Friday, June 6, 2014

জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলের মানুষের ঝুঁকি বাড়ছে

বরগুনা: বরগুনার দক্ষিণ প্রান্তের তালতলী, পাথরঘাটা উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা বনাঞ্চল থেকে গাছ পাচার হচ্ছে নিয়মিতভাবে। টেংরাগিরি, সোনাকাটা, ফাতরা, হরিণঘাটার এই বনগুলোর বৃক্ষরাজি প্রাচীরের মতো কাজ করেছিল ২০০৭ সালের সিডরে। অর্ধেকের বেশী বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ২২০ কিলোমিটার গতিগের বাতাস ও জলোচ্ছাসের তোড়ে। ধীরে ধীরে পুন:জীবন ফিরে পাওয়া বন এখন উজাড় করছে বন দস্যুরা, গাছ মরছে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের (সাকসেশন) নিয়মেও।। শুধু বন-জঙ্গল নয়, লোকালয়ের গাছও কাটা পড়ছে নির্বিচারে। কেবলমাত্র ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা নয়, ভূখন্ডের তাপমাত্রার ভারসাম্যও টালমাটাল হয়ে পড়ছে গাছের আধিক্য কমে যাওয়ায়, মতামত বিশেষজ্ঞদের।  

বিশাল আকারের অনেকগুলো চর জেগে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের ও পায়রা এবং বিষখালী নদীর মোহনায়। সাগরের লোনা পানি নদীগুলোতে ঢুকে লবণাক্ত করে তুলছে ফসলী জমি। পলি পড়ে নদীও হারাচ্ছে নাব্যতা। ধারণ করতে পাওে না বর্ষা কিংবা উজান থেকে নেমে আসা পানি। স্রোতে ভাঙ্গছে লোকালয় ও কৃষি জমি। মানুষ নিজেদের স্বার্থে ভরাট করছে খাল, বিল, জলাশয়। নির্ভরশীলতা বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির উপর। মানুষ সৃষ্ট এবং প্রাকৃতিকভাবে জলবায়ুর চরম পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগের তীব্রতা ও ব্যাপকতার মাত্রা গত দুই দশকে প্রায় চারগুণ বেড়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তথ্যমতে ২০১৫ সাল নাগাদ দুর্যোগের কারণে উপকূলের ৫৪% ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা রয়েছে। 

উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রগামী জেলেরা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালে বঙ্গোপসাগরের আবহাওয়া ছিল অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি খারাপ। বর্তমানে তা আরও খারাপ। ওই বছর বাংলাদেশ আবহাওয়া দপ্তর থেকে ৮৯টি সংকেত প্রদান করা হয়, যার মধ্যে জুলাই থেকে মধ্য নভেম্বরের মধ্যে ২২টি নিম্নচাপ এবং ঘনীভূত নিম্নচাপ ছিল ১২টি, যা তিন বা তার উর্ধ্বের সংকেতের আওতাভুক্ত ছিল। ঐ পরিস্থিতিতে জেলেদের জীবন জীবিকার ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। 
২০০৭ সালে পরপর দু’টি বন্যার পাশাপাশি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে গেছে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। পরের বছর ‘আইলা’। সে সময়ের ক্ষতি আজও মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বৈষ্ণিক উষ্ণতা বৃদ্ধি জনিত জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই এই দুর্যোগগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল। এ ছাড়া লবণাক্ততা, পানির স্তর নেমে যাওয়াসহ অপরাপর নিয়ামকের পরিবর্তন বহু ক্ষেত্রেই আকস্মিক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি না করলেও দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। 

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ঝড়, টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সংগঠিত হওয়ার সংখ্যা ও এগুলোর তীব্র হিংস্রতা বৃদ্ধি, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধির কারনে এসব এলাকায় ব্যাপক ভাঙ্গন. বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির কারণে বন্যা, আকষ্মিক বন্যা ও নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি পায়। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনের ফলে খরা প্রবণতা বৃদ্ধি, সারাদেশে তাপ, চাপ, বৃষ্টিপাতে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে।

আইপিসিসি’র চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে কৃষির উৎপাদনশীলতা হ্রাস, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি, শিল্পায়ন ব্যাহত এবং পরিণতিতে জনজীবনসহ জাতীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার আশংকা করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন বিষয় নিয়ে উপকূলীয় এলাকায় কাজ করছে এমন সংগঠন এনএসএস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে আন্তর্জাতিক হিসাব অনুয়ায়ী ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে দুর্যোগের কারণে বিশ্বে উপকূলীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ লোকসংখ্যা ছিল প্রতিবছরে ১৭৪ মিলিয়ন, ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৪০ মিলিয়ন। সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে বছরে ৩৭৫ মিলিয়ন এ।

এনএসএস’র দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস প্রকল্পের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপক সাবরিনা মমতাজ জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বিপদগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ফসলহীনতা, নদী ভাঙ্গন ও উপকূলীয় অঞ্চলে বারবার দুর্যোগ, কর্মসুযোগহীনতা বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বাস্তুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের ৩০টি  কৃষি প্রতিবেশ জেলার প্রতিটিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের নানামুখী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে দেশের কৃষিখাত, অর্থনীতি, মানব সম্পদ ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। 

No comments:

Post a Comment