Thursday, May 22, 2014

পোল্ট্রি শিল্প ও কৃষিকাজে নারীর অবদান

ডেস্ক রিপোর্ট: কয়েক দশক আগেও গ্রামীণ নারীরা ঘরকন্যার কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগী পালন করে বাড়তি দু’পয়সা আয়-উপার্জন করতো। হালে নারীরা পোল্ট্রি শিল্পকে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। পোল্ট্রি শিল্প ছাড়াও নারী শ্রমিকরা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে কৃষি কাজে। আগে সাধারণত গ্রামের পুরুষরা মাঠে কাজ করত। নারীরা তখন ঘরকন্যার পাশাপাশি কৃষি কাজে পুরুষের সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো (তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের ক্ষেত্রে আলাদা চিত্র)। ইদানীং দেশের অনেক জায়গায় প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কাজে নারীরা এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর জনপদে নারী শ্রমিকরা কৃষি কাজে পুুরুষের সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্প ও কৃষি কাজে নারীর এই অংশগ্রহণে নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলছে।

দেশে মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬২ লাখ। এদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। ৬৮ শতাংশ নারী কৃষি, পোল্ট্রি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কৃষি কাজে বীজ বপণ থেকে শুরু করে সার দেয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, এমনকি ফসল কাটায় নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। অনেকে আবার বাড়ির পাশে কিংবা উঠানে অনাবাদি জায়গায় শাক-সবজি, ফল-ফলাদির আবাদ করে সংসারে বাড়তি রোজগারের একটা পথ করে নিচ্ছে। এতে পরিবারের ভরণপোষণের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও তারা অনবদ্য ভূমিকা রাখছে। দেশের পূর্বাঞ্চলে চা-শিল্পের মতো সমৃদ্ধ খাতের পিছনেও পাহাড়ি নারী চা শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন থেকে শুরু করে আজকে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান রয়েছে। 

২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতে নিয়োজিত পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ বেশি। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। এ সময়ে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য খাত, পশু, হাঁস-মুরগি পালন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১১৬ শতাংশ। 

প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের কোন হিসেব নেই। এমনকি কৃষি কাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও করা হয় না।  মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়।
ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব নারীর অবদানের স্বীকৃতি আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষিতে নারী শ্রমিক বা কিষানীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামীণ নারীর শ্রম নির্ঘণ্ট শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষ যারা কাজ করছে এবং কাজ করছে না কিন্তু কাজ খুঁজছে- এমন জনগোষ্ঠীর অংশকেই শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী গত এক দশকে ১ কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান। কৃষিতে নতুন কর্মসংস্থান নতুন কাজের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেও এ খাতের গতিশীলতা, ন্যায্য মজুরি অথবা কৃষিশ্রমিকের বাজারে প্রবেশগম্যতা কিছুতেই নিশ্চিত করে না। শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের কৃষকদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতথ্য থাকলেও কিষাণীদের কোনো সংখ্যাতথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে নেই। নারী কৃষিশ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষক হিসেবে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিও শ্লথ হয়ে পড়বে। কর্মজীবী নারী সংগঠনের নেতারা কৃষিশ্রম আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে একটি শ্রম কমিশন গঠন করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে। কৃষকের অধিকার আদায়ে কৃষি শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা ও সেই সঙ্গে একটি কৃষি কমিশনও গঠন করতে হবে। তারা বলেন, কৃষি খাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টিতে, অথচ কৃষি কাজে নারীর স্বীকৃতি নেই। আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষিব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষিশ্রমিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব। তারা নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সরকারি কৃষি কর্মকান্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিক তথা কিষাণীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন।

কৃষিতে নারী শ্রমিকদের অধিকার জাতীয় জীবনে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কতগুলো আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে। এতে মানুষ ও নাগরিক হিসেবে নারীর সমান অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালে ঘোষিত নারীর প্রতি বিরাজমান সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের দলিল যা সংক্ষেপে সিডও সনদ নামে পরিচিত। ১৯৯৮ সালে কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল 'অন্ন জোগায় নারী' এ স্লোগানটি। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে নারী উন্নয়নের সামগ্রিক রূপরেখা হিসেবে  ‘বেইজিং ঘোষণা ও প্লাটফরম ফর অ্যাকশন’ গৃহীত হয়। নারী উন্নয়নের বৈশ্বিক নির্দেশিকা হিসেবে এ প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের আলোকে নিজ নিজ দেশে নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ এবং সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সব পরিমন্ডলে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাধাগুলো দূর করা। সেই সঙ্গে গৃহ, কর্মক্ষেত্র ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব পরিসরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং দায়দায়িত্ব সমবণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠিত করা। এরই আলোকে ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে।

দেশে প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে বৈষম্য থেকে এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর কাজের সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি আবশ্যক। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবে। এছাড়াও পোল্ট্রি খাতে নারী শ্রমিকের সংযোজন এ খাতকে আরো গতিশীল করে তুলবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিও দেখতে হবে। 

Thursday, May 15, 2014

হবিগঞ্জের বাগুনীপাড়া গ্রামের কৃষক আ. কাইয়ুম সাথী ফসলে কোটিপতি

হবিগঞ্জ: রোদ-বৃষ্টির সাথে মিলেমিশে কঠোর পরিশ্রমই হলো কৃষিকর্ম। যারা আরামপ্রিয় তারা এ কাজকর্ম এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু এই কষ্টের ভেতরেও যে আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে তা অনেকেই জানেন না। যারা এই কষ্টকে ধারণ করতে পারেন তারা কখনো ব্যর্থ হন না। সফলতা তাদের কাছে ধরা দেবেই। এর উদাহরণ হবিগঞ্জ সদর

উপজেলার বাগুনীপাড়া গ্রামের কৃষক আ. কাইয়ুম। কঠোর পরিশ্রম আর সাধনার বিনিময়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন কৃষি খামার। সেখানে সাথী ফসলের আবাদ করে পেয়েছেন আশাতীত সাফল্য। হয়েছেন শুন্য থেকে কোটিপতি। এলাকায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার এই সফলতায় কৃষি বিপ্লব ঘটেছে বাগুনিপাড়া গ্রামে।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বাগুনীপাড়া গ্রামের মো. আ. কাইয়ুম একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেছেন মাত্র ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। পৈত্রিক জমিজমা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ২ বিঘা জমিই ছিল তার সম্বল। জীবনের প্রথম দিকে সনাতন আবাদে এই জমিগুলো থেকে তেমন একটা লাভবান হতে পারতেন না তিনি। এক সময় জমিগুলোতে লাভের জন্য আখ চাষও করেছেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। তবে ১৯৯০ সালে তার ৫ শতক জমিতে বারির রুমা প্রজাতির টমেটো আবাদ করে আশাতীত সাফল্য পান। পেয়ে যান নতুন পথের সন্ধান। সেই সময়ে ৫শতক জমির টমেটো বিক্রি থেকে তার নীট লাভ হয় ৫ হাজার টাকা। 
এই মুনাফা দেখে কৃষক আ. কাইয়ুম কুষি বিভাগের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে শুরু করেন সবজি আবাদ। তবে সনাতন পদ্ধতিতে নয়। উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগাম সবজি আবাদে মনোযোগ দেন তিনি। একই জমিতে অধিক ফলন ও সারা বছর ফসল পেতে তিনি শুরু করেন সাথী ফষলের আবাদ। 

জমিতে টেংরাবাশ ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় মাচা। পৌষ ও মাঘ মাসে আবাদ করা হয় টমেটো। ফাল্গুন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত ফসল পাওয়া যায়। চৈত্র মাসে সেখানে লাগানো হয় বরবটি। এই ফসল পাওয়া যায় বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত। আর আষাঢ় মাসে লাগানো হয় করলা। সেখান থেকেও দীর্ঘদিন ফসল পাওয়া যায়। পাশাপাশি একই মাচায় অন্যান্য সবজি আবাদ করা হয়। 
কৃষক আ. কাইয়ুম এ বছর টমেটো বিক্রি থেকে নীট আয় করেছেন ৮ লাখ টাকা। করলা থেকে আয় এসেছে ১ লাখ টাকা। বরবটি থেকে আয় আসবে ১ লাখ টাকা। বেগুন, সীম, লাউ ও চাউল কুমড়াসহ অন্যান্য ফসল থেকে আয় আসবে আরও ২ লাখ টাকা। তার খামারে প্রতিদিন কাজ করে ১২ জন শ্রমিক। তাদেরকে দেয়া হয় দৈনিক ৩শ' টাকা। যা অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশী মজুরি। খামারে তিনি জৈবিক সার বেশী ব্যবহার করেন। পোকা মাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচাতে ব্যবহার করেন সেক্স ফেরোমন। 
কৃষক আ. কাইয়ুম জানান, এক সময় কৃষি কাজ করতে তাকে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন আর ঋণের প্রয়োজন নেই । কষ্ট করলে যে সফলতা আসবে সেই বিশ্বাস আমার ছিল। এখন অনেক লোক আমার কাছে আসে পরামর্শের জন্য। আমি সবাইকে পরামর্শ দেই। আমার এখানে যারা কাজ করে তারাও নিজেদের জমিতে ভাল সবজি আবাদ করছে। 

কৃষির আয় থেকে আ. কাইয়ুম তার সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। তার ৪ সন্তানের সকলেই এসএসসি পাশ করেছে। একজন পড়ছে কলেজে। এই আয়ে তার বাড়ীতে দালান উঠেছে। পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া ২ বিঘা জমি বেড়ে হয়েছে ১২ বিঘা। এর ৮ বিঘাতে আবাদ হয় সবজি এবং ৪ বিঘাতে আবাদ হয় ধান। ক্রয় করেছেন ১টা ট্রাক্টর, ১টা পাওয়ার ট্রিলার, ১টা মাড়াই মেশিন, ২টা অগভীর নলকুপসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। তার এই সফলতায় গ্রামের প্রায় ৩শ’ কৃষক সবজির খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি নিয়মিত কৃষি বিভাগের পরামর্শ নেন এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে থাকেন। কৃষি খামার থেকে উৎপাদিত ফসল কিনতে অনেক সময় পাইকাররা ট্রাক নিয়ে আসেন আ. কাইয়ুম এর কাছে। এছাড়াও তিনি এই ফসল বিক্রি করেন, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নবীগঞ্জ ও বি-বাড়ীয়া জেলার সরাইলে। 

আ. কাইয়ুমের জমিতে শ্রমিকের কাজ করা বাবুল, মুরাদ ও ময়না মিয়া জানায়, তারা এখানে কাজ করে ভাল পারিশ্রমিক পায়। কাজ করার পাশাপাশি নিজেদের জমিতেও সবজি আবাদ করছে তারা। 

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ ও নিউটন অধিকারী জানান, কৃষক আ. কাইয়ুম যে কোন সমস্যা দেখা দিলে কিংবা পরামর্শের প্রয়োজন হলে তিনি তাদের কাছে আসেন। এ ব্যাপারে তাকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হয়। আ. কাইয়ুম প্রমাণ করেছেন পরিশ্রক আর বুদ্ধি থাকলে দেশেই ভাল কিছু করা সম্ভব। 

হবিগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিমল চন্দ্র সোম জানান, একজন কৃষক যদি বাড়িতে থেকেই বছরে ১২ লাখ টাকা মুনাফা করতে পারে সেটি কম কথা নয়। আ. কাইয়ুম পরিশ্রম আর সাধনা করে এই পর্যায়ে এসেছেন। তাকে যদি সবাই অনুসরণ করে তাহলে দেশে বেকারত্ব হ্্রাস পাওয়ার পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

Saturday, May 10, 2014

কুমিল্লায় ঘরে ঘরে ‘সাদা সোনা’

কুমিল্লা: ভোর বেলায় চাষীরা ঘুম থেকে জেগে দেখেন ঘরের বারান্দায় এমন কি খুপরী ঘরেও সাদা ফুল ফুটে আছে। তারা ফুল ছিড়ে বিক্রি করেন। এতে নগদ টাকা আসে। এই হলো মাশরুম। মাশরুমকে কেউ বলেন ‘সাদা ফুল’, কেউ বলেন ‘সাদা সোনা’।

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার খাড়াতাইয়া মাশরুম পল্লীর চাষী সাহেরা বেগম। ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করেছেন। স্বামী মোঃ জসিম (অব. সেনা সদস্য)। স্বামী অবসরের পর পরিবারের আর কোন আয়ের পথ না থাকায় ৩ সন্তানের লেখাপড়ার খরচসহ পরিবারের অন্যান্য খরচ চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তার পর ২০০৮ সালে কুমিল্লা মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র হতে ৩ দিনের মাশরুম চাষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তার পর তাকে সরকারিভাবে ২৫টি মাশরুমের স্পন প্যাকেট সরবরাহ করা হয়। ঐ বছর তিনি ২৫টি স্পন থেকে প্রায় ১০০টি খড়ের প্যাকেট তৈরী করেন। একই বছর তার আয় হয় ছয় হাজার  টাকা, যা দিয়ে তিনি পরবর্তী বছরের জন্য একটি ছোট মাশরুম চাষ ঘর ও খড় কিনে রাখেন। বর্তমানে তার মাসিক আয় প্রায় বিশ হাজার টাকা।

বর্তমানে খাড়াতাইয়া ও গাজীপুর মাশরুম পল্লীতে ৬০ জন মাশরুম চাষী আছেন। উক্ত পল্লী থেকে দৈনিক গড়ে ৮০-১০০ কেজি মাশরুম উৎপাদন হয়। যা প্রতি দিন বিভিন্ন ভোক্তা এসে কিনে নিয়ে যান। তাছাড়া কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন কাঁচা বাজারে, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্রতি কেজি মাশরুম ১৩০-১৫০ টাকায় পাইকারী দামে বিক্রি হয়। মাশরুম বাজারজাতকরণের জন্য মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র, কুমিল্লা সার্বিক সহযোগিতা করে আসছেন। মাশরুম চাষীরা জানান যে, সংসারের কাজ শেষে তারা আগে অলস সময় কাটাতেন। বর্তমানে তারা অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে বেশ ভাল আয় করছেন। বর্তমানে উক্ত পল্লীতে গৃহবধূ, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, স্কুল, কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরা সখের বসে মাশরুম চাষ করলেও তা এখন অনেকের আয়ের উৎস। এই মাশরুমকে কৃষিবিদরা সাদা সোনা হিসেবে অবহিত করে থাকেন।

উদ্যানতত্ত্ববিদ ড. মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান যে, মাশরুমে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল ও অল্প পরিমাণ শর্করা। মাশরুমের সবজি, ভর্তা, স্যুপসহ নানান মজাদার খাবার তৈরী করা যায়।
মাশরুম ডায়াবেটিক, হৃদরোগ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, ও মরণ ব্যাধি ক্যান্সার রোগ ছাড়াও আরো অনেক রোগ প্রতিরোধ হিসাবে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

উল্লেখ্য, ২০০৭-২০০৮ অর্থ বছর থেকে এ পর্যন্ত বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র, কুমিল্লার উদ্যোগে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ৩০৫০ জন মাশরুম কেন্দ্রের প্রশিক্ষকরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমবায় প্রতিষ্ঠানে আরো প্রায় ৫০০০ জন আগ্রহী নারী পুরুষকে মাশরুম চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। বর্তমানে জেলার বুড়িচং, চান্দিনা ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ৪টি মাশরুম পল্লী রয়েছে। এসব মাশরুম পল্লীতে রয়েছে প্রায় ১৫০ জন মাশরুম চাষী। দিন দিন চাষী সংখ্যা বেড়েই চলছে।

খাড়াতাইয়া মাশরুম পল্লীর মনোয়ারা বেগম, পারভীন আক্তার, ইতি বেগম জানান, সরকারিভাবে মাশরুমের বহুবিধ গুণাগুণ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বেশি করে প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

কুমিল্লা মাশরুম উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ উপকেন্দ্রের সহকারী মাশরুম উন্নয়ন কর্মকর্তা জনাব মোঃ গোলাম সারওয়ার ভূইঁয়া জানান, ছোট আকারে মাশরুম চাষ করলে অনায়াসে প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

তিনি আরো জানান, পারিবারিকভাবে মাশরুম চাষ করে অনায়াসে পরিবারের আমিষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। তাছাড়া আমাদের দেশে জমি কমছে কিন্ত জনসংখ্যা বাড়ছে। এই বিশাল জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণে মাশরুমের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য মাশরুম চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

Thursday, May 8, 2014

দিনাজপুরে লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

দিনাজপুর: রসালো ও সুস্বাদু লিচু মানেই দিনাজপুরের লিচু। তাই দিনাজপুর লিচুর জেলা হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত। আর এই জেলার ১৩টি উপজেলাতেই লিচু চাষ বেড়ে চলছে। প্রতি বছর বাড়ছে লিচু চাষের জমির পরিমাণ। উৎপাদনের জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকায় এবার মধুমাসের ফল লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রতিটি লিচু গাছে থোকা থোকা লিচু শোভা পাচ্ছে। আর ক’দিন পরই লিচু পাকতে শুরু করবে।

দিনাজপুর হর্টিকালচার বিভাগের উপ-পরিচালক মোকলেসুর রহমান জানান, প্রতিবছর এই জেলার উৎপাদিত লিচু দেশের বিভিন্ন জেলা ও তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরবরাহ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়া ও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় এবার জেলায় লিচুর বাম্পার ফলন হবে। এখন পর্যন্ত জেলার লিচু বাগানে ও বসত বাড়ীতে লাগানো গাছে লিচুর ফলন ভালো দেখা যাচ্ছে। ভালো ফলনের আশায় লিচু চাষীরা পুরোদমে পরিচর্যা চালায়। চাষীদের সহযোগিতা করতে কৃষি অধিদপ্তর এবং হর্টিকালচার বিভাগ থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আনোয়ারুল আলম জানান, গত ২০০৯ সালে জেলায় লিচু চাষের জমির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫শ’ হেক্টর। ২০১০ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৮০ হেক্টরে। ২০১১ সালে ১ হাজার ৯৫৬ হেক্টর এবং ২০১২ সালে ২ হাজার ৫শ’ হেক্টর এবং ২০১৩ সালে ২ হাজার ৭শ’  হেক্টর লিচু চাষ হয়। চলতি বছর ২০১৪ সালে লিচু চাষের জন্য জমির পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ২শ’ হেক্টরে বেড়ে গেছে। চলতি বছরে দিনাজপুর জেলায় ৩ হাজার ২শ’ হেক্টর জমিতে লিচু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিনাজপুরের লিচু সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় দেশব্যাপী এর চাহিদা বেশী।

দিনাজপুরের লিচুর মধ্যে চায়না থ্রী, চায়না ফোর, বেদেনা, বোম্বাই ও মাদ্রাজি উল্লেখযোগ্য। আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে এবার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জেলার সদর উপজেলার আউলিয়াপুর, মাসিমপুর, পুলহাট, সিকদারগঞ্জ, মহব্বতপুর, উলিপুর, খানপুর এলাকায় ঐতিহ্যবাহী বেদেনা লিচু চাষ উল্লেখযোগ্য। এই এলাকার মাটির কারণেই উৎপাদিত বেদেনা লিচু সুস্বাদু এবং উন্নত মানের হয়ে থাকে। অন্য এলাকার বেদেনা লিচুর চেয়ে এই এলাকার বেদেনা লিচু গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয়। হাইব্রিড জাতের লিচু চায়না টু, চায়না থ্রি, চায়না ফোর সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, বিরল, বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ীসহ জেলার ১৩টি উপজেলাতেই ব্যাপকহারে বাগান গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা অনেক  লিচুর বাগান আগাম ক্রয় করে নিয়েছে।

দিনাজপুর সদর উপজেলার উলিপুর গ্রামের আদর্শ লিচু চাষী রমজান আলী (৫০) জানান, লিচুর ফুল আসার সাথে সাথে পরিচর্যা শুরু করতে হয়। নিয়মিত স্প্রে ও সেচ দিতে হয়। রমজান আলীর ৩ একর জমি দুটি লিচু বাগান রয়েছে। ২৯৫টি লিচু গাছের মধ্যে ৮২টি রয়েছে বেদেনা লিচুর গাছ এবং দেশি ও হাইব্রিড জাতের চায়না থ্রির গাছ রয়েছে ২১৩টি।

এ দুটি বাগান তিনি ১ বছরের জন্য ব্যবসায়ীর কাছে সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। বাগানের বয়স প্রায় ১২ থেকে ১৬ বছর হবে। যত দিন যাবে লিচুর গাছে ফল বেশি ধরবে এবং দামও বাড়তে শুরু করবে। এ ছাড়াও তার বাড়ীতে ৪টি লিচুর গাছ রয়েছে এর মধ্যে একটি বেদেনা ও দুটি মাদ্রাজি ও একটি বোম্বে লিচু। এ ৪টি গাছের লিচু তার পরিবারের খাওয়া আত্মীয়-স্বজনকে দেয়া  ছাড়াও বিক্রি করা হয়।

বিরল উপজেলার মাধববাটী গ্রামের লিচু বাগানের মালিক রামকৃষ্ণ রায় জানান, এবার আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় বাম্পার লিচুর ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার দেড় একর জমিতে চায়না থ্রি লিচু বাগান রয়েছে। তার বাগানে ১৫২টি গাছ রয়েছে। চলতি বছর কিশোরগঞ্জ জেলার ব্যবসায়ী ফজল হক এক বছরের জন্য ২ লাখ টাকায় বাগানটি ক্রয় করেছে। বাগানের লিচুর গাছের বয়স ১৫ বছর চলছে।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সাফায়েত হোসেন জানান, লিচু চাষে ব্যঘাত না হওয়ার লক্ষ্যে কৃষি কর্মকর্তারা চাষীদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়েছে। এর ফলে উৎপাদন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

Sunday, May 4, 2014

বরগুনার আমতলীতে স্বাবলম্বী হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার

বরগুনা: বরগুনার আমতলী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহ আলম প্রায়শই অভিযোগ করেন, গ্রাম কিংবা শহরের স্থানীয় মানুষগুলোর কাছে গেলে তাদের প্রথম তারা জিজ্ঞাসা করতো, আপনারা ‘কী দেবেন?’ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর-আইলার পর উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের মধ্যে এক ধরনের ত্রাণ নির্ভরশীলতা তৈরী হয়েছিল। ক্রমে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। সেসময়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন, অপরিকল্পিত ও অপরিমিত ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ স্থানীয় মানুষের স্বভাবই পাল্টে দেয়। ফলে দুর্নামের ভাগীদার হয়েছে সাধারণ মানুষ। 

এই আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটাতে কৃষি, মৎস্য বিভাগ, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী, ভূমি দপ্তর, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারী সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ও আরপাঙ্গাশিয়া দু’টি ইউনিয়নে রিকল নামের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এনএসএস নামের একটি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা। রিকল প্রকল্পের আওতায় আসা মানুষগুলোর জীবন ও মানসিকতায় পরিবর্তনও এসেছে ব্যাপক। তারা এখন আর হাত পাতেন না। বাইরের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বসে না থেকে নিজেরাই নিজেদের সমস্যা নিরুপন করেন এবং নিজেদের সক্ষমতা দিয়েই তা সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছেন। 

রিকল প্রকল্পে উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশাখালী ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ ২৭টি সিবিও’র (কমিউনিটি বেজড অরগানাইজেশন/ উপকারভোগী সংগঠন) অন্তর্ভূক্ত হয়ে তাদের সমস্যা নিরুপন করেন ও তার সমাধানে সোস্যাল ম্যাপ তৈরী করেন। প্রতি সপ্তাহে সংগঠনের সভা ডেকে করণীয় নির্ধারণ করেন। প্রথমে তারা নিজেদের সম্পদ, সামর্থ ও সহযোগিতা দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালান। প্রয়োজনে সহায়তা নেন মূল সংস্থা এনএসএসর। সরকারী বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাসমূহের সাথে উপকারভোগী সংগঠনগুলোর (সিবিও’র) সংযোগ তৈরী করে দেয় এনএসএস। এভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহায়তার মাধ্যমে ঐ দুই ইউনিয়নের সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার এখন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ছুঁতে যাচ্ছে। 

এনএসএস’র নির্বাহী পরিচালক অ্যাড. শাহাবুদ্দিন পান্না জানান, স্থানীয় মানুষগুলোর ত্রাণ মুখোপেক্ষি মনোভাব দূর করতেই মূলত আমরা সরাসরি সহায়তা দেই না। বছরের পর বছর ত্রাণ সহায়তা দেয়া বা পাওয়া সম্ভব নয়। তাদেরকে সংকট মোকাবেলায় সক্ষম করাই আমাদের লক্ষ্য। এনএসএস ঐ জনগোষ্ঠির মধ্যে জরুরী প্রয়োজনে নলকূপ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা, হাঁস-মুরগী, গবাদিপশু, সার-বীজ অর্থসহায়তা প্রভৃতি দিয়েছে ঠিকই তবে তা কারা পাবে তা বাছাই করেছে সিবিও’র সদস্যরা। এখানে নিজে না নিয়ে যার বেশী প্রয়োজন তাকে দেয়ার একটা মানসিকতা তৈরী করতে সফলতা পাওয়া গেছে। এমনকি সিবিও’র বাইরেও মানবিক কারণে সহায়তা প্রদান করছেন সদস্যরা। 

মানুষের অধিকার নিয়েও কাজ করছে ঐ সিবিওগুলো। ইতোমধ্যে খাসজমিতে ভূমিহীনদের প্রাপ্যতা ও জলমহালের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে সামাজিক আন্দোলন করছে তারা। জানালেন, আমতলীর পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মতিয়ার রহমান। উপজেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাড. এম এ কাদের মিয়া বলেন, রিকল প্রকল্পটি প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর মানুষদের সচেতন করেছে। আন্দোলন করতে শিখিয়েছে। তারা এখন আর বসে থাকে না। পথে নামা শিখেছে। প্রয়োজনে আমাদের মতো সামাজিক-রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরও তাদের আন্দোলনে শরিক করছে। 

আমতলীর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান খান জানান, দূযোর্গপ্রবন এলাকা হিসেবে স্থানীয়রা সবসময়েই ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করেন। আমাদের মাধ্যমে সিবিও’র সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা আপদকালীন সময়ের জন্য খাদ্যভান্ডারও তৈরী করেছেন। দূযোর্গে তৎপরতামূলক মহড়া করছেন নিয়মিত। দূর্যোগে নিজেকে রক্ষাসহ অপরকে রক্ষা করার সক্ষমতাও তাদের হয়েছে। 

আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশখালী ইউনিয়নের প্রতিটি পরিবারে এনএসএস হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরী করিয়েছে এবং এ কাজে আনুসাঙ্গিক মালামাল দিয়েছে। এটি একটি ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ। এ কারণে উপজেলার ঐ দু’টি ইউনিয়নে ডায়রিয়া, আমাশয়ের মতো রোগও কমে গেছে জানালেন, আমতলীর উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. একরামুল কবির। 

স্বাবলম্বীতার জন্য নিজের সক্ষমতা প্রয়োজন। আরপাঙ্গাশিয়া ও গুলিশখালী ইউনিয়নের স্থানীয় মানুষগুলোকে এই উপলব্ধি এনে দেয়ার জন্য এনএসএস’র কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য বললেন আমতলীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ। তিনি আরও বলেন, এ কার্যক্রমে আশপাশের ইউনিয়নের লোকজনও সচেতন হচ্ছে।

মুন্সীগঞ্জের তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল পুনঃখনন না করলে অর্থনীতিতে আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে

মুন্সীগঞ্জ: বাংলাদেশের সুয়েজ খাল হিসেবে পরিচিত মুন্সীগঞ্জের তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল জৌলুসহীন হয়ে পড়ছে। নাব্যতা সঙ্কটে লঞ্চ তো দূরের কথা ছোট নৌকা চলাচলই কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও রাজবাড়িসহ বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া ও মুন্সীগঞ্জ জেলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পদ্মা ও ধলেশ্বরীর সংযোগ খালটির ¯্রােতধারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদী ভাঙ্গন প্রকট হচ্ছে। এই খালের মুখে লৌহজং উপজেলার ডহরী ও বড় মোকাম এলাকায় আসন্ন বর্ষায় নদী ভাঙ্গন ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। 

খালটি অচল থাকার কারণে কৃষি জমির সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত, বর্ষার পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় দু’পাশের গ্রাম ও কয়েক হাজার একর কৃষি জমি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির বিভিন্ন অংশ বেদখল হওয়াতে এর আকার ছোট হয়ে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ খালের এই নাজুক অবস্থার কারণে পরিবেশে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এতে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন জানান, খালটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ড্রেজিং জরুরি হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিং না হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ¯্রােতধারা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এ খাল এখন দেখ-ভাল করছে বিএডিসি। 

বিএডিসির সহাকারী প্রকৌশলী (সেচ) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘খালটির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কেউ আমাদের কাছে আবেদন-নিবেদন করেনি। তাই এ ব্যাপারে আমরা কিছুই করতে পারছি না। তাছাড়া খালটি বিএডিসির আওতায় কি-না তাও আমি নিশ্চিত নই। কারণ ৩০ ফুটের বেশি প্রশ্বস্ত খাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায়। 

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, ‘তালতলা-গৌরগঞ্জ খাল এবং এর সাথে যুক্ত ইছামতি নদীর গুরুত্ব উল্লেখ করে এর যৌবন ফিরিয়ে আনতে সরকারকে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ  নেয়া হবে।’

টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বালিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘একদা বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের মালবাহী নৌকা ও অন্যান্য নৌযান অতি সহজে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করতো এই খাল দিয়ে। এগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। বেশ কয়েক বছর ধরে এই খালে লঞ্চ বা বড় নৌকা চলাচল করতে পারছে না।  নাব্যতার অভাবে ছোট নৌকাও আটকে থাকে। 

¯্রােত না থাকায় জমিগুলোতে যথাযথ পলি আসছে না। তাই আমরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। অন্তত কৃষকের জন্য খালটি ড্রেজিং করা জরুরি।’ খালপাড়ের অন্য বাসিন্দারা জানান, ‘এই খালের ¯্রােতধারা বন্ধ হওয়ার কারণেই ধলেশ্বরী-ইছামতিও মরে যাচ্ছে। খাল মরে যাওয়ায় তালতলা থেকে বেতকা হয়ে আবদুল্লাহপুর থেকে মিরকাদিম বন্দর পর্যন্ত খর¯্রােতা ইছামতিও মরে গেছে। ১২ মাস এই নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করতো। এখন সেই লঞ্চঘাট শুকনো স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।’

এই খালের তীরে ৬টি হিমাগার স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু খালের করুণ দশায় বিপাকে পড়েছে এসব হিমাগার। এই ৬টি হিমাগার ছাড়াও ইছামতি তীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন হিমাগার ও বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানই বিপাকে পড়েছে। এই খাল ও ইছামতি নদী ঘিরে গড়ে উঠা দেশের সর্ববৃহত আলু এবং কাঁচামালের  আরত, বেতকা হাট, আবদুল্লাপুর বাজার, তালতলা বাজার, মিরকাদিম বন্দর, সুবচনী বাজার, বালিগাঁও বাজার, ডহরী বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

খালটির তীরে গড়ে উঠা ধলেশ্বরী হিমাগারের পরিচালক অভিজিৎ দাস ববি বলেন, ‘খালে পানি না থাায় আলু মৌসুমে কৃষক পানি দিতে পারে না। এই খালের দু’পাশের বিস্তীর্ণ জমিতে হাজার হাজার টন আলু ও বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু নৌ-যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় তা বাজারজাত ও প্রক্রিয়াজাত করতে কৃষকরা নানা বিড়ম্বনায় পড়ছেন। সাথে ক্ষতির মুখে পড়ছি হিমাগার মালিকরাও।’

নদী তীরের অনেক হাট-বাজার থেকে পণ্য রাজধানী ঢাকায় যেত এই খাল ধরে। একইভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য সহজে এসব অঞ্চলে পৌঁছতে এই খাল ব্যবহার করে। খালটি চলাচল অযোগ্য হওয়ায় প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার নদীপথ ঘুরে মোহনপুর, ষাটনল, জগারিয়া পাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীতে আসতে হচ্ছে। এতে গরু-ছাগল, উৎপাদিত কৃষি পণ্য বাজারজাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়সহ ঝুকি বেড়েছে। 

এ ছাড়াও এই খালের প্রবাহ পদ্মার সঙ্গে বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৩ সাল থেকে লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী থানার নদীভাঙন প্রবল হয়েছে। আগে এই খাল দিয়ে ধলেশ্বরী থেকে ধেয়ে আসা পানির স্রোত উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে নেমে পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা পদ্মার স্রোতকে আঘাত হানতো। ফলে পদ্মার স্রোত কিছুটা দুর্বল হয়ে মাঝ নদী দিয়ে মেঘনায় গিয়ে পড়তো। এখন শ্রীনগর-লৌহজং খালের প্রবাহ বন্ধ থাকায় আরিচা থেকে ধেয়ে আসা যমুনা ও গঙ্গার প্রবল স্রোতধারা পদ্মা দিয়ে সজোরে লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার মাটিতে আঘাত হানছে। ফলে নদীভাঙন প্রবল হয়েছে। ফলে গত দেড় দশকে শ্রীনগর-লৌহজং, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার অনেক গ্রাম ও ইউনিয়ন পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়েছে। বহু লোক ভূমিহীন, গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। 
এই খালের প্রবাহ পদ্মার মুখে যখন বালি-পলি জমে বন্ধ হতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই তা কেটে দিলে এত বড় সর্বনাশ হতো না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানি আরিফুর রহমান। 

মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ জানান, এই খালের ¯্রােতধারা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার এই খাল রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তারা আশা করেন। 

Wednesday, April 30, 2014

বরগুনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৌরশক্তির ব্যবহার বেড়েছে

বরগুনা: লোডশেডিংয়ের ঝামেলা নেই। কর্মীদের খবর দিলেই বাড়িতে লাগিয়ে (স্থাপন) দিয়ে যায়। খরচও তুলনামূলক অনেক কম। বরগুনার বিভিন্ন গ্রাম ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকাগুলোর স্থানীয় লোকজন ব্যাপক হারে সৌরশক্তি ব্যবহার করে আলোর চাহিদা মেটাচ্ছেন। শুধু গ্রামই নয়, জেলার ৬টি উপজেলা শহরে বিদ্যুতের পাশাপাশি মানুষের বাসা-বাড়ি কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সৌরশক্তির ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো। কৃষি জমিতে সৌর সেচ পদ্ধতি চালু হয়েছে তিন বছর আগেই। এখন সড়কবাতি জ্বালানোর কাজেও সৌরশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

সৌরশক্তি ব্যবহারকারীরা জানান, রাতে বাতি জ্বালানোসহ বৈদ্যুতিক পাখা  (ছোট ডিসি ফ্যান) ও টেলিভিশন চালানোর মতো সুবিধা পাওয়ায় সৌরশক্তি এ অঞ্চলে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাছাড়া যেসব এলাকায় বিদ্যুত পৌঁছাতে এখনও সময়ের দরকার সেই এলাকাগুলোতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবাই সৌর শক্তি ব্যবহার করা শুরু করেছেন। শহরাঞ্চলে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলাকালীন আলোর চাহিদা মেটাতেও সৌরশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাপক হারে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী দপ্তরগুলোর মতো জরুরী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুতের পাশাপাশি সৌরশক্তির ব্যবহার বেশ পুরাতন। এ অঞ্চলে বিদ্যুত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান খোদ পল্লী বিদ্যুতের অফিসগুলোতেও সৌরশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। জেলার ফেরীঘাটগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সৌরশক্তির সড়কবাতি অন্ধকার দূর করছে। সৌরশক্তির ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন পপকর্ন বিক্রেতারা। পপকর্ন বিক্রয় ভ্যানে সৌরপ্যানেল ও ব্যাটারির সাহায্যে মোটর চালনা করা হচ্ছে।  

সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে বরগুনার কৃষকরা চাষ করছেন শত শত একর জমি। সূর্যালোকের সাহায্যে ফসলী জমিতে এই সেচ ব্যবস্থা কৃষকদের জ্বালানী তেল বা বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীলতার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ২০১০ সাল থেকে বরগুনায় ৬ টি গ্রামে ৬টি সোলার ইরিগেশন পাম্পিং সিস্টেম ৪০ একর করে জমিতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি সরবরাহ করে যাচ্ছে। 

ছোট-বড় প্রায় ২৫টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে জেলার গ্রাহকদের সৌরশক্তি ব্যবস্থার চাহিদা পূরণ করছে। ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকজন বিপণন কর্মকর্তা আলাপকালে জানান, ১২ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে চাহিদা ও বিদ্যুত ক্ষমতা অনুযায়ী সৌর শক্তি ব্যবস্থা স্থাপন (ইনস্টল) করেন তারা। মোট দামের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা এককালীন পরিশোধ করে বাকি টাকা ৩০ থেকে ৪০ কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ থাকায় সৌর শক্তি ব্যবস্থা গ্রাহকদের কাছে বেশ সুবিধাজনক ও ব্যবহারযোগ্য হয়েছে। তারা আরও জানান, ইতোমধ্যে বরগুনা জেলায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ সৌরশক্তি ব্যবহার করছেন।

প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর পাশাপাশি জেলার উপকূলীয় ২টি উপজেলা তালতলী ও পাথরঘাটার সাগরতীরবর্তী মানুষেরা সৌর শক্তিতে বেশী উপকৃত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এনএসএস’র নির্বাহী পরিচালক অ্যাড. শাহাবুদ্দিন পান্না। তিনি বলেন, সৌরশক্তির বিদ্যুত ব্যবহার করে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা অনেক বেড়েছে। তারা দেশ-বিদেশের সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ওয়াকিবহাল হচ্ছেন।

আমতলী ডিগ্রি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান, সহকারী অধ্যাপক উত্তম কুমার কর্মকার বলেন, সৌরশক্তির ব্যবহার বিদুতের বাড়তি চাহিদা থেকে আমাদের মুক্তি দিচ্ছে। উপযোগিতা থাকায় উপকূলীয় এলাকায় (উইন্ডমিল) বায়ূ শক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেটি সৌরশক্তির চেয়েও কম ব্যয়ের হবে। 

প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দ্রুত উপকূলীয় এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করছে। এখন সাগরপাড়ের মানুষও রাতে (সৌর) বিদ্যুতের আলোয় কাজ করছে। বিনোদন ও শিক্ষার জন্য টেলিভিশন দেখছে। দেশের প্রতিটি এলাকায় ডিজিটাল সুবিধা পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, জানালেন, বরগুনা-১ আসনের সাংসদ অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। 

Tuesday, April 29, 2014

ছাগল পালনে অর্থনৈতিক দুর্দশা ঘুচিয়েছে নাজমুন্নাহার

জয়পুরহাট: জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল ঊপজেলার গুরুরা গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত নাজমুন্নাহার  ছাগল পালন করে স¦াবলম্বী হয়েছে। সংসারে খরচের জন্য তাকে আর পেছনে তাকাতে হয় না।

নাজমুন্নাহার জানান, স্বামী শহিদুল ইসলামের রাজমিস্ত্রির কাজের রোজগারে এক ছেলে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন চলতো। আর্থিক অনটন থাকলেও স্বাবলম্বী হওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল তার। এই আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে নাজমুন্নাহার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এ্যাহেড সোশ্যাল অর্গানাইজেশন (এসো)র সদস্য হয় এবং ২০০৮ সালে ছাগল পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নেয়। এরপর সেখান থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করে।  এ থেকে ২ হাজার টাকায় একটি ছাগী কিনে শুরু করে ছাগল পালন। বর্তমানে নাজমুন্নাহারের খামারে ১২টি উন্নত যমুনা পাড়ী জাতের ছাগল রয়েছেÑ যার একেকটির মূল্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
ছাগল পালন প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ছাগল পালনের পাশাপাশি বসতবাড়ীর পাশে শাক-সবজি চাষ ও  হাঁস-মুরগি পালন করে সে। ছাগল বিক্রির টাকায় ছেলের লেখাপড়া ও সংসারের খরচের পাশাপাশি কিস্তি দিতে সমস্যা হয় না নাজমুন্নাহারের।
পাঁচ বছর আগে ৫ হাজার টাকা নিয়ে শুরু হওয়া ঋণের পরিমাণ এখন ১৫ হাজার টাকা। নাজমুন্নাহার  এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার ছাগল বিক্রি করেছে এবং জমি কেনার পাশাপাশি প্রতি বছর ২ থেকে ৩ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ধান, আলুসহ অন্যান্য ফসল চাষে স্বামীকে সহযোগিতা করছে। এ রকম আয়-বর্ধনমূলক  নানা কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে নাজমুন্নাহার। তাকে দেখে ওই এলাকার  অসহায়, দুস্থ ও বেকার মহিলারা তাকে অনুসরণ করে দারিদ্র্য বিমোচন করছে। যেমন, ওই এলাকার অসহায় দুস্থ মহিলা শাহিনা, বিলকিস, স্বপ্নাসহ আরো অনেকে  ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে  ছাগল পালন, বসত বাড়ীর আশেপাশে শাক-সবজি চাষÑ আবার কেউবা হাঁস-মুরগি পালন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
ক্ষেতলাল উপজেলার গুরুরা গ্রামে গিয়ে দুস্থ মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘এসো’ থেকে ঋণ নিয়ে ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন করে বদলে ফেলেছে তাদের সংসারের ভাগ্যের চাকা। বর্তমানে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। অথচ  কয়েক বছর আগেও তাদের চোখে-মুখে ছিল বিষাদের ছাপ। সংসারের অস্বচ্ছলতার কারণে অনেকেই ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে পারেনি। নেমে পড়তে হয়েছে জীবিকার সন্ধানে। স্বল্প বয়সেই জীবন সংগ্রামের কঠিন তাগিদে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে হয়েছে।
সমাজে  সব মহিলারাই স্বপ্ন দেখে সৎ উপার্জনে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বড় হওয়ার। আর এই বড় হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে খোঁজ মেলে ছাগল পালন ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির। 
এসো’র নির্বাহী পরিচালক মতিনুর রহমান বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছাগল পালন কর্মসূচির সদস্য হয়ে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন করে পুরুষের পাশাপাশি  অসহায় নারীরাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারছে।

Sunday, April 27, 2014

আমজাদ খানের ব্যতিক্রমী তরমুজ চাষ

হবিগঞ্জ: বাইরে সবুজ আর ভিতরে লাল টকটকে এবং  রসে টুই টুম্বুর যে ফলটি আমাদের কাছে পরিচিত তার নাম ‘তরমুজ’। গরমকালে সুমিষ্ট এই ফলের ব্যাপক চাহিদা। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি এই ফলের রয়েছে ঔষধীগুণ। কিন্তু প্রচলিত এই তরমুজের বাইরে রং-বেরঙের আর সুস্বাদু তরমুজ চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন হবিগঞ্জের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক আমজাদ হোসেন খান। 

বাংলাদেশের সব স্থানে কমবেশি তরমুজ চাষ হয়। তবে এ বছর হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার হরিনখোলা গ্রামের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক আমজাদ খান প্রচলিত তরমুজের বাইরে ‘মধুবালা তরমুজ’ নামে হলুদ রঙের এক ধরনের তরমুজ চাষ করে তাক লাগিয়েছেন সবাইকে। এই তরমুজের লাভ থেকে তার ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়েছে। তার দাবি এই ‘মধুবালা তরমুজ’ তিনিই প্রথম বাংলাদেশে চাষ করেছেন।

কৃষক আমজাদ হোসেন খান শুধু মধুবালাই নয়, তার খামার চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন রঙের তরমুজ। এগুলো হল- জেসমিন, সুপার সাইন বয়, টারজন, ফেয়ারী, ১৭০৪ ও সুপার ড্রাগন প্রজাতির তরমুজ । সুপার ড্রাগনের বাইরে নীল এবং ভিতরে হলুদ। হলুদ রংঙের তরমুজ মধুবালা যেমন সুস্বাদু তেমনি আকর্ষণীয়। অল্প টাকা খরচ করে তিনগুণ লাভ হওয়ায় হলুদ তরমুজ চাষ করতে আগ্রহী হয়ে এলাকায় কৃষকরা তার কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন। 
আর কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, হলুদ তরমুজ লাভজনকের পাশাপাশি বাজারে এর চাহিদা বেশি। আমজাদ হোসেন খান এ বছর তিনি ৩ একর জমিতে আবাদ করেন ব্যতিক্রমধর্মী তাইওয়ান থেকে আগত হলুদ তরমুজ মধুবালা। এতে তার ব্যাপক ফলন হয়। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং বিক্রি হয়েছে ৮ লাখ টাকার বেশী। মধুবালা তরমুজ ক্ষেত থেকে তুলে আনার পর ওজন অনুযায়ী গ্রেডিং করা হয়। পরে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় বাজারে এবং ঢাকার কাকরাইলে। এই তরমুজ ৪০ থেকে ১শ’ টাকায় বিক্রি হয়।

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার সদরের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন খান প্রায় তিন বছর পূর্বে শুরু করেন তরমুজ চাষ। প্রথমদিকে তরমুজের ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় তিনি বৃহৎ পরিসরে চাষ করার চিন্তা করেন। এর ধারাবাহিকতায় এ বছর ব্যতিক্রমধর্মী তাইওয়ান থেকে আনা হলুদ মধুবালাসহ ব্যতিক্রমধর্মী প্রজাতির তরমুজ আবাদ শুরু করেন।

কৃষক আমজাদ হোসেন খান এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বর্ষা মৌসুমে বিশেষ পলিথিনের মাধ্যমে হলুদ তরমুজ চাষ করার জন্য। ইতোমধ্যে চারা প্রস্তুত হয়েছে। রমজান মাসে যাতে ফলন আসে সেই লক্ষে তিনি ১০ একর জমিতে ফলাবেন এই তরমুজ। আগামী মৌসুমে তরমজু চাষ করবেন ২০ একর ভুমিতে।

নিজের তেমন জমি না থাকায় তিনি হরিনখোলা গ্রামে ৩০ একর জমি লীজ নিয়ে তোলেন কৃষি খামার। তার তরমুজ বাগানে এলাকার  ৩০ থেকে ১শ’ জন শ্রমিক কাজ করছেন। শ্রমিকরা জানিয়েছেন তরমুজ বাগানে কাজ করে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালভাবে জীবন-যাপন করছেন। 

আমজাদে হোসেন খানের দেখাদেখি হরিনখোলাসহ চৌমুহনী ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকায় শুরু হয়েছে তরমুজ আবাদ। বর্তমানে ঐ এলাকার  দেড় হাজার কৃষক এই তরমুজ চাষে জড়িত। যেখানে হবিগঞ্জ জেলায় তরমুজ আবাদ হয় ৩শ’ হেক্টর জমিতে, সেখানে চৌমুহনী ইউনিয়নেই আবাদ হয় ১৮০ হেক্টর জমি। 

কৃষক আমজাদ হোসেন তরমুজের পাশাপাশি টমেটো আবাদেও সফলতা অর্জন করেছেন। এ বছর তিনি ১ লাখ কেজি টমেটো সিঙ্গাপুরে রফতানি করেছেন। গত বছর পেয়েছিলেন ৪০ হাজার কেজি। আগামীতে তরমুজ রফতানিরও ইচ্ছা রয়েছে তার। গত বছর টমেটো আবাদ করে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক রৌপ্য পদক। পরে তাকে অনেক প্রতিষ্ঠান দেয় সম্মাননা। এ বছর তার টার্গেট রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক। সেটি তিনি অর্জন করতে চান তরমুজ চাষের সফলতা দিয়েই।

আমজাদ খান জানান, কৃষি খামারে তিনি ক্যামিক্যাল ব্যবহার না করে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। তিনি সেখানে ১ হাজার সেক্স ফেরোমেন ফাঁদ বসিয়েছেন। কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান না থাকলেও সুযোগ পেলেই প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। কৃষি বিভাগ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায়ই বিভিন্ন লোকজন পরিদর্শন করেন তার খামার।

আমজাদ হোসেন খান আরও জানান, তরমজু চাষের জন্য প্রচুর বৃষ্টি হলে ভাল হয়। বৃষ্টি কম হলেও সেচ দিয়ে তা পোষানো যায়। তরমুজ আবাদে পোকা ও ফ্রুট ফ্লাই-এর আক্রমণের পাশাপাশি পচন রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। নিবিড় পরিচচর্যার মাধ্যমে এই অসুবিধা দূর করা সম্ভব।

আমজাদ হোসেন খান ২ সন্তান নিয়ে এখন সুখেই জীবন-যাপন করছেন। অথচ এক সময় তাকেও অর্থ কষ্টের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছিল। 

হরিনখোলা গ্রামের উজ্জল মিয়া জানায়, আমজাদ খান সাহেবের তরমুজ খেতে সবাই পছন্দ করে। আমরাইও এই তরমুজ খেয়েছি। খুবই সুস্বাদু। বর্তমানে তার কৃষি খামারে আমি নিয়মিত কাজ করে পরিবারকেও সহায়তা করতে পারছি। মাধবপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ আতিকুল হক জানান, হলুদ রঙের মধুবালা তরমুজ একটি হাইব্রিড জাত। বাংলাদেশে এই তরমুজ তেমন একটা আবাদ হয়নি। অপ্রচলিত ও সুস্বাদু হওয়ায় এর চাহিদা বাজারে বেশি। আমজাদ হোসেন খানকে এই তরমুজ চাষে কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে। 

মাধবপুর উপজেলার উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা ঋষিকেশ ভট্টাচার্য্য জানান, মধুবালা তরমুজ ১ থেকে সাড়ে ৩ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। ফুল আসা থেকে পরিপক্ক হতে এই ফলের সময় প্রয়োজন ১ মাস। অন্যান্য জাতের তুলনায় এই ফসলের উৎপাদন বেশী হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোপাল চন্দ্র দাস জানান, আমাদের কৃষিতে অনেক সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মত উদ্যোমী লোকের অভাব রয়েছে। আমজাদ হোসেন খানের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাকে অনুসরণ করে আরও কৃষক এগিয়ে আসবে বলে তিনি আশাবাদী।

হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের প্রভাষক সুভাষ চন্দ্র দেব জানান, তরমুজের বৈজ্ঞানিক নাম ‘সিটরোনাস ভালগারিস’। এই ফল প্রচুর ক্যালসিয়াম ও লৌহসমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার। ঔষধি গুণ সম্পন্ন এই ফল ও বীজ মাথা ঠাণ্ডা রাখে এবং দেহকে শীতল রাখে। আমজাদ হোসেন খানের এই তরমুজ চাষে সফলতা অনেক মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।

গ্যাস ফিল্ড ফ্রুটস ভ্যালী : একটি দৃষ্টিনন্দন ফল উপত্যকা

হবিগঞ্জ: শাহজীবাজারে অবস্থিত হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের পাহাড়ের টিলায় প্রায় ৩ একর জায়গা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে মনোরম ফলের বাগান, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ফ্রুটস ভ্যালী’ বা ফলের উপত্যকা। দেশী-বিদেশী বহু দূর্লভ এবং বিলুপ্তপ্রায় ২০০ জাতের বিভিন্ন ফলের সমারোহে ফ্রুটস ভ্যালীটি পরিপূর্ণ। 

এখানে বিভিন্ন জাতের গাছ থেকে ইতিমধ্যে ফল আসা শুরু হয়েছে যা বৃক্ষ প্রেমিকদের মাঝে আলোড়ন ও কৌতুহল সৃষ্টি করেছে। প্রতিনিয়ত বহু দর্শণার্থী দূর্লভ ফল বাগান দেখার জন্য ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু স্থানটি গ্যাস ফিল্ডের অভ্যন্তরে হওয়ায় পর্যটকরা দেখতে পারছে না। ১৩ জাতের পাখি এবং ৮ জাতের বিভিন্ন ধরণের কবুতর, খরগোশ ও বানর রয়েছে এ ফল উপত্যকায়। গড়ে তোলা হয়েছে ওষুধি গাছের মিউজিয়াম।

হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার শাহজিবাজারে হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড অবস্থিত। এই ফিল্ডটি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানী লিমিটেড-এর অন্তর্গত পেট্রোবাংলার একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা ফিল্ডের এলাকাধীন অব্যবহৃত পাহাড়ের টিলায় তৈরি করেন এই ‘ফ্রুটস ভ্যালী’। ফ্রুটস ভ্যালীর মূল পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন গ্যাস ফিল্ডের উপ-ব্যবস্থাপক ইনচার্জ (ফিল্ড-প্রশাসন) এটিএম নাছিমুজ্জামান। পশু-পাখি এবং ফলের এই ভ্যালীটি প্রাকৃতিক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশী বহু পশু-পাখি এদের সান্নিধ্যে এসে ফ্রুটস ভ্যালীতে নির্বিঘেœ বিচরণ করে যা পরিবেশের জন্য সহায়ক ও মঙ্গলজনক।

ফ্রুটস ভ্যালীর প্রবেশ পথের ডান পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন জাতের পেয়ারার বাগান। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে লাগানো হয়েছে সুপারি গাছ যা প্রথম দর্শনেই দর্শণার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পেয়ারার বাগানের উত্তরের পাহাড়ের ঢালে রয়েছে বিভিন্ন জাতের আমের গাছ। এই গাছে ঝুলে থাকা আমগুলো খুবই দৃষ্টিনন্দিত। পাহাড়ের উত্তরে এক পাশে পেঁপে, অন্য পাশে লিচু বাগান। লিচু বাগানের বেদানা লিচু এক দুর্লভ সংগ্রহ যা প্রতিটি দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করে। মহুয়া, পেস্তা বাদাম, আশফল, তৈকর, ফলসা বৈ-চি ফলের গাছগুলো রয়েছে ফ্রুটস ভ্যালীর মাঝখানে। বাগানের উত্তর পাশে টিলার ঢালে রয়েছে অমৃত সাগর ও হীমসাগর কলার বাগান। দুর্লভ এবং নতুন উদ্ভাবিত বেনিসন আম সত্যিই দর্শনীয় বৃক্ষ। এই আমের রং, স্বাদ এবং আকার যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। টিলার মাখানে ট্যাং আর থোকা থোকা আঙ্গুর দেখে দর্শণার্থীরা অভিভূত হন এবং ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ান। থমকে দাঁড়ান ২৪ ইঞ্চি সাইজের অতি ক্ষুদ্র গাছে থোকা থোকা আম ঝুলতে দেখে। 
এই বারমাসী আমের গাছে এক ডালে আম অন্য ডালে মুকুল যা সত্যিই দুর্লভ এবং অবিশ্বাস্য দৃশ্য। ফ্রুটস ভ্যালীর পশ্চিম পাশে বিভিন্ন জাতের খরগোশ এবং পূর্ব পাশে রয়েছে দূর্লভ প্রজাতির বিভিন্ন পাখি যা ফ্রুটস ভ্যালীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে করেছে অধিকতর প্রাকৃতিক। প্রতিনিয়ত বাইরে থেকে পাখি এসে এদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে। ইতিমধ্যে ফ্রুটস ভ্যালীটি পশু-পাখিদের জন্য হয়ে উঠেছে অভয়ারণ্য চারণ ভূমি। সর্ব পশ্চিমে এক কোণায় রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এবং তার পাশে রয়েছে ৮ জাতের কবুতর। অতি দৃষ্টিনন্দিত ২টি টার্কি পুরো ভ্যালী দর্শণার্থীদের সাথে ঘুরে বেড়ায়, ওদের পেখম মেলানো নাচ প্রতিটি দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করে। ফ্রুটস ভ্যালিতে যে লিপস্টিক তেঁতুলের গাছটি রয়েছে তা বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রায়। রয়েছে দেশের সবচেয়ে উঁচু বৃক্ষ বাইলাম গাছ। এ সব গাছের সাথে রয়েছে অনেক দেশের বরেণ্য ব্যক্তির ছোঁয়া। কারণ এখানে আসা বরেণ্য ব্যক্তিরা দূর্লভ গাছের চারা রোপণ করেছেন।

হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারিসহ তাদের পরিবারবর্গের প্রতিটি সদস্যদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগান দিয়ে চলছে এই ফ্রুটস ভ্যালী। বছরের ১২ মাসই বিভিন্ন ধরণের ফল ও সবজি এই ফ্রুটস ভ্যালীতে পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে কোম্পানী কর্তৃপক্ষ ফ্রুটস ভ্যালীকে অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে এটি একটি লাভজনক এবং দৃষ্টান্তমূলক কৃষি খামার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ছোট পরিসরে পারিবারিক পরিমন্ডলে পুষ্টি যোগানদাতা হিসেবে এই ফ্রুটস ভ্যালী একটি মডেল হিসেবে সমাদৃত হবে। যে কেউ এ ধরণের বাগান করে অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হতে পারবে। 
ফ্রুটস ভ্যালী তৈরির মূল উদ্দেশ্য মানুষের মাঝে আত্ম চেতনাবোধ জাগ্রত করা এবং সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ গড়া। এই ফ্রুটস ভ্যালীতে রোপিত বিরল এবং বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির ফল সংরক্ষণ করে সারা দেশে এর বংশ বিস্তারের প্রয়াস চালানো হবে। যাতে ক্ষুদ্র কৃষক সীমিত পরিসরে এ ধরণের বাগান বা খামার প্রতিটি বাড়িতে তৈরি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা এবং সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে ফ্রুটস ভ্যালী।

ফ্রুটস ভ্যালীতে দেশী-বিদেশী বহু দূর্লভ এবং বিলুপ্তপ্রায় ২০০ জাতের ফলের গাছ রয়েছে। ফলের গাছগুলো হচ্ছে মহুয়া, আঁশ ফল, বিলাতী গাব, চেরী, আগর, লটকন, শরীফা, ডেওয়া, লবংগ, লুকলুকি, ম্যাট্রোস, জামান ফল, কাউ ফল, সফেদা (বিদেশী), সফেদা (দেশী), পান বাহার, কদবেল (হাইব্রীড), বেল (দশ সেরী), করমচা (লাল), করমচা (মিষ্টি), করমচা (সাদা), বিলম্ব, জাফরান, তৈকর, কাজু বাদাম, স্টার আপেল, কামরাংগা, অরবড়ই, মিষ্টি তেঁতুল, টক তেঁতুল, লিপিস্টিক তেঁতুল, গোলাপজাম, আতা (থাইল্যান্ড), হাজারিকা কাঁঠাল, বারমাসী কাঁঠাল, দেশী কাঁঠাল, পেঁপে (হাইব্রীড), চালতা, দারচিনি, বাইস্যুপ, লংগন, বেদানা, রামবুয়াম (থাইল্যান্ড),  জলপাই (হাইব্রীড), থাই মিষ্টি জলপাই, খেজুর, ইরাকি খেজুর, তাল, জাম, আঙ্গুর (সবুজ), আঙ্গুর (লাল), ট্যাং, তেজপাতা, লিচু (চাইনিজ), লিচু (বোম্বাই), বেদানা লিচু, ডালিম, কাজি পেয়ারা, মকুন্দপুর পেয়ারা, আঙ্গুর পেয়ারা, চাইনিজ পেয়ারা, স্টবেরী পেয়ারা, ওয়াশিংটন পেয়ারা, ইপসা পেয়ারা, পলি পেয়ারা, আপেল পেয়ারা, নারিকেল কুল, আপেল কুল, কুল (ঢাকা-৯০), কুল (রাজশাহী), বন বড়ই, তাইওয়ান কুল, কুল (থাইল্যান্ড) বারমাসী, বাউকুল, কমলা (ছাতক), কমলা (নাগপরি), কমলা (কাশ্মিরী), মালটা, গোসাম্বী, সুপারী, আমড়া (হাইব্রীড), হাজারী লেবু, শরবতি লেবু, কামরাংগা লেবু, কাগজী লেবু, নাসপাতি, কলা (অমৃত সাগর), কলা (হিমসাগর), জাম্বুুরা, আমরুল (সাদা), জামরুল (লাল), জামরুল (লাল-সবুজ), জামরুল (সবুজ), জামরুল (গোলাপি), আপেল জামরুল, বারমাসী আম (থাইল্যান্ড), সূর্যপুরী আম, খিসরাপাতি আম, নারকেল, আম্রপালী আম, দেশারী আম, মল্লিকা আম, গোপাল ভোগ আম, মহনভোগ আম, আলফাজ আম, ফজলি আম, বেনিসন আম, ফলসা, মিশ্রী ডোগ আম, পেস্তা বাদাম, পিচ ফল, জাবাটি কাবা (ব্রাজিল), এ্যাবোকেডো (রাশিয়া), চাপালিশ, সবুজ আপেল, আমলকি, ল্যাংসার্ট, সীডলেস আম, সীডলেস পেয়ারা, পার্সিমন (জাপান), নীল, কফি, বামন জলফাই, লাভ লাভ (সিংগাপুর), ডেফল, চিরতা, জ্যৈষ্ট মধু, খয়ের, মনকাটা, কাসাভা।

ফ্রুটস ভ্যালির স্বপ্ন দ্রষ্টা এটিএম নাছিমুজ্জামান এই ফলগুলোর বর্ণনা দিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন্ যার নাম ‘বাংলাদেশের যত ফল’। তিনি জানান, নিছক শখের কারণেই বাগানটি গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু গ্যাস ফিল্ডের অভ্যন্তরে হওয়ায় এবং এটি কেপিআই হওয়ায় পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। 

হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজেন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সুভাষ দেব জানান, ফ্রুটস ভ্যালি শুধু পর্যটন কেন্দ্র নয়। চাইলে উদ্ভিদের গবেষণার জন্য এটি ব্যবহার করা সম্ভব। তিনি এটিকে পর্যকটকদের জন্য উন্মুক্ত করতে বিকল্প রাস্তা গড়ে তোলার আহবান জানান।