Monday, January 13, 2014

বরগুনায় সৌর সেচ ব্যবস্থায় কৃষি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে

বরগুনা: বরগুনার বিভিন্ন এলাকার কৃষি জমিতে চলছে সৌর সেচ পদ্ধতি বা সোলার ইরিগেশন পাম্পিং সিস্টেম। সূর্যালোকের সাহায্যে ফসলী জমিতে এই সেচ ব্যবস্থা কৃষকদের যেমন জ্বালানী তেল বা বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীলতার হাত থেকে বাঁচিয়েছে পাশাপাশি তেমনি বিদ্যুতের একটি বড় ঘাটতি পূরণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সৌর শক্তিকে ব্যবহার করে বরগুনার কৃষকরা এখন চাষ করছেন শত শত একর জমি। 

বাংলাদেশে বিদ্যুতের একটি বড় অংশের প্রয়োজন পড়ে ধান ক্ষেতে সেচের জন্য। বিদ্যুত সংকটের কারণে তিনটি মৌসুমে জমিতে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনও কষ্টসাধ্য। সেচ কাজে তাই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের কথা ভাবা হচ্ছে জোরেশোরে, হচ্ছে গবেষণাও। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে সরাসরি সেচ পাম্প চালানোর গবেষণার কথা বিজ্ঞান প্রজন্মে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি প্রচলিত সৌর বিদ্যুতের অধিক ব্যবহারের কথাও ভাবা হচ্ছে। এসবের সূত্র ধরেই প্রচলিত প্রযুক্তিতেই চলছে বরগুনার সৌর সেচ প্রকল্প। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় স্থানীয় একটি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) দুই বছর আগে বরগুনায় বিভিন্ন এলাকায় ৬টি সোলার ইরিগেশন পাম্পিং সিস্টেম স্থাপন করে। বরগুনার আমতলী উপজেলার নীলগঞ্জ গ্রামের কয়েকটি এলাকায় এই কার্যক্রমে উপকৃত হচ্ছেন কয়েকশ কৃষক। প্রতিটি প্রকল্পের অনুকূলে ৪০ একর জমি চাষের আওতায় নেয়া আছে। ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রতিটি সোলার সিস্টেমে ৪৮টি সোলার প্যানেল রয়েছে। সৌর শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৮ লাখ লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে এই পাম্প-এর মাধ্যমে। আপাত দৃষ্টিতে প্রকল্পটি ব্যয়বহুল মনে হলেও ইতোমধ্যেই কৃষকদের নিকট সহনশীল এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অপরদিকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর গুরুত্ব কৃষকদের আশা জুগিয়েছে। 
২০১০ সালে আরডিএফ বরগুনায় পরীক্ষামূলকভাবে এই সোলার ইরিগেশন সিস্টেম প্রথম স্থাপন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আতিউর রহমান তখন এ প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। কৃষকদের চাহিদা দেখে পরবর্তীতে বাকী সোলার সিস্টেমগুলো স্থাপন করে আরডিএফ। শুধু বরগুনাতেই নয়, উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড় জেলায়ও ৫টি প্রকল্প চলছে, জানালেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী। 

দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ ফসলি জমিগুলো সেচের অভাবে বছরে একবার মাত্র চাষ করে থাকেন কৃষকরা। বাকি দুটি মৌসুমে জমিগুলো খালি পড়ে থাকে। কেউ কেউ ডিজেল চালিত মেশিন দিয়ে মাঠে পানি সেচ দিয়ে চাষ করেন। যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এক সময় নদীর ভরা জোয়ারের পানি অথবা বৃষ্টির অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো কৃষকদের। কখন মাঠে পানি আসবে তখন শুরু হবে কৃষি কাজ। সৌর সেচ সুবিধা প্রাপ্ত অঞ্চলে এখন আর অপেক্ষা নয়। সারা বছরই পানি পাওয়া যাচ্ছে। সুবিধা অনুযায়ী চাষও চলছে, আলাপকালে জানালেন স্থানীয় কৃষকরা। 

সৌর সেচ সুবিধা পাওয়া আমতলী উপজেলার নীলগঞ্জ গ্রামের কৃষক রুহুল আমীন কাজী (৭২) বলেন, এক সময় কষ্ট করে জমিতে পানি সেচ দিয়ে কোন মতে এক মৌসুমে ফসল ফলাতে হতো। এখন এই সোলার সিস্টেম দিয়ে তারা কৃষি ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ সুবিধার কথা ভাবছেন। 

ধানখালী গ্রামের আব্দুল লতিফ গাজী (৬২) বলেন, প্রথম দিকে এই সিস্টেম স্থাপনের সময় বুঝতে পারেননি এর গুরুত্ব। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এই সৌর সেচ প্রকল্প। এখন তারা স্বপ্ন দেখছেন নানাভাবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের খাদ্য সংকট নিরসনে নিরলস কাজ করে যাবেন তারা। 

এই সোলার সিস্টেমের কারিগরী সহযোগিতা দিয়েছে শেরপা সোলার পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। শেরপা’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম এ তাহের বলেন, সৌর সেচ পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে পরিবেশ বান্ধব এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতি চালু করে দেশে একটি সবুজ কৃষি বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। তিনি বলেন, সোলার সিস্টেম একবার স্থাপন করে কোন ধরনের খরচের ঝামেলা ছাড়াই ২০ বছর টানা সার্ভিস দিয়ে যাবে। ব্যাটারি ছাড়া সরাসরি সূর্যের আলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন পানি দিয়ে যাচ্ছে এই সোলার সিস্টেম। সৌর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি পরিবেশ বান্ধব কৃষি কাজের সূচনা করা হলো। 

আরডিএফ’র পরিচালক আলি আহমেদ বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে বরগুনায় স্থাপন করা হয়েছে এই সৌর সেচ প্রকল্প। দেশের খাদ্যে ঘাটতি, বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে এই প্রকল্পটি কৃষি ক্ষেত্রে যথেষ্ট কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। 

আরডিএফ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম গোলাম মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন এবং মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের আর্থিক সহায়তায় আরডিএফ সোলার প্রকল্পগুলো স্থাপন করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ইডকল-এর সঙ্গে আরডিএফ এই কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সম্পৃক্ত হয়েছে। 
একটি স্থায়ীত্বশীল প্রাকৃতিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা হিসেবে সোলার ইরিগেশন সিস্টেমের মাধ্যম সেচ দিলে বিদ্যুৎ বা জ্বালানী সাশ্রয় হবে। ডিজেল এবং বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদনকে তরান্বিত করতে হবে।

No comments:

Post a Comment