Saturday, July 6, 2019

ধান বাদ দিয়ে সবজি চাষে কোটিপতি আমির হোসেন

চলতি বছর ধানের দাম না পাওয়ায় হতাশায় ধান ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দেশে আলোচনার ঝড় তুলেন কৃষকরা। আবার ধানের বস্তা নিয়ে জেলা প্রসাশক কার্যালয়ের সামনে মিছিল মিটিং মানববন্ধনসহ নানা কর্মসুচি পালন করছেন তারা। সেই ক্ষোভ থেকে ধান চাষ বাদ দিয়ে সবজি চাষে মনযোগী হন এক কৃষক। তাতে সফলতাও পান। হয়েছেন কোটিপতি। তিনি হলেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের পুটিমারী গ্রামের কৃষক আমীর হোসেন। ৬ শতাংশ জমি শুরু। এর পর সবজি চাষ করে কোটি টাকার উপরে সম্পদ বানিয়েছেন তিনি।

সবজি চাষী ও বিক্রেতা থেকে জীবন শুরু করে নিজ প্রচেষ্টায় ভাগ্যের পরিবর্তনে শুন্য থেকে কোটিপতি হওয়ার সফলতায় বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পাওয়ায় আমির হোসেনের বেড়ে যায় কাজের অনুপ্রেররণা। এখন সে তার বসতবাড়ির চার পাশে নিজ ও বর্গা নেয়া জমিসহ ১৬ বিঘা জমিতে বিভিন্ন সবজি  চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে স্থানীয়দের। সবজিই নয় মালটা চাষেও ব্যপক সফলতার আলো ছড়াচ্ছেন তার বাগান থেকে। তিনি ফসল উৎপাদনে বাজারের কোন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। এর পরিবর্তে তিনি  ব্যবহার নিজের তৈরী কীটনাশক এবং কম্পোস্ট সার।

আমির হোসেন যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখনই তার দিনমজুর পিতা মোজাহার ব্যাপারীর মৃত্যু হয়। ফলে অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তান আমির হোসেন বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে প্রথমে একটি হোটেলের মেসিয়ারের কাজ নেন। কিন্তু তাতেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না, পেটে জোটে না দু’বেলার দু’মুঠো আহার।

ধার-দেনা করে থেকে ৫ হাজার টাকা লোন নিয়ে ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে পৈতৃক সুত্রে পাওয়া ৫ শতক জমিতে ১০০টি পেঁপের চারা লাগান আমির হোসেন। ওই জমিতেই সাথি ফসল হিসেবে চাষ করেন আদা। ছয় থেকে সাত মাসের চেষ্টায় পেঁপে ও আদা বিক্রি করে তার আয় হয় ১৫ হাজার টাকা।  এভাবে বছর খানেক পর সবজি বিক্রির টাকা জমিয়ে ১ বিঘা জমি কিনে নেয়। সেখানেও একই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন। অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধা খাটিয়ে চাষে সফল চাষি হিসেবে এভাবেই নিজকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুধু উৎপাদন নয় নিজে হাতেই আবার তার এই সবজি বিক্রয় করেন স্থানীয় ভরতখালী বাজারে।


প্রতি বছর খরচ বাদে তার আয় হয় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। আমির হোসেন জানান, বর্তমানে তিনি দুই বিঘা জমিতে পেঁপে ও সাথি ফসল হিসেবে হলুদ, কলা  আড়াই বিঘা, হলুদ ও লেবু ১০ শতক, কচু ১৬ শতক, মরিচ ১৬ শতক, ধান ২ বিঘা, গেন্ডারি আঁখ ১৬ শতক, আদা ২ বিঘা, নেপিয়ার ঘাস ১০ শতক, ৬৩ শতকে কুমড়া ও সাথি ফসল শসা, ১০ শতকে ধনচে, ১৬ শতকে পটল, ও সাথি ফসল হিসেবে আদা চাষ করছেন। এছাড়া বৃদ্ধ বয়সের কখনো যদি কৃষি কাজ করতে সমস্যা হয় সে জন্যই তিনি ১ একর জমিতে চাষ করেছেন উন্নত জাতের মালটা সাথী ফসল হিসাবে মালটার বাগানে আছে মুখ কচু। তার জমিতে প্রতিদিন ২ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা শ্রমিক মাসিক সাড়ে ৭ হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। এছাড়া তিনি ৫০ শতক জমিতে বসতবাড়ী করে ঘরের চারপাশে তিনি বিভিন্ন জাতের ফল ও ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন।

আমির হোসেনের স্ত্রী করিমন বেগম একজন আদর্শ গৃহিনী। তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বড় ছেলে আয়নুর রহমান স্নাতক পাসের পর বর্তমানে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত। বড় মেয়ে লিপি বেগম এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার পর বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে আরাফা আক্তার এ বছর বগুড়ায় ¯œাতক সম্মানে অধ্যায়নরত। ছেলে মেয়েদের বড় করতে যে অর্থ প্রয়োজন হয়েছে তার সবজি বিক্রির টাকা থেকেই জোগার করতে হয়েছে। এছাড়া তিনি ইরি-বোরো ও আমন ধান চাষ করে অধিক ফসল উৎপাদনেও সাফল্য অর্জন করেছেন। ফসল উৎপাদনে আমির প্রচলিত কীঁটনাশক ব্যবহার করেন না। এ জন্য তিনি বিভিন্ন গাছের রস মিসিয়ে নিজেই উদ্ভাবন করেছেন কীটনাশক। ১৫ লিটার পানিতে ১৫ ফোঁটা কেরোসিন তেল ও বিষকাঁটালি নামের এক প্রকার গাছের রস মিশিয়ে ক্ষেতে ¯েপ্র করে পোকা দমন করেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনি সফলও হয়েছেন। এছাড়া রাসায়নিক সারের পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেন কেঁচো, গরুর গোবর, কচুরি পানা, পরিত্যাক্ত জমিতে ধনচে চাষ করে বিশেষ কায়দায় এই ধনচের চারা জমিতে মিসিয়ে তা থেকে তৈরি করা হয় কম্পোস্ট ও জৈব সার।

সফলতার নানা কথা বর্ননা করতে গিয়ে আমির হোসেন আরো জানান, অধিক লাভের আশার ধান চাষ করতে গিয়ে কৃষকরা দিন দিন পুজি হাড়াচ্ছে তাই প্রয়োজনের বেশী ধান চাষ নয় বরং সবজি চাষেই কৃষকরা দেখতে পারবে সফলতার মুখ।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ধনারুহা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল করিম জানান, একটি জমিতে একসঙ্গে ৪টি ফসল চাষের সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় কৃষক আমির হোসেনের ভাগ্যে মিলেছে বিভিন্ন পুরস্কার। কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন বাংলাদেশের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বাংলাদেশ একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচার থেকে সম্মাননা ক্রেষ্ট এবং জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে বহু সনদ পেয়েছেন এই আমির হোসেন। তার কৃষি উৎপাদন চিন্তা আমাদের মুগ্ধ করেছে।

মুক্তিনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরশাদ আজিজ রোকন জানান, কৃষক আমির হোসেন আমার ইউনিয়নের গর্ভ। তার ইন্টারভিউ নিতে বিভিন্ন গণমাধ্যম এই ইউনিয়নে আসায় এই ইউনিয়নটি ক্রমেই দেশের বিদেশে পরিচিত হয়েছে।

সাঘাটা উপজেলা কৃষি অফিসার মাবিনুজ্জামান জানান, নিয়মিত কৃষি বিভাগ থেকে আমির হোসেনকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া কৃষি বিভাগের বিভিন্ন সভা সমাবেশে দৃষ্টান্ত হিসেবে আমির হোসেনকে উপস্থিত করা হয় অন্যান্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। যাতে তার এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কৃষকরা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে। 

Saturday, June 8, 2019

ব্লু-ইকোনমি: অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

এ কে এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী

: সমুদ্রে অবস্থিত বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে ব্লু-ইকোনমির মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদেশের কাক্সিক্ষত, দ্বি-অংকের জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ, অন্যান্য লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য বিশাল এই সমুদ্র সম্পদকে অতিদ্রুত আমাদের অর্থনীতির মূল ধারায় সংযুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাসসকে বলেন, এ দেশের সমুদ্র সীমায় প্রচুর সম্ভবনা রয়েছে। পানির নিচের এসব সম্পদকে আমরা সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারলে আমাদের অর্থনীতির গতি আরো বাড়বে।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ভিশন-২০৪১ অর্জনে ব্লু-ইকনমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র সম্পদের অবদান মাত্র ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অথবা ৬ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিদ্রুত সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমাকে অর্থনীতির কেন্দ্রে রূপান্তর করে বাংলাদেশ সামুদ্রিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র সম্পদের অবদান কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ব্লু-ইকোনমিকে আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত করতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে আরও বেগবান করার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অথবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় একটি উইং খোলার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব:) মো. খুরশেদ আলম জানান সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে দেশ। সাগরের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের অফুরন্ত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক বিপ্লবের ঘটানো প্রক্রিয়া চলছে। সমুদ্র জয়ের পর সেই বিপ্লব বাস্তবায়নের রোডম্যাপ এগিয়ে নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যে সামুদ্রিক অর্থনীতি বিকাশের জন্য ২৬টি কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে সরকার। এগুলো হল: শিপিং, উপকূলীয় শিপিং, সমুদ্র বন্দর, ফেরীর মাধ্যমে যাত্রী সেবা, অভ্যন্তরীণ জলপথে পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ রিসাইক্লিং শিল্প, মৎস্য, সামুদ্রিক জলজ পণ্য, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি, তেল ও গ্যাস, সমুদ্রের লবণ উৎপাদন, মহাসাগরের নবায়নযোগ্য শক্তি, ব্লু-এনার্জি, খনিজ সম্পদ (বালি, নুড়ি এবং অন্যান্য), সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদ, উপকূলীয় পর্যটন, বিনোদনমূলক জলজ ক্রীড়া, ইয়টিং এবং মেরিনস্, ক্রুজ পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা, কৃত্রিম দ্বীপ, সবুজ উপকূলীয় বেল্ট বা ডেল্টা পরিকল্পনা, মানব সম্পদ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং নজরদারি এবং সামুদ্রিক সমষ্টি স্থানিক পরিকল্পনা (এমএসপি)।
খুরশেদ আলম জানান, প্রত্যেকটি কার্যক্রমকে আরও কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং শিক্ষিত মানব সম্পদ অর্থনীতির চালিকা শক্তি, যা বিশ্বায়ন এবং প্রয্ুিক্তগত বিপ্লবে সহয়তা করবে। দক্ষ প্রকৌশলী, নৌবাহিনী, প্রযুক্তিবিদ, মৎস্য প্রযুক্তিবিদ, জৈব প্রযুক্তিবিদ এবং অন্যান্য বিভিন্ন পেশায় অভিজ্ঞ মানুষদের হাত ধরে ব্লু-ইকোনমির সফলতা আসাতে পারে।
বর্তমান সরকার ব্লু-ইকোনমির সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার উপর বিশেষ নজর দিচ্ছে। সমুদ্র গবেষণা ও মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য সাম্প্রতিক কালে সরকার বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং একটি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা ব্লু-ইকোনমিকে টেকসই উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করি।
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা, পর্যটন, সামুদ্রিক পরিবহন এবং তেল গ্যাস অনুসন্ধানসহ ব্লু-ইকোনমির বিভিন্ন সম্ভবনাকে আবিষ্কার করে কাজে লাগাতে একটি ‘টেকসই ব্লু-ইকোনমি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন করার জন্য বাংলাদেশ মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই)-র সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান।
২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে প্রথমে মিয়ানমার এবং পরে ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এতে ১ লক্ষ ১৮ হাজার ১৮৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ওপর আমাদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম উপকূল হইতে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সকল প্রকার প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদের উপর আমরা একচ্ছত্র মালিকানা লাভ করি।
এ সমুদ্রসীমায় তেল, গ্যাস, মূল্যবান খনিজ সম্পদ, মৎস্য আহরণ এবং সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কৌশলগত পরিকল্পনা নেওয়া হয় ২০১৪ সালে। বিশ্ব অর্থনীতিতে তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিদ। ৩০ শতাংশ গ্যাস ও জ্বালানি তেল আসছে সাগর থেকে। সুনীল অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাসস

Sunday, September 18, 2016

প্রতিবন্ধিতার বাধা জয়ের অনন্য এক প্রতিষ্ঠান ‘প্রয়াস’


।।এমএম মাসুদ।। 

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ। আর উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেলে তারাও হয়ে উঠতে পারে সমাজের আর দশজন মানুষের মতোই সৃষ্টিশীল ও কর্মক্ষম।

প্রয়াস বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন শিশু-কিশোরদের প্রতিবন্ধিতার বাধা জয়ের অনন্য একটি পাঠশালায় পরিণত হয়েছে। আস্থা আর নির্ভরতায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে গড়ে তুলছে এ প্রতিষ্ঠানটি।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে এখন বিশেষ শিশুদের জন্য শেষ আশ্রয়স্থলই বলা চলে। ‘বিশেষ শিশু, বিশেষ অধিকার’-এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত ‘প্রয়াস’-এর কার্যক্রম পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও সমাজের কাছে বোঝা হয়ে যাওয়া বিশেষ শিশুদের স্বাভাবিক জীবন গড়ে তুলতে সচেষ্ট।

Saturday, April 23, 2016

স্বপ্নবাজ এক নায়কের কথা

স্বপ্নবাজ এক মানুষ তিনি। স্বপ্ন দেখেই বসে থাকেন না। স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমে পড়েন কাদাজলে। সফল হয়ে তারপর ওঠেন। এমন এক স্বপ্নবাজের নাম সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। দেশের প্রথম সারির একজন শিল্পপতি। ব্যবসাক্ষেত্রের একজন সফল নায়ক। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে দুবাইভিত্তিক রাস আল খাইমা (আরএকে) গ্রুপ। ৭০ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ১৯৭৭ সালে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসা এখন কয়েকশ’ কোটি টাকায় ছাড়িয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি বিভিন্ন পণ্য দেশ ছাড়িয়ে দখল করে নিয়েছে ইউরোপ আমেরিকার বাজার। একান্ত আলাপে একরামুজ্জামান তার জীবনের বাঁক নেয়া নানা মোড়ের আদ্যপান্ত জানিয়েছেন।
  
হতাশ নয়, আশাই যার পথচলা। আর আশা নিয়ে পথচলাতেই তার প্রতিষ্ঠিত আরএকে সিরামিক আজ দেশের সিরামিক শিল্পের প্রতিকৃত। আরএকে সিরামিক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ একরামুজ্জামান সততা, নিষ্ঠা আর একাগ্রতা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সফল ব্যবসায়ী রূপে। দেশের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দেশে শত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে দেশসেবায়ও রাখছেন অনন্য ভূমিকা। সেরা করদাতা হিসেবেও সরকার করেছে পুরস্কৃত। একে একে গড়ে তুলেছেন সিরামিকস, ফার্মাসিউটিক্যালস, ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, সিকিউরিটি সার্ভিস, টাইলস অ্যান্ড স্যানেটারিওয়্যার, পেইন্টস, পাইলিং, কয়েল কোম্পানি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পরসোলিন, স্পিনিং, প্যাকেজিং এবং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিসহ নানা শিল্পকারখানা।

Monday, April 4, 2016

সিরামিক শিল্পের সফল ব্যবসায়ি

মন্দা ব্যবসা। দিন চলাই ছিল কষ্টের। কোনরকমে টেনেটুনে সংসার চলছিল। এর আগে চাকরি করতেন তিনি। দুবাইয়েরই রকউল ফ্যাক্টরিতে। জুনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে। একটি ফোনেই চাকরি ছেড়ে দেন। হাতে মাত্র ৭০ হাজার টাকা পুঁজি। অনেক ভেবেচিন্তে ব্যবসা দিয়ে বসেন। দোকানের ডেকোরেশন করতেই বেশির ভাগ টাকা চলে যায়। এখন মালামাল তুলাই কঠিন হয়ে পড়ে। যে টাকা ছিল, সে টাকা দিয়েই তিনি কিছু গার্মেন্ট পণ্য দোকানে তোলেন। কিন্তু না, এ ব্যবসা তার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে না। ব্যবসা জমছে না। কি করবেন তিনি? নানা চিন্তা তার মাথায়। তবে হতাশ নন। তিনি হতাশ হবার পাত্র নন। লেগে আছেন। এভাবে দিন চলতে থাকে। কষ্টের দিন। ভাবনার দিন। কিছু না পাওয়ার দিন। এই না পাওয়াই তার জীবনকে ঘুরিয়ে দেয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে যার বুকে সাগরের ঢেউ, তিনি হয়ে ওঠেন আনন্দে উদ্বেলিত। আজ তিনি বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন শিল্পপতি। ব্যবসায়ী।

গুটিকয়েক ড্রেস থেকে এখন ১০ লাখ টাকার মালিক

রাজধানীর লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্স থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন আরমিনা ইসলাম বিপা। চাকরির পিছনে না ছুটে ফ্যাশান ডিজাইনে কোর্স করেন তিনি। এখন নিজেই যেকোনো হস্তশিল্পের কাজ করতে পারেন। 
প্রথমে কয়েকটি ড্রেস দিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন বিপা। আর এখন ১০ লাখ টাকার মালিক তিনি। কিছু নারীর কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করেছেন বিপা। অনেক ফ্যাশান হাউজ বিপার কাছ থেকে নানা পণ্যও কিনে থাকে। 
নতুন নতুন পণ্য তৈরিসহ পুরনো পণ্য ফের ব্যবহার করে নান্দনিক পণ্য তৈরিতে পারদর্শীও তিনি। সকল নান্দনিক পণ্যের সমাহারে গড়ে তুলেছেন ‘নির্ভানা’। নানা ধরনের ড্রেস ছাড়াও ল্যাম্পশেড, গ্লাস পেইন্ট, পেন হোল্ডার থেকে শুরু করে সব ধরনের হস্তশিল্পের কাজ করতে পারেন বিপা।

Saturday, April 2, 2016

পরিবেশ বান্ধব এক গন্তব্য

ছবি: খালেদ সরকার

আরিফুর রহমান | আপডেট:  | 

আমার পড়াশোনার বড় একটা অংশ কেটেছে সিলেটে। সিলেট ক্যাডেট কলেজের আশপাশে সারি সারি চা-বাগান। আর তারও অনেক পরে শ্রীমঙ্গলের রাজঘাটে জেমস ফিনলের চা-বাগানে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করি। এসব মিলিয়ে আমার চা-বাগানকেন্দ্রিক পর্যটনের স্বপ্ন দেখা শুরু। টেক্সটাইল ব্যবসার পাশাপাশি আমি আর আমার ব্যবসায়িক অংশীদার সালাম ভাই দিনের পর দিন রিসোর্ট করার জন্য জায়গা খুঁজে বেড়াই। আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু তাপস আর সিনিয়র কামাল ভাইয়ের মাধ্যমে ‘দি প্যালেস’-এর জায়গাটার খোঁজ পাই। তাঁর নিজের কিছু আর অন্য অনেকের জায়গা সেখানে ছিল। পরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শুরু হয় স্বপ্নের রিসোর্ট তৈরির কাজ। 

কামাল ভাই আর লিনা ভাবি আমাদের এই স্বপ্নের অংশীদার। প্রথমেই আমরা চিন্তা করি কী করে সব গাছগাছালি রেখে প্রকল্পটা সাজানো যায়। সালাম ভাই এরই মধ্যে চীন ও থাইল্যান্ডে বিভিন্ন হলিডে রিসোর্ট, নেচার রিসোর্ট ও টি রিসোর্টের খোঁজ নিতে শুরু করেন। কয়েকজন স্থপতির সঙ্গে দফায় দফায় সভা চলতে থাকে। আমাদের টেক্সটাইল ব্যবসার কারণেই চীনে ভালো যোগাযোগ ছিল। সেখানে মি. চেন আমাদের একজন স্থপতির সঙ্গে বসিয়ে দেন। তিনিই প্রথম থিমটা তৈরি করে দেন। সালাম ভাইয়ের চোখ আরও উজ্জ্বল হয়। আমি পাশ থেকে বসে সেই আলো দেখি। 

পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা হচ্ছে। ক্যাডেট কলেজের তিন ছোট ভাই স্থপতি পারভেজ, কাইয়ুম ও শিশিরও অনেক ইনপুট দিয়েছেন। পারভেজ আর কাইয়ুম আমাদের দি প্যালেসের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কাজ করেছে। তাঁদের সবার কাছে আমরা অনেক ঋণী। আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে প্যালেস পর্যন্ত যে সড়ক হয়েছে, সেটা আঁকাবাঁকা এবং চা-বাগানের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। সেখানেও হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলা প্রশাসন সহায়তা করেছে। আমাদের দেশে সাধারণত শিল্প স্থাপনের সময় প্রশাসনিক সহায়তার অভিজ্ঞতা খারাপ হয়। এখানে কিন্তু তা হয়নি। যে কারণে অনেক উদ্যোক্তা আমাদের কাছে এ গল্প শুনে আমাদের ভাগ্যবান বলেন। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সবার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। 

দি প্যালেস নাম কেন রাখা হলো? এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। লেখক আনিসুল হক বলেন, এটা হওয়া উচিত ছিল গ্রিন প্যালেস। আমরা নামকরণের সময় আসলে কিছুই ভাবিনি। আমার এক অংশীদার ইকবাল অবশ্য সব সময় এ নামের পক্ষে। তার যুক্তি হলো ৩৭-৩৮ হাজার গাছগাছালিতে ভরপুর এই প্রকল্প এমনিতেই সবুজ। রিসোর্ট এলাকায় আলোর যে খেলা আর প্রাচীন আমলের মতো করে লবি কিংবা মুভি হলের উঁচু ছাদ, তা ইকবালের মাথা থেকেই এসেছে। 

রিসোর্টের মধ্যে অনেক টিলা, দুটো হ্রদ আর প্রচুর গাছ রয়েছে। সবচেয়ে মজা হচ্ছে রিসোর্টের পাশে তিনটি চা-বাগান। শুরু থেকেই ভাবছিলাম কীভাবে পরিবেশবান্ধব একটা রিসোর্ট করা যায়। সে কারণেই কোনো টিলা কাটা হয়নি। টিলাগুলো সেতু দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে। আগের গাছগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে, আরও শত শত গাছ লাগানো হয়েছে। গ্যাস জেনারেটরের কুলিং সিস্টেমের পানিকে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় গরম পানির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে কোনোভাবেই পরিবেশে প্রভাব না ফেলে। এমনকি দৃষ্টিসীমায় সবুজের বাইরে কিছু যেন চোখে না পড়ে, সে জন্য রিসোর্টজুড়ে মাটির নিচ দিয়ে তার টানা হয়েছে। এমনকি পুরো রিসোর্টে ব্যবহৃত পানিকে পুনঃপ্রক্রিয়া করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়, যাতে কোনোভাবেই পরিবেশদূষণ না হয়। একই সঙ্গে আধুনিক সব যোগাযোগের জন্য ৩০ এমবিপিএস গতির স্পিড আর তার সঙ্গে পাঁচটি সভাকক্ষ। কলামহীন ব্যাংকুয়েট হলও তার পাশেই। 

পত্রিকায় পড়ি কিংবা বিভিন্ন সময় টিভি চ্যানেলগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের বক্তৃতা শুনি। পরিবেশবান্ধব প্রকল্প করার জন্য তাঁরা প্রচুর উদ্যোগ নিয়েছেন এবং নিয়ে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে ভাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ পুরো পর্ষদ দি প্যালেস দেখলে কী খুশিই না হতেন। আমাদের মতো নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য এটা হতে পারে খুব উৎসাহমূলক। আমাদের এই পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়নের পেছনে রূপালী ব্যাংকেরও অনেক অবদান। 

আমার কাছে অনেকেই প্রশ্ন করেন, স্পিনিং গার্মেন্টস ব্যবসার পাশাপাশি রিসোর্ট কেন? সিলেট এবং চা-বাগান—দুটোর প্রতি ছোট থেকে দেখা ভালো লাগা তো আছেই। আর তার সঙ্গে আমার কাছে মনে হয়েছে, চা-বাগানের সৌন্দর্যের কিছুই এখনো উন্মোচিত হয়নি। পরিবেশবান্ধব প্রকল্প করার জন্য এর চেয়ে উত্তম জায়গা আর হয় না। পৃথিবীর অনেক রিসোর্টে যাওয়ার জন্য লোকজন উন্মুখ হয়ে থাকে। আমি স্বপ্ন দেখি দি প্যালেস সেই মানের একটা গন্তব্য হবে। সিলেটের জাফলং দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ে যেটা আসছে, সেটা এই রিসোর্টের পাশ দিয়েই যাবে। বিদেশিরাও আসবেন আমাদের পাশাপাশি। একই সঙ্গে চা-বাগানে যে জনগোষ্ঠী আছে, তাদের জীবনমান উন্নত হতে থাকবে। এভাবেই এগিয়ে যাবে দেশ—বাংলাদেশ। 

আরিফুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দি প্যালেস, বাহুবল, হবিগঞ্জ

সবার আস্থা আমাদের শক্তি

অঞ্জন চৌধুরী | আপডেট:  |

    
ছবি: জাহিদুল করিমব্যবসা জীবনের শুরুতেই আমাকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। ওষুধ নিয়ে স্কয়ার তখন সারা দেশে পরিচিত নাম। কিন্তু মেরিল নামটি নতুন। একটি মাত্র পণ্য জুঁই নারিকেল তেল নিয়ে ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে স্কয়ার টয়লেট্রিজ। দেশে ফেরার পর বাবা (প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী, চেয়ারম্যান, স্কয়ার গ্রুপ) আমাকে এর দায়িত্ব দেন। গোড়াতেই আমার কাজ হলো, মেরিল নামটি যত দ্রুত সম্ভব সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলা।
ওই সময় মাসের ২৫ দিনই ঢাকার বাইরে থেকেছি। দেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে যাইনি। সেখানে বিভিন্ন মার্কেটে আর দোকানগুলোতে যেতাম। এখন একজন বিক্রয় প্রতিনিধি যেভাবে সবার কাছে যান, তখন আমিও তেমনিভাবে গিয়েছি।
বারবার কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, ‘আপনারা কারা? আপনাদের প্রতিষ্ঠানের নাম তো শুনিনি। কী দেবেন? বাকি কত দেবেন?’
আমি সবাইকে বলেছি, আমাদের বাকির কোনো ব্যাপার নেই।
শুনে কেউ কেউ বলেছেন, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। আপনি যান।’
আমি কিন্তু চলে আসিনি। বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কিছুক্ষণ পর কেউ আবার দোকানে ডেকে নিয়ে বসতে দিয়েছেন, চা দিয়েছেন, কথা বলেছেন। এটা আমার জন্য একটা শিক্ষা। তা হলো, ধৈর্য থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।
‘মেরিল’ নামটা ক্রমেই পরিচিত হতে লাগল। আমাদের পণ্য বাড়ছে। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার। সেখান থেকে হলো স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড।
এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতেই একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়ে। খোলা বাজারে প্রচুর ভেজাল মসলা পাওয়া যেত। আমাদের বাড়ি ছিল মফস্বল শহরে। এর একটা বাড়তি সুবিধা হলো, সেখানে খাঁটি জিনিসটা আমাদের হাতের নাগালে। সেই ভাবনা থেকে মনে হলো, আমরা তো ভালো মানের মসলা বাজারে দিতে পারি। এভাবে পাবনায় স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গেই স্কয়ার কনজুমার প্রোডাক্টস লিমিটেড শুরু করি।
তবে একটা সময়ে এসব দিকে আমার মোটেও আগ্রহ ছিল না। ১৯৭১ সালে আমি ১৭ বছরের তরুণ। ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে পড়তাম। যুদ্ধ শুরু হলে ফিরে যাই পাবনায়, আমাদের বাড়িতে। কিন্তু সেই সময়ে হাত-পা গুটিয়ে কি বসে থাকা যায়! আমিও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বন্ধুরা মিলে চলে যাই ভারতে। যোগ দিই মুজিব বাহিনীতে। দেরাদুনের চকরাতা আর্মি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো প্রশিক্ষণ নিই। একসময় দেশ স্বাধীন হলো। এখন আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।
ওই সময় দেশের তরুণদের একটা অংশ চলে যায় রাশিয়ায়। বাবা আমাকে নিয়ে তেমনি কিছু ভেবেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় ট্রাই-স্টেট কলেজের বিদেশি শিক্ষার্থীদের উপদেষ্টা ছিলেন একজন বাঙালি প্রকৌশলী, বাবার বন্ধু। তাঁর মাধ্যমে বাবা সেখানে আমার ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সাত দিনের মধ্যেই চলে যাই। এই কলেজটি এখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। পড়াশোনা করেছি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। এরপর আমাদের ব্যবসা-সংক্রান্ত কিছু দিক ওখানে দেখাশোনা করেছি। রিয়েল এস্টেট আর গার্মেন্টস ব্যবসা। কিন্তু তখন মন পড়ে থাকত দেশে। প্রায় প্রতিবছরই বড়দিনের ছুটিতে দেশে আসতাম। পরিবার আর বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতাম।
আমরা কিন্তু সোনার চামচ কিংবা রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। বাবার অনেক কঠিন সময় গেছে। গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের দূরত্ব ছিল ১২ মাইল। সন্ধ্যার পর আর বাস পাওয়া যেত না। পাবনায় একটা মিশন আছে। যেদিন অফিসের কাজ শেষ করতে দেরি হয়ে যেত, সেদিন রাতে বাবা ওই মিশনের বারান্দায় ঘুমিয়েছেন। এমন একসময় ছিল, আমার বড় ভাইয়ের জন্য দুধ কেনার টাকা পর্যন্ত ছিল না। ছোটকালে আমার কয়টা শার্ট ছিল, কোন জামার রং কেমন ছিল, তা এখনো মনে আছে। একটা বেল্ট ছিল। দুই-তিনটা খেলনা ছিল। মনে থাকার কারণ, এইটুকুই ছিল আমার জন্য বিশেষ কিছু। তবে আমরা কখনো কিছুর অভাব বোধ করিনি।
আমরা কিন্তু সোনার চামচ কিংবা রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। বাবার অনেক কঠিন সময় গেছে... এমন একসময় ছিল, আমার বড় ভাইয়ের জন্য দুধ কেনার টাকা পর্যন্ত ছিল না... তবে আমরা কখনো কিছুর অভাব বোধ করিনি
বাবা ব্যবসা শুরু করেন ১৯৫৮ সালে। দাদার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। তখন তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস। এরপর তা স্কয়ার ফার্মা লিমিটেড হয়। গত শতকের আশির দশকে আমাদের ব্যবসার প্রসার ঘটে। শুধু ওষুধ নয়, তখন স্কয়ার থেকে নানামুখী ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাবা আমাকে দেশে ফিরে আসার জন্য বললেন। কারণ, বাবাকে ব্যবসার অনেক দিকে নজর দিতে হয়। তত দিনে আমিও পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছি।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড থেকে নানা দিকে ব্যবসার প্রসার হতে থাকে। একটি পণ্য নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের শুরু, তা ডালপালা ছড়ায়। নিজেদের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গিয়েই নতুন অভিজ্ঞতা হয় আমার। দেখি নির্মাতাদের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো কাজ পাওয়া যায় না। পণ্য বিপণনের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের একটা যোগসূত্র তো আছেই। এখানে এর ব্যাঘাত ঘটছিল। ফলে ক্ষোভ থেকেই একসময় নিজেই বিজ্ঞাপনী সংস্থা গড়ে তুলি, নাম মিডিয়াকম। তখন আবার দেখি চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সেই ভাবনা থেকে জন্ম নেয় মাছরাঙা। এখান থেকে বিজ্ঞাপনচিত্র আর টিভি নাটক তৈরি করতে শুরু করি। চলচ্চিত্রের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হই। এ পর্যন্ত লালসালু, শঙ্খনাদ, আয়না, লালন, মনপুরা ছবিগুলো প্রযোজনা করেছি। মনপুরার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। এভাবে গণ্যমাধ্যমেও কাজের শুরু আমাদের।
বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুমতি পায় একুশে টিভি। এর লাইসেন্স পান এ এস মাহমুদ। তিনি ছিলেন বাবার বন্ধু। তাঁর আমন্ত্রণে আমরা এই টিভি চ্যানেলের পরিচালক হলাম। পরে নানা কারণে আমরা এটি ছেড়ে দিই। পরে আমাকে এনটিভির শেয়ার দেওয়া হয়। মাছরাঙার নামে টিভির লাইসেন্স পাওয়ার পর আমি ওই শেয়ার বিক্রি করে দিই। মাছরাঙা টিভিকে ঢেলে সাজাই। অনুষ্ঠানগুলো এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করি, যাতে তা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দেখতে পারে। এখানে আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, ইতিবাচক বাংলাদেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। মাছরাঙা টেলিভিশন এবং রেডিও দিনরাত-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কাজ করছি এখন।
ছোটবেলা থেকে আমি খেলাধুলা ভালোবাসতাম। ফুটবল, ক্রিকেট আর শীতের সময়ে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ১৯৯১ সালে দেশে ফেরার পর আমাকে পাবনার জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন সরাসরি খেলার উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। পরিচিতজনদের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আবাহনীর সঙ্গে। পরে আবাহনী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হয়। আর আমি হই এর পরিচালক। পাশাপাশি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আমাকে যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এখন কাজ করছি। পাবনা রাইফেল ক্লাবের সঙ্গে আমি অনেক বছর ধরেই জড়িত আছি। আমরা পাবনা এবং জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করছি।
আর কিছু সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছি আমি। অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট পদে কাজ করছি। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্বরত আছি অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন কোম্পানি ওনার্স সংগঠনটির।
বাংলাদেশের তরুণ শিল্পীদের সহযোগিতা করার জন্য ‘সোসাইটি ফর প্রমোশন ফর বাংলাদেশ আর্ট’ প্রতিষ্ঠা হয় ২০০২ সালে। এখন এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গেও যুক্ত আছি।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর পান্থপথে একটা জায়গা কেনেন বাবা। তিনি সিদ্ধান্ত নেন সেখানে একটা হাসপাতাল করার, স্কয়ার হাসপাতাল। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। এখন আমরা এ দেশেই সবাইকে বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
বাবা ছিলেন আমার শিক্ষক, পথপ্রদর্শক। ছোটবেলা থেকে দেখেছি, বাবা খুব নিয়ম মেনে চলেন। তাঁর শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, সরলতা; সবকিছুই ছিল অনুকরণীয়। সময়ের কাজ তিনি সময়ে করতেন। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত শ্রমিক অসন্তোষ হয়নি। প্রতিবছর বাবা শ্রমিকসংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করতেন। নিয়ম মেনে নয়, এটাই ঐতিহ্য। প্রত্যাশার চেয়ে তিনি বেশি দিয়ে এসেছেন সব সময়। তিনি তাদের সঙ্গে যেভাবে আলোচনা করতেন, মনে হতো যেন নিজের পরিবারের মধ্যে বসে আলোচনা করছেন। বাবার কাছ থেকে এভাবেই শিক্ষা পেয়েছি।
সবার আস্থা আমাদের শক্তি। এত বছরে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সবার মাঝে যে আস্থা তৈরি হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে যেন তা আরও সুদৃঢ় হয়, সেই চেষ্টা আমার অব্যাহত আছে।
(অনুলিখন)
অঞ্জন চৌধুরী, পরিচালক, স্কয়ার গ্রুপ

প্রাণ আজ বিশ্ববাসীর কাছে ‘বাংলাদেশের প্রাণ’

আহসান খান চৌধুরী |  

ছবি: খালেদ সরকার
আয়তনে পৃথিবীর ক্ষুদ্র একটি দেশ হলেও ভৌগোলিক অবস্থান, উর্বর মাটি ও বিশাল জনগোষ্ঠীর কারণে সম্ভাবনাময় ‘নেক্সট ইলেভেন’-এর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বাংলাদেশ। এ দেশের সন্তানেরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। দেশের সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোর মধ্যে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প সম্প্রতি বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করেছে। এ শিল্পে বাংলাদেশের ‘প্রাণ’ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের ১১৮টি দেশে পৌঁছে গেছে। রপ্তানিতে অবদান রাখায় পরপর ১০ বছর জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশি বহুজাতিক শিল্প হিসেবে ‘প্রাণ-আরএফএল’ বহুদূর এগিয়েছে।
তিন দশকেরও বেশি সময়ের পথচলায় প্রাণ-আরএফএল শিল্প পরিবার আজ বেশ সমৃদ্ধ। খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক ও কাস্ট আয়রন পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ পণ্য আমরা বাজারজাত করছি। সম্প্রতি আমরা পোশাকশিল্প, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক, বাইসাইকেল, হিমায়িত খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন শুরু করেছি। বিশ্ব বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের তৈরি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে আমাদের পণ্য। গর্বে বুক ভরে যায় এই ভেবে যে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, যুক্তরাজ্য, দুবাই, মালয়েশিয়ার বিখ্যাত সুপার শপের তাকগুলোয় প্রাণের পণ্য শোভা পায়। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত সস কোম্পানি বায়রন বে চিলির সস বানাচ্ছে প্রাণ। ভারতের ডিমার্ট, যুক্তরাজ্যের উইলকিনসন, যুক্তরাষ্ট্রের ডলারামা, ডেনমার্কের নভোনর্ডিক, ফ্রান্সের ক্যারিফোর, অস্ট্রেলিয়ার উলওয়ার্থ, স্পেনের ইসিআই, মধ্যপ্রাচ্যের রামিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য তৈরি করছে ‘প্রাণ-আরএফএল’ গ্রুপ।
আমাদের পথচলা শুরু হয় ১৯৮১ সালে রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তখন ঢালাই লোহা দিয়ে বিভিন্ন কৃষি ও সেচ উপকরণ তৈরি করা হতো। এরপর কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হই আমরা। ১৯৮৫ সালে নরসিংদীতে স্বল্প পরিসরে কলা, পেঁপে, আনারস, রজনীগন্ধা ইত্যাদি চাষ করা শুরু করি। শুরু হলো এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড, তথা প্রাণ-এর যাত্রা। কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা লক্ষ করি, দেশে অনেক পণ্য উৎপন্ন হলেও মৌসুমের সময় পণ্যের দাম কমে যায় এবং ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন কৃষক। এ ছাড়া সংরক্ষণের অভাবে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তাই কৃষিপণ্য উৎপাদনের চেয়ে আমরা তা সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে উদ্যোগী হই। ক্রমান্বয়ে একটু একটু করে এগোতে থাকি আমরা। ১৯৯৩ সালে নরসিংদীতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য একটি কারখানা স্থাপন করি। সেখানে বিভিন্ন ফলমূলের জুস, শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত করা শুরু করি। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে ক্রমান্বয়ে আমরা বিভিন্ন ড্রিংকস, সস, জেলি, চানাচুর, চিপস, চকলেট, বেকারি, দুগ্ধজাত পণ্য বাজারজাত করতে থাকি।
কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে লক্ষ করলাম কৃষি বিষয়ে আমাদের দেশের কৃষকদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণও তাঁদের হাতে যথাযথভাবে পৌঁছায় না। চিন্তা করলাম, এসব বিষয়ে যদি কৃষকদের সহায়তা দেওয়া যায়, তাহলে জমিতে কয়েক গুণ বেশি ফলন সম্ভব। তাই আমরা কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করে কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণ, উন্নত বীজ সরবরাহ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ এবং কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে থাকি। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, চুক্তিবদ্ধ কৃষকেরা বেশ ভালো করছেন। একই জমিতে আগের চেয়ে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে পণ্য সংগ্রহে ক্রমান্বয়ে আমরা কৃষকদের সঙ্গে সম্পৃক্তি বাড়াতে থাকি। বর্তমানে আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন প্রায় ৮০ হাজার চুক্তিভিত্তিক কৃষক। তাঁদের চাষ করা পণ্য ক্রয়ে আমরা কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে পণ্যের বাজারদর যাচাই করি। এরপর যথাযথ মূল্য পরিশোধ করে তাঁদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করি। কৃষকদের কাছ থেকে আম, টমেটো, বাদাম, ডাল, আনারস, পেয়ারা, চাল, মসলা প্রভৃতি সংগ্রহ করা হয়। এতে কৃষকেরাও লাভবান হচ্ছেন, আমরাও মানসম্পন্ন পণ্য পাচ্ছি।

ছোট ছোট পণ্যের পসরা সাজিয়ে প্রাণ-আরএফএল আজ সারা বিশ্বের ডাইনিং টেবিলগুলোয় ও আড্ডাগুলোয় পৌঁছে গেছে। একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে বিশ্ববাসীর আবেগ অনুভুতির সঙ্গে। আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ আজ বিশ্ববাসীর কাছে ‘বাংলাদেশের প্রাণ’
সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে আমরা বেশ কয়েক বছর যাবৎ দুগ্ধশিল্পে গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনাময় এই খাত নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। এ শিল্পের উন্নয়নে আমরা খামারিদের পশুপালন-বিষয়ক প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও ওষুধ, রোগ প্রতিষেধক টিকা, কৃত্রিম প্রজনন, গবাদিপশুর খাবার ইত্যাদি সরবরাহ করছি। এ ছাড়া প্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয়ে কৃষকদের আমরা আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছি। নাটোর, পাবনা ও রংপুরে অবস্থিত আমাদের তিনটি ডেইরি হাব-এর মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করি।
আমাদের করপোরেটব্রত, ‘দারিদ্র্য ও ক্ষুধা জীবনের অভিশাপ। আমাদের লক্ষ্য লাভজনক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি করা।’ জাতিসংঘ কর্তৃক ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) গৃহীত হয়েছে, তা অর্জনে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ব্যাপক অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৭টি লক্ষ্য অর্জনে প্রাণ-আরএফএল সরাসরি অবদান রাখবে। সব ধরনের দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা দূর করা এসডিজির প্রথম এবং দ্বিতীয় লক্ষ্য। প্রাণ-আরএফএল এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে। ইতিমধ্যে প্রাণ-আরএফএল দেশের প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক তাঁদের জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রাণ-আরএফএলের ওপর নির্ভরশীল।
নারীর সম-অধিকার এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা এসডিজির পঞ্চম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রাণ-আরএফএল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। আমাদের কারখানাগুলোয় শতকরা ৮০ ভাগের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছেন। নারীর সম-অধিকার অর্জন এবং ক্ষমতায়নে এটি বিরাট ভূমিকা রাখছে। প্রাণ-আরএফএল তার করপোরেট মিশন অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে ক্রমান্বয়ে অবদান রেখে চলেছে। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা সহযোগিতা করছি। এসডিজির নবম লক্ষ্য টেকসই শিল্পায়ন ও উদ্ভাবন। এ ক্ষেত্রেও আমরা অবদান রাখছি। আমাদের কারখানাগুলোয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) ব্যবহার করছি। ফলে, পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দূষণ রোধ হচ্ছে। আমরা পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য নিয়মিত গবেষণা করছি এবং সময়ে সময়ে পণ্যে অভিনবত্ব নিয়ে আসছি।
কৃষিক্ষেত্রে এ দেশের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে কৃষিনির্ভর শিল্প উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান এবং খাদ্যের গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে বিশ্বমানের ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া স্থল ও সমুদ্রবন্দরে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। রপ্তানি বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন দেশে শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা দূর করার জন্য তৎপরতা চালাতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বিশ্ব আজ বিশ্বগ্রামে পরিণত হয়েছে। মুহূর্তেই ক্রেতারা বিভিন্ন দেশের পণ্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। বাজারে এখন প্রতিযোগীর অভাব নেই। তাই ব্যবসায় ভালো করার সবচেয়ে বড় নীতি হচ্ছে মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করা। এ নীতি অনুসরণ করলে দেশীয় পণ্য বিশ্ব বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।
ছোট ছোট পণ্যের পসরা সাজিয়ে প্রাণ-আরএফএল আজ সারা বিশ্বের ডাইনিং টেবিলগুলোয় ও আড্ডাগুলোয় পৌঁছে গেছে। একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে বিশ্ববাসীর আবেগ অনুভূতির সঙ্গে। আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ আজ বিশ্ববাসীর কাছে ‘বাংলাদেশের প্রাণ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। এভাবেই আমরা বিশ্বে বাংলাদেশের উপস্থিতি জানান দিতে চাই।
আহসান খান চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ