Wednesday, June 25, 2014

রাজধানীর যোগাযোগে পরিবর্তন এনেছে হাতিরঝিল

ঢাকা: প্রায় সাত বছর পর কানাডা প্রবাসী মহিবুল হাসান সপরিবারে দেশে ফিরেছেন। উঠেছেন রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বড় বোনের বাসায়। সেদিন সন্ধ্যার পরেই কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলেন মহিবুল। ভাগ্নে মবিন তাদেরকে নিয়ে এলো মামার অদেখা নতুন এক জায়গায়। মহিবুল তো অবাক- ‘ঢাকায় তাহলে এমন চমৎকার জায়গাও আছে!’

হাতিরঝিলে লেকের ওপর ব্রীজে দাঁড়িয়ে এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন মহিবুল হাসান। প্রবাসে থাকলেও দেশের সব খবরাখবরই রাখেন তিনি। হাতিরঝিলের কথাও শুনে আসছিলেন। কিন্তু এখানে এসে এমন চমৎকার পরিবেশ দেখতে পাবেন ততটা ভাবেননি তিনি।

‘কেমন লাগছে হাতিরঝিল?’- এমন প্রশ্নে মহিবুল বললেন, ‘এক কথায় চমৎকার! আমার দেশে এমন মনোমুগ্ধকর জায়গা তৈরি হয়েছে, তা ভাবতেও ভাল লাগছে।’ তাঁর সঙ্গে আসা ভাগ্নে মবিন বললো, ‘এখন যারা ঢাকায় বেড়াতে আসেন, তাদের প্রথম পছন্দই হচ্ছে এই হাতিরঝিল।’

রাজধানী ঢাকার অন্যতম আকর্ষণীয় ও বিনোদনের স্থান এখন হাতিরঝিল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণা আর আড্ডায় মুখরিত হয়ে উঠে বিশাল হাতিরঝিল এলাকা। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর আলোয় ঝলমল এই এলাকায় ভিড় জমে উঠে বেশি। এ সময় ব্রীজ, ভিউয়িং ডেক, ঘাট, সীট বেঞ্চ ইত্যাদি প্রায় সবই জমজমাট হয়ে উঠে। সুন্দর সুন্দর স্থাপনা ও লেকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় দর্শনার্থীরা।

কিন্তু হাতিরঝিলকে কেবল দৃষ্টিনন্দন বা বিনোদনের স্থান হিসেবে গড়ে তোলাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল না। ‘বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আরেফুর রহমান জানালেন, মোট চারটি উদ্দেশ্য নিয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা শহরের পূর্ব-পশ্চিম বরাবর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ঝিলের চারদিকে সড়ক নির্মাণ করা। তিনি জানান, প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, হাতিরঝিল দেখতে তো খুব ভালই লাগছে। তিনি তখন বিনোদন ও সৌন্দর্য উপভোগের জন্য মানুষের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে হাতিরঝিলকে সাজাতে নির্দেশ দেন।

এখন বিনোদনের স্থান হিসেবে হাতিরঝিল যতটা পরিচিতি পেয়েছে, ততটা বাইরের অনেকেই জানে না যাতায়াতের ক্ষেত্রে সুবিধা প্রাপ্তির কথা। তবে এ পথে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা তুলে ধরেন তাদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত হওয়ার কথা।

ধানমণ্ডির বাসিন্দা আতিকুজ্জামান। তাকে নিয়মিত রামপুরায় যেতে হয়। তিনি প্রাইভেট কারে যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আগে অনেক ঘুরে যেতে হতো। যানজটেও পড়তে হতো। এখন দুঃসহ যানজট থেকে মুক্তি পেয়েছি। এখন হাতিরঝিল দিয়ে যাতায়াত করি। এতে সময় সাশ্রয় হয়েছে কমপক্ষে আধাঘণ্টা। আর আমার মত অনেকেই যারা আগের রাস্তায় চলাফেরা করতেন তারাও এখন এ পথ ব্যবহার করেন। ফলে মূল রাস্তায় কিছুটা হলেও যানজট কমেছে।’

মহাখালী এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আজিজুর রহমানকে প্রায়ই মতিঝিল ও পুরনো ঢাকায় যেতে হয়। তিনি জানান, আগে গুলিস্তান পর্যন্ত যেতে অনেক সময় লাগতো। সিএনজি-অটোরিকশা চালকরা সহজে যেতেও চাইতো না। এখন সিএনজি অটোরিকশায় হাতিরঝিল দিয়ে রামপুরা হয়ে কম সময়েই যাতায়াত করা যায়।

বাড্ডা এলাকার গৃহিনী পারুল বেগম। তিনি জানান, মোহাম্মদপুর এলাকায় তার আত্মীয়-স্বজন আছে। আগে যাতায়াতের কথা চিন্তা করে ওই এলাকায় প্রায় বেড়ানোই বাদ দিয়েছিলেন। হাতিরঝিল হওয়ার পর ওই এলাকায় বেড়াতে বা কোন মার্কেটে গেলে এখন আর অতোটা চিন্তা করেন না। হাতিরঝিলের মধ্য দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে তারা সেখানে চলে যান।

রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত ও যানজট সমস্যা দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে নগরীর পূর্ব-পশ্চিম বরাবর যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল। পূর্ব-পশ্চিমে সরাসরি কোন সড়কপথ নেই। তাই পূর্ব-পশ্চিম দিকের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। এতে নগরবাসীর যাতায়াতে বিশেষ করে- ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, বনানী, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা, মগবাজার ইত্যাদি এলাকার মানুষের অনেকটাই সুবিধা হয়েছে। তবে প্রকল্পের সামান্য কাজ এখনো বাকি রয়েছে, যা বাস্তবায়ন হলে এ-পথে যাতায়াতে আরো সুফল পাওয়া যাবে।

জানা গেছে, ২০০৭ সালের জুলাইয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, যার মেয়াদ ছিল ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত। এই প্রকল্পের কিছু কাজ বাকি থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ আরো ১ বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক মো. আরেফুর রহমান জানান, হাতিরঝিলে আর সামান্য কাজ বাকি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রামপুরা ও বাড্ডার দিকে দুটি ইউ লুপ নির্মাণ করা। তিনি জানান, এখন হাতিরঝিলে গাড়ি ঢুকতে একটু সমস্যা হচ্ছে। ইউ লুপ দুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে রামপুরা ও বাড্ডা এলাকা থেকে সহজেই হাতিরঝিলে গাড়ি ঢুকতে ও বের হতে পারবে। ভূমি থেকে ৩০ ফুটের মতো উপর দিয়ে ইউ লুপের মাধ্যমে শুধুমাত্র গাড়ি চলাচল করবে। এতে হাতিরঝিলের মধ্য দিয়ে যাতায়াত সহজ ও নিরাপদ হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি জনসাধারণের জন্য হাতিরঝিল উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বাস্তবায়ন করছে এই প্রকল্প। সহযোগী সংস্থা হিসেবে রয়েছে- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ও ঢাকা ওয়াসা।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, হাতিরঝিলের প্রায় ৩০৩ একর এলাকায় ফুটপাত রয়েছে ৮.৮০ কিলোমিটার পথ। যান চলাচলের পথ আছে ৮ কিলোমিটার। এ রাস্তায় মানুষজন নির্বিঘেœ যাতায়াত ও চলাফেরা করতে পারছে। এখানে রিকশা, বাস ও ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ রয়েছে। ফলে এ রাস্তায় কোন যানজট নেই, নেই কোন দুর্ঘটনা। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এখনো এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা সহায়তা করছেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে।

অনেকের ধারণা, হাতিরঝিল প্রকল্পের দুর্বল দিক হচ্ছে- রাস্তার চওড়া কম, ফুটপাতও বেশি বড় নয়। ফলে গাড়ির যাতায়াত ও দর্শনার্থীদের চলাফেরায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান, জায়গার অভাবে রাস্তা ও ফুটপাত ততটা বড় করা যায়নি। তবে ইউ লুপ চালু হলে প্রকল্প এলাকায় গাড়ির প্রবেশ ও বের হওয়া সহজ হবে।

No comments:

Post a Comment