লালমনিরহাট: লালমনিরহাট শহরের অদূরে ফুলগাছ গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে প্রায় শতাধিক কৃষক পরিবার সফল হয়েছে। এ গ্রামে সূর্যমুখীর চাষ প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছে। এ গ্রামে ফুল চাষে সফলতা দেখে গোটা জেলায় সূর্যমুখী চাষের ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে।
আর সেই গ্রামটির নাম ফুলগাছ। লালমনিরহাট জেলা সদরের অদূরে গ্রামটি। জেলা শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে এবং মোগলহাট ইউনিয়নের ধরলা ও রত্নাই নদী পাড়ে ফুলগাছ গ্রাম। কিভাবে গ্রামটির নাম ফুলগাছ হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। তবে ব্রিটিশ আমলে শাল ও সেগুন গাছের বাগান ছিল মোগলহাটে। সেই শাল ও সেগুনের ফুলের নামে নাম হয়েছিল ফুলগাছ। মোগলহাট রেল স্টেশনে কিছুদিন আগেও কয়েকশ’ বছরের পুরনো বিশাল বিশাল সেগুন গাছ ছিল।
লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলায় সরকারি বেসরকারি ও এনজিওদের মাধ্যমে প্রচলিত কৃষি শস্যের বাইরে নতুন নতুন লাভজনক ফসল চাষে কৃষককে প্রেরণা যোগাতে মাঠ পর্যায়ে কাজ চলছে। বিশেষ করে ধরলা, তিস্তা, স্বর্ণমতি, বুড়ি তিস্তা, দূধকমল ও রতœাই নদীর চরাঞ্চলের বালুতে কিভাবে কৃষি ফসল ফলানো যায় এবং কিভাবে চরের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এ নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এছাড়া মাঠ পর্যায়ে দু’ফসলি জমিতে কিভাবে বছরে ৩টি অর্থকারী কৃষিশস্য চাষ করা যায় তা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সফলতাও এসেছে। চরের ধূ-ধূ বালু মাটিতে বিশেষ পদ্ধতিতে সবজি চাষ, মিষ্টি কুমড়া চাষ, আলু চাষ, স্ট্রবেরী ফল চাষ ও নীল চাষ ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন আর চরের বালু জমিও ফেলে রাখা হয় না। প্রতিটি চর এখন একেকটি অর্থকারী ফসল চাষের জোনে পরিণত হয়েছে।
প্রচলিত ফসলের বাইরে বছরে দু’ফসলই জমিতে ৩টি অর্থকারী ফসল আবাদের অংশ হিসেবে এই প্রথমবারের মত লালমনিরহাটে ফুলগাছ গ্রামে সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিকভাবে ফসল হিসেবে চাষ করা হয়েছে, যা ব্র্যাকের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আলোকে সূর্যমুখী ফুল চাষের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্র্যাকের সদর উপজেলা ব্যবস্থাপক মো. নূর আলম জানান, সূর্যমূখী ১টি অর্থকারী কৃষি ফসল। মূলত প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সূর্যমূখীর চাষ করা হচ্ছে। সূর্যমূখী ফুলের দানা থেকে ভোজ্যতৈল উৎপাদন করা হবে, যা কোলেস্টেরল মুক্ত। এছাড়াও শর্ষে বাটার মত করে সূর্যমুখী ফুলের দানা খাওয়া যায়। গ্রামের মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনবে এই সূর্যমুখী ফল চাষ।
সূর্যমুখী ফুল ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দু’জন কৃষক পরিচর্যা করছেন। তারা হলেন, আজগর আলী (৫০) ও নুর বক্স (৪৮)। নুর বক্সের এই ব্লকে ৮১ শতাংশ জমি রয়েছে। এই দু’জন কৃষক জানান, সূর্যমূখী ফুল চাষের আনন্দেই আলাদা। মনের আনন্দে এই ফসল চাষ করা যায়। ফুল উঠার পরে হাইব্রিড সাথী ধান এই জমিতে চাষ করা হবে। এক বিঘা মাটিতে সূর্যমূখী চাষে খরচ পড়ে প্রায় ৩ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ৮ মণ সূর্যমুখী ফুলের দানা উৎপাদন হবে। বাজারে এক মণ সূর্যমুখী ফুলের দানার দাম ১৫ শত টাকা। খরচ বাদে বিঘা প্রতি ৯ হাজার টাকা লাভ থাকে।
ব্র্যাকের লালমনিরহাট জোনাল অফিসের ব্যবস্থাপক ( কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি) মিঃ বিপ্লব কুমার নাগ জানান, সূর্যমুখী ফুল সারা দেশে ব্র্যাকের অধীনে ১২ জেলায় ৫৩টি ব্লকের মাধ্যমে চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় ৩২৪ একর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়েছে। ৬৬৩ জন উপকারভোগী কৃষক রয়েছে। ব্র্যাক এসব কৃষককে বীজ ও নগদ অর্থ অনুদান দিয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা সদরের ৩৩.৪৫ একর, আদিতমারী উপজেলায় ২৮ একর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৫২ একর ও হাতীবান্ধা উপজেলায় ৫২ একর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ৩০ একর, উলিপুর উপজেলায় ৩২ একর, চিলমারী উপজেলায় ৩০ একর ও নাগেশ্বরী উপজেলায় ৬৬ একর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়েছে। সূর্যমুখী ফুল ৯০ দিনের ফসল। প্রথমবারের মত এই জেলায় চাষ শুরু হওয়ায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও হাতে-কলমে শিখাতে হয়েছে।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মজিদ জানান, ফুলগাছ গ্রামে সূর্যমুখী চাষ করে কৃষকরা গ্রামটির নামের স্বার্থকতা ফিরিয়ে এনেছে। সত্যিকার অর্থে, গ্রামটি এখন ফুলচাষের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। প্রথমবারের মতই সূর্যমূখী ফুল চাষ করে কৃষক পরিবারগুলো ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রতিদিন ফুলের ক্ষেতের সৌন্দর্য দেখতেও মানুষ শহর থেকে গ্রামটিতে ছুটে আসছে। সূর্যমুখী চাষ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।