুলো দিয়েই প্রথমে যাত্রা শুরু হয় পরীক্ষামূলকভাবে। সাড়াও পেয়েছিলেন মোটামুটি রকমের। সেই সময়ে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে পারেননি। পুঁজি ছিল কম। এরপর চিন্তা করলেন, কৃষি উপকরণের পাশাপাশি কৃষিপণ্য উৎপাদন করা যায় কি-না। প্রথমে তিনি কলা চাষ করলেন। এরপর পেঁপে এবং রজনীগন্ধা ফুল চাষ করলেন। দেখলেন, উৎপাদন হয়, কিন্তু মৌসুম শেষ হবার পর সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মৌসুমের সময় দাম পড়ে যায়, কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। তখন বুঝতে পারলেন, উৎপাদন করার চেয়ে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রক্রিয়াজাত করাটাই হলো মুখ্য। তখন তিনি প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর ধীরে ধীরে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাতকরণের কার্যক্রম শুরু করলেন। তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে অভিজ্ঞ লোক আনলেন যারা ফ্যাক্টরিতে অবস্থান করলেন এবং তাদের কাছে শিখতে থাকলেন। এরপর তিনিও বিভিন্ন দেশে গেলেন হাতেকলমে শেখার জন্য। পরে সেসব অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করতে থাকলেন। ধীরে ধীরে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকল।
একনজরে প্রাণ-আরএফএল :দেশের বৃহত্তম খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-এর প্রোডাক্ট লাইনে রয়েছে প্রায় ৫০০ খাদ্যপণ্য। হালকা প্রকৌশল, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক্স খাতে আরএফএলের রয়েছে প্রায় ৩০০০ পণ্য। দেশজুড়ে বিস্তৃত ১৩টি অত্যাধুনিক কারখানায় এসব উৎপাদিত হয়। এসব কারখানায় সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৮ হাজারের বেশি নারী-পুরুষের। পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক লোকেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ওপর নির্ভর করে আরও ১০ লাখের অধিক মানুষের জীবন ও জীবিকা।
চুক্তিভিত্তিক কৃষিকাজ: উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করতে এবং ন্যায্যমূল্য পেতে বাংলাদেশের কৃষকরা সব সময়ই শঙ্কিত থাকতেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্রচাষিদের রক্ষা করতে এবং তাদের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন আমজাদ খান চৌধুরী। 'কন্ট্রাক্ট ফার্মিং' তথা চুক্তিবদ্ধ চাষাবাদের মাধ্যমে চাষিদের উন্নতমানের বীজ, সার-কীটনাশক প্রভৃতির ব্যবস্থা করেন। সেই সঙ্গে কোন ফসলের জন্য বছরের কোন সময়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কৃষকরা জমিতে উৎপাদন শুরু করলে প্রাণ সেগুলো উৎপাদনে তদারকি করে। যাতে ভালো ফসল ফলে। ফসল ওঠার পরে তাদের কাছ থেকে প্রাণ সেই ফসল কিনে থাকে। এ ক্ষেত্রে কৃষক প্রতিনিধি সঙ্গে নিয়ে বাজারদর যাচাই করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে প্রাণের সিংহভাগ কাঁচামাল সংগৃহীত হয় 'কন্ট্রাক্ট ফার্মিং' তথা চুক্তিবদ্ধ কৃষকদের মাধ্যমে। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- আম, তরল দুধ, চাল, মসলা, ডাল, বাদাম, টমেটো ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য। স্থানীয় বাজার থেকে প্রাণ এসব কৃষিপণ্য কেনার ফলে ৭৮ হাজারের অধিক কৃষক এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের খামারি সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: প্রাণের কর্মকর্তারা জানান, তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো প্রাণ-আরএফএল গ্রুপকে বাংলাদেশের প্রথম বহুজাতিক কোম্পানি (মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। বিগত কয়েক দশকে দেশের সামগ্রিক কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলেও দুগ্ধশিল্প আশানুরূপ বিকাশলাভ করতে পারেনি। দুগ্ধশিল্পে ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগ থাকলেও হাতে গোনা দু'একটি ছাড়া তেমন কোনো বৃহৎ উদ্যোগ নজরে পড়ে না। দুগ্ধশিল্প এমন একটি খাত যেখানে সকল বয়সের নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ডেইরি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। দুগ্ধশিল্পের উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি 'প্রাণ' ব্যাপক বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
No comments:
Post a Comment