Sunday, February 23, 2014

টাঙ্গাইলের মধুপুরে কিষানী মহিরন বেগমের কেঁচো বিপ্লব

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আউশনারা ইউনিয়নের দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম দক্ষিণ ইদিলপুর। এ গ্রামের বিত্তহীন কিষানী মহিরন বেগম (২৮) কেঁচো বিল্পব ঘটিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি সুনাম ও খ্যাতি কুড়িয়েছেন। অভাবী ঘরে জন্ম নেয়া মহিরন ছোটবেলায় পড়াশুনা করতে পারেননি। কিশোর বয়সে তার বিয়ে হয় গ্রামের দিন মজুর সুরুজ আলীর সাথে। কামলা খাটা সামান্য আয়ে খাওয়াপড়া জুটতো না। এর মধ্যে পর পর জন্ম নেয় ছয় সন্তান। অভাব-অনটন আর সন্তান-সন্ততীর ভারে ডুবে যেতে বসে ছোট্ট সংসার। 

এ অবস্থায় ২০০৯ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার সাথে যুক্ত হয় মহিরন বেগম। সচেতনতা ও দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগল পালনের মাধ্যমে পথ চলা শুরু হয়। পরবর্তীতে সিবিএসডিপি এনজিওর কেঁচো সার উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয় মহিরন। সংস্থাটি তাকে দু’টি চাড়ি ও ৫০টি কেঁচো দিয়ে ভার্মী কেঁচো চাষ শুরু করান। উৎপাদিত সার দিয়ে নিজের জমিতে সবজি চাষ করেন। 
রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই সবজি উৎপাদন দেখে সবাই হতবাক হয়ে যায়। মহিরন কেঁচো সার উৎপাদনের পরিধি বাড়ালে আয়ও দিন দিন বাড়তে থাকে। গতবার ৭০ মণ ভার্মি সার ২৮ হাজার টাকায় এবং প্রতিটি কেঁচো দুই টাকা দরে বিক্রি করে দুই হাজার টাকা রোজগার করেন। তার অভিজ্ঞতা ও সাফল্য দেখে সবাই অভিভূত হয়ে যায়। 

দেশের অন্যান্য জায়গায় কর্মরত বেসরকারি সংস্থা কেঁচো উৎপাদনে প্রশিক্ষক হিসাবে মহিরনকে নিয়ে যান। এ  থেকেও কিছু টাকা তিনি আয় করে থাকেন। মহিরন বেগমের বাড়ি এখন কেঁচো সারের কারখানা। সকাল-বিকাল নিজের সন্তানের মত কেঁচোকে যতœ করেন। বাড়ির আশপাশের খড়কুটো, সবুজ লতাপাতা, ঘরবাড়ি ঝাড়া ময়লা আবর্জনা, তরিতরকারি উচ্ছিষ্ট, গোবর, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগীর বিষ্ঠা দিয়ে প্রিকম্পোষ্ট তৈরি করে কেঁচোকে খাওয়ায়। মহিরন বেগম এবার পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা আয় করার আশা করছেন। কেঁচো চাষ করে অন্তত খাওয়াপড়ার দুশ্চিন্তাটুকু দূর করেছেন। এক ছেলেকে স্কুলে লেখাপড়াও করাচ্ছেন। 

মহিরনের দেখাদেখি গ্রামের আরো পঞ্চাশটি বিত্তহীন পরিবার কেঁচো সার তৈরির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। ভার্মি কেঁচো সারের চাহিদা দিনদিন বেড়ে চলেছে। ধান ছাড়াও আদা, হলুদ, কচু, আনারস, কলা, শাক-সবাজ ও ফুলের বাগানসহ সব ধরনের গাছে এ সার প্রয়োগ করা যায়। অনেকে পুকুরে মাছের সুষম খাবার হিসাবেও এর ব্যবহার করছেন। এই সার কৃষি, পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখছে বলে কৃষিবিদদের অভিমত। 

১৯৪২ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারোরা সর্ব প্রথম সুস্বাদু আনারস চাষ শুরু করে। পরবর্তীতে বাঙালী মহাজনরা আনারস চাষের সাথে জড়িত হওয়ায় এবং আনারসের আকার বড় করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, ক্ষতিকর হরমোন ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য ও ইকোসিস্টেম বিনষ্ট হচ্ছে। ফসলী জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। উপকারি কীটপতঙ্গ ও প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। 

ক্ষতিকর হরমোন দিয়ে ফল পাকানোয় ভোক্তারা ফল খেয়ে জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সিবিএসডিপি এ পরিস্থিতিতে পরিবেশ বান্ধব কৃষি বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম হাতে নেয়। এটি সিবিএসডিপির সবচেয়ে সফল প্রকল্প। আর কিষানী মহিরন বেগম এখন মডেল। 

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. হযরত আলী জানান, মহিরনের সাফল্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা দিয়েছে মধুপুর উপজেলায়। পরিবেশ বান্ধব কৃষির জন্য কেঁচো সার খুবই ফলপ্রদ।

No comments:

Post a Comment