Thursday, March 6, 2014

নওগাঁয় স্ট্রবেরী চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক উজ্জ্বল

নওগাঁ: নওগাঁয় স্ট্রবেরী চাষ করে সফলতা অর্জন করেছেন এক উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক সালাহ উদ্দিন উজ্জ্বল। তাই সরকারি বা বেসরকারি চাকুরির প্রত্যাশা করেন না তিনি। স্ট্রবেরী আর সাথে অস্ট্রেলিয়ান আঙ্গুর চাষ করে তিনি জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে চান । 

সালাহ উদ্দিন উজ্জ্বল (৩৫) নওগাঁ শহরের কোমাইগাড়ী মহল্লার সৈয়দ আলীর পুত্র। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করার পর চাকুরির প্রত্যাশায় ঘুরে ঘুরে কুল-কিনারা না পেয়ে অবশেষে স্বাবলম্বী অর্জনের লক্ষে বিভিন্ন জায়গা ও কাজ খুঁজে ফিরতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি কৃষি উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী অর্জনের পথ খুঁজে নেন। 

টেলিভিশনে এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে স্ট্রবেরী চাষে সফলতার খবর দেখে তিনিও এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরিকল্পনামতে তিনি শহরের জেলাখানা’র পশ্চিম পার্শ্বে ৩ বিঘা জমি লীজ নেন। বার্ষিক প্রতি বিঘা জমি ১০ হাজার টাকা করে মোট ৩০ হাজার টাকা প্রদানে চুক্তিবদ্ধ হন। সে জমিতে গত ২ বছর ধরে স্ট্রবেরী ও আঙ্গুর চাষ শুরু করছেন। গত বছরের সফলতা প্রাপ্তি’র ফলে এ বছরও তিনি ওই ৩ বিঘা জমিতে স্ট্রবেরী চাষ করেছেন। 

অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চারা রোপন করেন। ১ ফেব্র“য়ারি থেকে স্ট্রবেরী উঠতে শুরু করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত উৎপাদন হবে। ঢাকা, চট্্রগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় তার বাগান থেকে স্ট্রবেরী সরবরাহ হচ্ছে। আবার সরাসরি ফসলের ক্ষেত থেকেও পাইকারী কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তার এই ক্ষেতের স্ট্রবেরীর চাহিদা রয়েছে- একথা জানান উজ্জ্বল। 

তিনি আশা করছেন এ বছর প্রতি বিঘা জমি থেকে ৩ হাজার ২শ’ কেজি স্ট্রবেরী উৎপাদিত হবে। সেই হিসেবে ৩ বিঘায় উৎপাদিত হবে ৯ হাজার ৬শ’ কেজি। বর্তমান বাজার মুল্য অনুযায়ী তিনি পাইকারী বিক্রি করছেন প্রতি কেজি স্ট্রবেরী ২শ’ টাকা হারে। এ হিসেবে উৎপাদিত স্ট্রবেরীর বিক্রি মুল্য ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা।

জমির লীজ মুল্য, চারা, সার, ফসফেট, লেবার খরচ বাবদ প্রতি বিঘায় ১ লাখ হিসেবে মোট উৎপাদন খরচ হয়েছে ৩ লাখ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে কেবলমাত্র স্ট্রবেরী উৎপাদন করে এ বছর তার নীট মুনাফার পরিমাণ কমপক্ষে ১৬ লাখ টাকা। এ ছাড়াও আঙ্গুরের মওসুম থেকেও তিনি আয় করবেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ। 

স্ট্রবেরী চাষ করে কেবল তিনি নিজেই লাভবান হয়েছেন তাই নয়। অন্যদেরও স্ট্রবেরী চাষে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়ে উৎসাহিত করেছেন। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও পরামর্শে গাজীপুর, গাইবান্ধা, খুলনা, নাটোর, নওগাঁ ও বগুড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২২টি স্ট্রবেরী বাগান তৈরি করে দিয়েছেন। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এস এম নুরুজ্জামান মন্ডল উজ্জ্বলের স্ট্রবেরী ক্ষেত সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন। তিনি জানান, কয়েক বছর ধরে নওগাঁ জেলায় বিভিন্ন এলাকায় স্ট্রবেরী চাষ শুরু হয়েছে এবং যারা চাষ করেছেন তারা লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে স্ট্রবেরী চাষ খুবই লাভজনক বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।

Wednesday, March 5, 2014

সম্ভাবনার পথে হাঁটছে পাবনা বিসিক শিল্পনগরী

পাবনা: দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পনগরী পাবনা বিসিকের বন্ধ কারখানাগুলো ফের চালু হতে শুরু করেছে। বন্ধ শিল্প ইউনিটগুলো চালু হওয়ায় শিল্পনগরীটিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা পাবনা বিসিক শিল্পনগরী এখন সম্ভাবনার পথে হাঁটছে।

১৯৬২ সালে পাবনা সদর উপজেলার ছাতিয়ানী এলাকায় ১০৯ দশমিক ৬৮ একর জমির ওপর প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পাবনা বিসিক শিল্পনগরী’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে বর্তমানে ৯২ দশমিক ০৯ একর জমিতে ৪৬৮টি শিল্প ইউনিটের জন্য প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতি একর জমির ইজারা মূল্য ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে যা আছে : এই শিল্পনগরীতে রাইস মিল, ডাল মিল, ফ্লাওয়ার মিল, সেমাই ও সুজি মিল, আইসক্রিম-বেকারি মিল, হালকা প্রকৌশল কারখানা, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি ইউনিটসহ বেশ কয়েকটি আয়ুর্বেদিক ও কেমিক্যাল কারখানা, দুটি প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং কারখানা, একটি ইলেক্ট্রনিক্স কারখানা, একটি টেক্সটাইল মিল, ৭টি টুইস্টিং কারখানা, একটি ব্যাটারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য চালু শিল্প ইউনিটগুলোতে বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

অধিকাংশ শিল্প ইউনিট চালু : বিসিক সূত্র জানায়, শিল্পনগরীতে মোট শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ১৬৯টি। বর্তমানে চালু রয়েছে ১৫৭টি ইউনিট। বন্ধ রয়েছে মাত্র ৮টি এবং নির্মাণাধীন রয়েছে ৪টি শিল্প ইউনিট। এ ছাড়া গত এক বছরে বন্ধ থাকা ৫টি শিল্প কারখানা পুনরায় চালু করা সম্ভব হয়েছে বলেও কর্মকর্তারা জানান।

সূত্র আরও জানায়, পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৭৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে এই শিল্পনগরীতে বছর উৎপাদন হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী। বিভিন্ন খাতে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয় হচ্ছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এই শিল্পনগরীতে বর্তমানে মোট ৪ হাজার ৪৪০ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

বন্ধ ৮টি শিল্প ইউনিট : মামলাজনিত কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ৮টি শিল্প ইউনিট। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট টেক্সটাইল মিল ১৫ বছর, পাবনা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১২ বছর, তৃষ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১২ বছর, গোল্ডেন ক্যাবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১০ বছর, শিপ্রা টেক্সটাইল মিল ১১ বছর, টেকনোটেক টেক্সটাইল মিল ১০ বছর, শুভ রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১১ বছর ও উডল্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড এর ২ নাম্বার ইউনিটটি প্রায় ১২ বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে।

বছরের পর বছর ধরে এই কারখানাগুলো বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাবিবুর রহমান জানান, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়াই এর প্রধান কারণ। এর ফলে একদিকে যেমন বন্ধ কারখানাগুলো উৎপাদনে যেতে পারছে না, অন্যদিকে যারা উৎপাদনে যেতে পারবে না সেই স্থানগুলোও আগ্রহী কারখানাকে স্থানান্তর সম্ভব হচ্ছে না। মামলাগুলো নিষ্পত্তি হলে মালিকানা হস্তান্তর করা সম্ভব হবে। নতুন মালিকরা দ্রুত কারখানাগুলো চালু করে উৎপাদনে যেতে পারবেন।

প্রশিক্ষণ কার্যক্রম : বিভিন্ন কারখানা স্থাপন ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পাবনা বিসিক শিল্পনগরীতে বিভিন্ন ট্রেডে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স, উডওয়ার্ক, ওয়েল্ডিং, ফিটিং কাম মেশিন শপ, সেলাই, ব্লক অ্যান্ড বুটিক প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারিসহ বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিসিকের নৈপুণ্য বিকাশ কেন্দ্রের নামে এই প্রশিক্ষণে বর্তমানে ২০ জন প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন।

কর্মকর্তা-কর্মচারী : পাবনা বিসিকে অফিস রয়েছে দুটি। একটি হলো শিল্পনগরী অফিস ও অপরটি শিল্প সহায়ক অফিস। শিল্পনগরী অফিসে দুইজন কর্মকর্তার জায়গায় আছেন একজন। কর্মচারী ৬ জনের স্থলে আছেন ৫ জন। শিল্প সহায়ক অফিসে কর্মকর্তা ১১ জনের মধ্যে আছেন ৫ জন। ৮ জন কর্মচারীর মধ্যে আছেন ৭ জন।

সমস্যা : সম্ভাবনার পরেও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে পাবনা বিসিকে। পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর স্টেট অফিসার জেএন পাল জানান, বর্তমানে শিল্পনগরীতে বরাদ্দযোগ্য কোনো প্লট না থাকায় শতাধিক নতুন আবেদনকারীকে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ১০৯ দশমিক ৬৮ একর জমির উপরে স্থাপিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শিল্পনগরীতে অভ্যন্তরীণ রাস্তার পরিমাণ ৪.৪০ কিলোমিটার ও ড্রেনের পরিমাণ ৮ কিলোমিটার। প্রয়োজনীয় মেরামতের অভাবে রাস্তাগুলো যান চলাচলের প্রায় অনুপোযোগী। ড্রেনগুলো দিয়ে ঠিকমতো বর্জ্য নিষ্কাশন হয় না। বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খাতে মাত্র ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা খুবই অপ্রতুল ও হাস্যকর। পাবনা শিল্পনগরীর কার্যালয় থেকে রাস্তা ও ড্রেন মেরামতের জন্য বারবার প্রাক্কলন প্রেরণ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

যা করা প্রয়োজন : পাবনা বিসিক শিল্পনগরীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাবিবুর রহমান ও স্টেট অফিসার জেএন পাল জানান, শিল্পনগরীটি সম্প্রসারণের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে ইতোপূর্বে সাইট সিলেকশনসহ প্রয়োজনীয় বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সরকারি বরাদ্দ, উদ্যোক্তা আর বিনিয়োগকারীদের সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা, আরও অধিক জায়গা অধিগ্রহণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, সরকারিভাবে বিসিকের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা ও পাবনা বিসিকের মধ্যে ব্যাংকের একটি শাখা স্থাপনসহ সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা পেলে শিল্পনগরীটি দেশের মধ্যে সেরা অবস্থানে উঠে আসবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের কমলা বাগানগুলোয় এবারও প্রচুর ফল এসেছে

ঠাকুরগাঁও : রসালো পাকা কমলা দেখলে কার না জিভে জল আসে। আবার সে কমলা যদি হয় নিজ দেশে উৎপাদিত তাহলে তো রসনাকে সংযত করাই কঠিন। কম করে হলেও দেশের মানুষ এবার ঠাকুরগাঁওয়ের উৎপাদিত কমলা দিয়ে রসনা তৃপ্ত করতে পারছেন। কমলা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ঠাকুরগাঁও জেলায় ২০০৬ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। এর বাস্তবায়নস্বরূপ বেশ কিছু বাগানে এবার প্রচুর ফল আসে। এর চাহিদা অনেক। এখানকার কমলা বেশ রসালো ও মিষ্টি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কচুবাড়ি গ্রামের কমলা চাষী আব্দুল মান্নান চৌধুরী জানান, তার বাগানের প্রতিটি গাছে এবারও প্রচুর ফল এসেছিল। শীতকালে কমলাগুলো পেকে যাওয়ায় এবং গাছের পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করায় মনে হয় পুরো বাগান আবীর দিয়ে যেন রাঙিয়ে দেয়া হয়েছে । 

মান্নান চৌধুরী আরও জানান, তিনি ২০০৯ সালের জুন মাসে কমলা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ১৫৫টি খাসিয়া ম্যান্ডারিন জাতের চারা এনে ৫০ শতক জমিতে লাগান। উপযুক্ত পরিচর্যা করায় গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠে । গত বছর থেকে প্রতিটি গাছ প্রচুর ফল দেওয়া শুরু করেছে । মান্নান চৌধুরীর বাগানের কমলার সাইজ বেশ বড়। মিষ্টি হালকা হলেও স্বাদ গন্ধ বেশ ভাল। 

কমলা উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হয়েছে ২০১০ সালের ৩০ জুন। এই প্রকল্পের আওতায় ঠাকুরগাঁও জেলার রানীসংকৈল ও সদর উপজেলায় গত ৫ বছরে ২২৬টি বাগান গড়ে উঠেছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় ৭৫ হেক্টরে এবং পঞ্চগড় জেলায় ১১০ হেক্টরে কমলা চাষ হয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় এখন কমলা চাষীর সংখ্যা ১,১৫০ জন। মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৮৭ হাজার। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে এটি দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে । 

ভিটামিনযুক্ত এই রসালো ফলের চাষ প্রথমে সখের বশে শুরু করেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ইয়াকুবপুর গ্রামের কানাইলাল। তবে ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষক এখন কমলাকে বাণিজ্যিক ও অর্থকরী ফসল হিসাবে দেখছেন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কচুবাড়ি গ্রামের আব্দুল মান্নান চৌধুরী, আকচা গ্রামের গোলাম সারওয়ার, ইয়াকুবপুর গ্রামের কানাইলাল, মুন্সিরহাট গ্রামের ফরহাদ হোসেন, রানীসংকৈল উপজেলার কাদিহাট গ্রামের রুস্তম আলী, বনগাঁর সিরাজউদ্দিন, জগদল গ্রামের আব্দুর রহিম এবং আরো অনেকে এই প্রকল্পের আওতায় কমলার বাগান গড়ে তুলেছেন । 

ঠাকুরগাঁও জেলায় শখের বশবর্তী হয়ে সদর উপজেলার ইয়াকুবপুর গ্রামের কানাইলাল ২০০১ সালে ১০ শতক জমিতে ৪৩টি নাগপুরী, খাসিয়া ও ম্যান্ডারিন জাতের কমলার চারা লাগান । চার বছর পর তার বাগানে ফল আসে । 
২০০৬ সালে সরকার জেলার রানীসংকৈল ও সদর উপজেলায় কমলা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করে। গত ৭ বছরে এই দুই উপজেলায় ছোট বড় ২২৬টি কমলার বাগান হয়েছে। এসব বাগানে গড়ে ১৭০টি করে প্রায় ৩৮ হাজার গাছ রয়েছে। এ ছাড়া ৪,১৪০টি বসত বাড়ীতে গড়ে ১২টি করে প্রায় ৪৯ হাজার চারা লাগানো হয়েছে। কমলা চাষের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার কৃষককে। খাসিয়া ও ম্যান্ডারিন জাতের এসব কমলার আকার, বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ খুবই উন্নত । 

সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম ফেরসাডাঙ্গী। শহর থেকে ১৪ কি.মি. দূরে। এই গ্রামের ২১০টি পরিবার ১২ থেকে ১৫টি করে প্রায় ৩ হাজার কমলার চারা লাগিয়েছেন। এই গ্রামের আব্দুর রহমান, সফিরউদ্দিন, খলিলুর রহমান, কেতাবুর রহমান, মঞ্জুয়ারা বেগম, জিল্লুর রহমান জানান, তাদের জমি অনুর্বর, চাষ আবাদ করে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না । তাই তারা ওই সব জমিতে কমলার চারা লাগিয়েছেন বাড়তি কিছু লাভের আশায় । 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বেলায়েত হোসেন জানান, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার মাটি, তাপমাত্রা ও জলবায়ু কমলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এসব কারণে এখানে সরকার কমলা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে । এই দুই জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কমলার চাষ করা যেতে পারে । 

Monday, March 3, 2014

নারী উন্নয়নে সফল নারী উদ্যোক্তা ছফুরা

নরসিংদী: কর্ম ও উদ্দীপনা নিয়ে শুধু পুরুষরা এগিয়ে যাচ্ছে না, নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে। এর দৃষ্টান্ত নরসিংদী শহরের চিনিশপুর গ্রামের ছফুরা বেগম। তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা এবং মানবাধিকার কর্মী। তার জীবনের দিনগুলো ব্যয় হচ্ছে সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের উন্নয়নে। ছফুরা বেগম অবহেলিত নারীদের ঘর থেকে কর্মক্ষেত্রে আসার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, যাতে করে তারা আত্মকর্মে নিযুক্ত হয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। 

১৯৯২ সালে ২০ জন দুস্থ মহিলা নিয়ে সফুরা তার গ্রামের বসত বাড়িতে ‘চিনিশপুর দীপশিকা মহিলা সমিতি’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন। স্থানীয় মহিলা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় সমাজের অবহেলিত মহিলাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘নকশী কাঁথা’ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সাহায্য নিয়ে ২ বছরের মধ্যে ‘দীপশিকা মহিলা সমিতি’ স্থানীয় এনজিও হিসেবে নিবন্ধ ফলে মহিলা উন্নয়নে তিনি আরো ব্যাপক পরিসরে কাজ করার সুযোগ পান।  ছফুরা ২০০৩ সালে অশোকা ফেলোশিপ ইউএসএ লাভ করেন। 

৪৫ বছর বয়স্ক ছফুরা জানান যে, তিনি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশুনা করতেন তখন তার বাবা তাকে বিয়ে দেন। কিন্তু বিবাহের ৫ মাস না যেতে কালো মেয়ে বলে এবং যৌতুকের জন্য স্বামীর সংসার ছাড়তে হয়। বাবা ছিলেন গরীব মুক্তিযোদ্ধা। এরপর থেকে কঠিন দিন শুরু হয় তার। বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে চাকরি নিতে হয় স্থানীয় একটি পাট কলে। সেখানে চাকরিরত নারী শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী আদায় করতে গিয়ে তাকে বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু দমে যাননি তখনকার ১৬  বছর বয়সের এই নারী। প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন পাট কলে নারী শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী এবং অধিকার। ২ বছর পর পাটকল ছেড়ে তিনি একটি এনজিওতে কিছুদিনের জন্য কাজ নেন এবং পরবর্তীতে ‘চিনিশপুর দীপশিকা মহিলা সমিতি’ নামে একটি এনজিও’র নিবন্ধন করেন। 

এই নারী উদ্যোক্তা দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের অবহেলিত নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে, যেমন- নকশী কাঁথা সেলাই, পোশাক তৈরী, হাঁস মুরগী ও গবাদি পশু পালন, মৎস চাষ, বাগান করা এবং অন্যান্য আয়বর্ধক কাজে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এ পর্যন্ত জেলার প্রায় ২০ হাজার নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন।

ছফুরা বিভিন্ন কৃতিত্বের জন্য বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ২০০৩ জাতীয় শিক্ষা পুরস্কার ও অশোকা ফেলোশিপ ইউএসএ, ২০০৫ জেলা সম্মাননা পুরস্কার, ২০১০ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড ফিস পুরস্কার এবং ২০১২ জেলা পর্যায়ে মৎস্য পুরস্কার পেয়েছেন। নারী উদ্যোক্তা ছফুরা ২০১৩ সালে শিং মাছ উৎপাদন এবং গবেষণা কাজে সফল অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে (ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন ঢাকা) রৌপ্য পদক গ্রহণ করে। সম্প্রতি ছফুরা বেগম জেলার অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে জেলা প্রশাসন কর্তৃক জেলার জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। 

এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আমীর হামজার বলেন, বাংলাদেশে ছফুরার মতো এ ধরনের সফল নারী উদ্যোক্তা ও নারী উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ থাকলে দেশে উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ হবে আত্মনির্ভর ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেশ। 

Saturday, March 1, 2014

বরিশালে লেটুস্ পাতা চাষ করে অর্থনৈতিক সফলতা পেয়েছেন আজাদ

বরিশাল: বরিশাল মহানগরী ও বিভাগের ৬ জেলার চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলোর চাহিদা মিটিয়ে লেটুস পাতা বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে সফলতা পেয়েছেন মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি একজন ক্ষুদ্র নার্সারি ব্যবসায়ী।

নগরীর আউটার স্টেডিয়াম সংলগ্ন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা গ্রীন গার্ডেন নার্সারির শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা যায়, সখের বসে প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আজাদ, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেটেডিয়ামের প্রায় ১ একর জমি ভাড়া নেন। কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই ব্যক্তিগত সামান্য কিছু অর্থে একটি ক্ষুদ্র নার্সারি গড়ে তোলেন। 

এরপর মাত্র ২ বছরের মাথায় ব্যক্তিগত নার্সারি উদ্যোক্তা হিসেবে ২০০৯ সালে মো. আবুল কালাম আজাদ জাতীয়ভাবে ২য় স্থান অধিকার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার নেন। পুরস্কার পেয়ে আজাদ আরো বেশি উৎসাহী হন। তারপর তিনি (আজাদ) গ্রীন গার্ডেন নার্সারির আয়তন বাড়িয়ে দেন। পাশাপাশি বাণিজ্যিক দিক চিন্তা করে বিভিন্ন ধরনের ফলজ, ঔষুধি, ফুলের গাছ ও মূল্যবান বনসাই গাছ নিয়ে কাজ শুরু করেন। 

তবে এবছরই তিনি শীত প্রধান দেশে চাষকৃত লেটুস্ পাতা বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য পরীক্ষামূলক রোপন করে সফলতা পান। এ লেটুস্ পাতা শুধু দেশে নয়, বিশ্ব বাজারে বিভিন্ন চাইনিজ রেস্তোরাঁয় বহু সুস্বাদু খাবারের সাথে ও খাবারের পাশে ডেকোরেশনের জন্য ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যে লেটুস্ পাতা বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন চাইনিজ রেস্তোরাঁগুলোর মালিকেরা এক সময় ঢাকায় অর্ডার দিতো।

বরিশাল নগরীর বগুরা রোড ইয়াং থাই চাইনিজ রেস্তোরাঁর প্রো.রিপন কর্মকার জানান, গ্রীন গার্ডেন নার্সারির এ ধরনের উদ্যোগকে ব্যক্তিগত ভাবে আমি সাধুবাদ জানাই। কারণ যে লেটুস্ পাতা পেতে হলে রাজধানী ঢাকায় অর্ডার দিতে হতো। সেই লেটুস্ পাতা কম খরচে এখন হাতের কাছে চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যায়। 

গ্রীন গার্ডেন নার্সারির প্রো. আবুল কালাম আজাদ জানান, শুধু লেটুস্ পাতা নয়, নার্সারির অন্য কোন প্রয়োজনে বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা কৃষিবিদের সহযোগিতা ছাড়াই কিছু বই পড়ে এ সফলতার ফসল ঘড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। তবে স্থানীয় প্রতিবেশী সাধারণ মানুষ এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাত স্টেটেডিয়াম কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ও উৎসাহ না পেলে এ সফলতা সম্ভব হতো না। এজন্য তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

Thursday, February 27, 2014

আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে মুখরিত রাজশাহী, বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

রাজশাহী: আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সুমিষ্ট আমের রাজধানী বলে খ্যাত রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগানগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে মুকুল এসেছে। এবার আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন আম বাগানের মালিকেরা। 

মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে এখন মুখরিত জেলার আমবাগানগুলো। আমচাষীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বাগান পরিচর্যার কাজে। সব কিছু অনুকূলে থাকলে এই দুই জেলায় এবার প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। 

রাস্তার দু’ধারে সারি সারি আমগাছ ও বাহারি নানা জাতের আমের কথা এলেই চলে আসে সীমান্তবর্তী জেলা দু’টির নাম। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আম চাষে জমির পরিমাণ। এক সময়ের রুক্ষ লাল মাটির বরেন্দ্র অঞ্চলেও আম চাষে ঘটেছে নীরব বিপ্লব। 

গত কয়েক বছরে বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু-নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আম বাগান। তাই চলতি মৌসুমে এই দুটি জেলায় আম বাগানের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮১৬ হেক্টরে। এ বছর আম গাছের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। অথচ গত আম মৌসুমে আম বাগানের জমির পরিমাণ ছিল এর চেয়ে কিছুটা কম। 

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় আড়াইশ’ জাতের আম চাষ হয় এই দুই জেলায়। এর মধ্যে সুস্বাদু ও দেখতে বাহারি  ও স্বাদে ভালো ক্ষিরসাপাত, ল্যাংড়া, বোম্বাই, গোপালভোগ, হিমসাগর, ফজলী, আম্রপালি, আশ্বিনা, ক্ষুদি খিরসা, বৃন্দাবনী, লক্ষণভোগ, কালীভোগ, মোহন ভোগ জাতের আমই চাষ হচ্ছে বেশি। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল আমিন জানান, সাধারণত এক বছর আম উৎপাদন ভাল হলে পরের বছর ভালো হয় না। তাই আম ভালো হওয়ার বছরকে অন ইয়ার ও পরের বছরকে আম উৎপাদনের অফ-ইয়ার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে অভিহিত করে আসছিলো কৃষি বিভাগ। সেই হিসেবে এবার আম উৎপাদনের অন ইয়ার। 
তিনি বলেন, তাপমাত্রা স্বাভাবিক ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাগানগুলোতে ধারণার থেকেও অনেক বেশি মুকুল এসেছে। 

গত কয়েকদিনে, জেলার চারঘাট, বাঘা, পবা এবং দুর্গাপুর উপজেলার বেশ কিছু এলাকা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার মহারাজপুর, কালীনগর, বালিয়াডাঙ্গা, মহিপুর, গোবরাতলা ও শিবগঞ্জ উপজেলার রানীহটি, কানসাট, কালুপুর এলাকা ঘুরে সিংহভাগ গাছে ব্যাপক মুকুল আসার দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। 

কৃষকরা এখন ব্যস্ত বাগান পরিচর্যার কাজে। বিভিন্ন রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ থেকে বাগান রক্ষা করতে তারা গাছে গাছে  ¯েপ্র  করছেন ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক। 

চারঘাট উপজেলার নন্দনগাছি গ্রামের আমচাষী রেজাউল করিম জানান, এবার প্রতিটি বাগানে অপ্রত্যাশিত পরিমাণে মুকুল এসেছে। যে পরিমাণে মুকুল এসেছে তা থেকে ভালো উৎপাদন পেতে চাষীরা এখন বাগান পরিচর্যার কাজ করছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার হুজরাপুর এলাকার আমচাষী সাইদুর রহমানও বললেন একই কথা। তিনি আশা করছেন এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ভালো ফলন হবে। 

আম বাগানগুলোয় ব্যাপক মুকুল আসার বিষয়টি স্বীকার করে তা রোগ বালাই থেকে রক্ষা করতে কৃষকদের সঠিক সময়ে সহনীয় মাত্রায় ছত্রাকনাশক স্প্রে ও সেচ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, কৃষকরা একটু সচেতন হয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সহনীয় মাত্রায় ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক ব্যবহার করলে আম উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। তবে তিনি বলেন, গাছে মুকুল আসার আগেই যেমন ¯েপ্র করার প্রয়োজন নেই তেমনি মুকুল ফোটা অবস্থায় কোনোভাবেই স্প্রে করা ঠিক নয়। কারণ এ সময় প্রচুর পরিমাণ উপকারী পোকা আমবাগানে আসে এবং পরাগায়নে সহযোগীতা করে। তাই সঠিকভাবে দুইবার ¯েপ্র দিতে পারলে প্রচুর পরিমাণ আম টিকে থাকবে।

তাছাড়াও গাছে সময়মত সার, পানি সেচ, পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমন এবং অন্য যত্ন পরিচর্যার মাধ্যমে আমের ফলন বাড়ানো সম্ভব, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেয়ার জন্য আমচাষীদের অনুরোধ করেছেন।

অন্যদিকে স্থানীয় ফল গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দীন জানান, সঠিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। তিনি বলেন, আমচাষের বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলগুলো চাষীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে দলীয় সভা, উঠোন বেঠক ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, চলতি আম মৌসুমের শুরু থেকে আবহাওয়া পুরোপুরি অনুকূলে থাকায় এবার এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ গাছ মুকুলিত হয়েছে।  আগামী ১০/১২ দিনের মধ্যে আরো ১৫ শতাংশ গাছ মুকুলিত হবে বলে তিনি আশা করছেন। সব কিছু ঠিক থাকলে এবার এই দুই জেলায় ৩ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হবে- এমন ধারণা করছেন তিনি।

Wednesday, February 26, 2014

লালমনিরহাটে প্রথমবারের মতো সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিক চাষ

লালমনিরহাট: লালমনিরহাট শহরের অদূরে ফুলগাছ গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে প্রায় শতাধিক কৃষক পরিবার সফল হয়েছে। এ গ্রামে সূর্যমুখীর চাষ প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছে। এ গ্রামে ফুল চাষে সফলতা দেখে গোটা জেলায় সূর্যমুখী চাষের ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে। 

আর সেই গ্রামটির নাম ফুলগাছ। লালমনিরহাট জেলা সদরের অদূরে গ্রামটি। জেলা শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে এবং মোগলহাট ইউনিয়নের ধরলা ও রত্নাই নদী পাড়ে ফুলগাছ গ্রাম। কিভাবে গ্রামটির নাম ফুলগাছ হয়েছে তা কেউ বলতে পারে না। তবে ব্রিটিশ আমলে শাল ও সেগুন গাছের বাগান ছিল মোগলহাটে। সেই শাল ও সেগুনের ফুলের নামে নাম হয়েছিল ফুলগাছ। মোগলহাট রেল স্টেশনে কিছুদিন আগেও কয়েকশ’ বছরের পুরনো বিশাল বিশাল সেগুন গাছ ছিল।

লালমনিরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলায় সরকারি বেসরকারি ও এনজিওদের মাধ্যমে প্রচলিত কৃষি শস্যের বাইরে নতুন নতুন লাভজনক ফসল চাষে কৃষককে প্রেরণা যোগাতে মাঠ পর্যায়ে কাজ চলছে। বিশেষ করে ধরলা, তিস্তা, স্বর্ণমতি, বুড়ি তিস্তা, দূধকমল ও রতœাই নদীর চরাঞ্চলের বালুতে কিভাবে কৃষি ফসল ফলানো যায় এবং কিভাবে চরের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এ নিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। 
এছাড়া মাঠ পর্যায়ে দু’ফসলি জমিতে কিভাবে বছরে ৩টি অর্থকারী কৃষিশস্য চাষ করা যায় তা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সফলতাও এসেছে। চরের ধূ-ধূ বালু মাটিতে বিশেষ পদ্ধতিতে সবজি চাষ, মিষ্টি কুমড়া চাষ, আলু চাষ, স্ট্রবেরী ফল চাষ ও নীল চাষ ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন আর চরের বালু জমিও ফেলে রাখা হয় না। প্রতিটি চর এখন একেকটি অর্থকারী ফসল চাষের জোনে পরিণত হয়েছে। 

প্রচলিত ফসলের বাইরে বছরে দু’ফসলই জমিতে ৩টি অর্থকারী ফসল আবাদের অংশ হিসেবে এই প্রথমবারের মত লালমনিরহাটে ফুলগাছ গ্রামে সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিকভাবে ফসল হিসেবে চাষ করা হয়েছে, যা ব্র্যাকের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আলোকে সূর্যমুখী ফুল চাষের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্র্যাকের সদর উপজেলা ব্যবস্থাপক মো. নূর আলম জানান, সূর্যমূখী ১টি অর্থকারী কৃষি ফসল। মূলত প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সূর্যমূখীর চাষ করা হচ্ছে। সূর্যমূখী ফুলের দানা থেকে ভোজ্যতৈল উৎপাদন করা হবে, যা কোলেস্টেরল মুক্ত। এছাড়াও শর্ষে বাটার মত করে সূর্যমুখী ফুলের দানা খাওয়া যায়। গ্রামের মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনবে এই সূর্যমুখী ফল চাষ। 

সূর্যমুখী ফুল ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দু’জন কৃষক পরিচর্যা করছেন। তারা হলেন, আজগর আলী (৫০) ও নুর বক্স (৪৮)। নুর বক্সের এই ব্লকে ৮১ শতাংশ জমি রয়েছে। এই দু’জন কৃষক জানান, সূর্যমূখী ফুল চাষের আনন্দেই আলাদা। মনের আনন্দে এই ফসল চাষ করা যায়। ফুল উঠার পরে হাইব্রিড সাথী ধান এই জমিতে চাষ করা হবে। এক বিঘা মাটিতে সূর্যমূখী চাষে খরচ পড়ে প্রায় ৩ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ৮ মণ সূর্যমুখী ফুলের দানা উৎপাদন হবে। বাজারে এক মণ সূর্যমুখী ফুলের দানার দাম ১৫ শত টাকা। খরচ বাদে বিঘা প্রতি ৯ হাজার টাকা লাভ থাকে।

ব্র্যাকের লালমনিরহাট জোনাল অফিসের ব্যবস্থাপক ( কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি) মিঃ বিপ্লব কুমার নাগ জানান, সূর্যমুখী ফুল সারা দেশে ব্র্যাকের অধীনে ১২ জেলায় ৫৩টি ব্লকের মাধ্যমে  চাষ হচ্ছে। লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় ৩২৪ একর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করা হয়েছে। ৬৬৩ জন উপকারভোগী কৃষক রয়েছে। ব্র্যাক এসব কৃষককে বীজ ও নগদ অর্থ অনুদান দিয়েছে। 

লালমনিরহাট জেলা সদরের ৩৩.৪৫ একর, আদিতমারী উপজেলায় ২৮ একর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৫২ একর ও হাতীবান্ধা উপজেলায় ৫২ একর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ৩০ একর, উলিপুর উপজেলায় ৩২ একর, চিলমারী উপজেলায় ৩০ একর  ও নাগেশ্বরী উপজেলায় ৬৬ একর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়েছে। সূর্যমুখী ফুল ৯০ দিনের ফসল। প্রথমবারের মত এই জেলায় চাষ শুরু হওয়ায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ও হাতে-কলমে শিখাতে হয়েছে।

জেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মজিদ জানান, ফুলগাছ গ্রামে সূর্যমুখী চাষ করে কৃষকরা গ্রামটির নামের স্বার্থকতা ফিরিয়ে এনেছে। সত্যিকার অর্থে, গ্রামটি এখন ফুলচাষের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। প্রথমবারের মতই সূর্যমূখী ফুল চাষ করে কৃষক পরিবারগুলো ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রতিদিন ফুলের ক্ষেতের সৌন্দর্য দেখতেও মানুষ শহর থেকে গ্রামটিতে ছুটে আসছে। সূর্যমুখী চাষ গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।

Tuesday, February 25, 2014

শেরপুরে বিলুপ্তপ্রায় মাছ চাষে নতুন সম্ভাবনা

শেরপুর: জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অনেক নদ-নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। এসব কারণে দেশী জাতের মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাই কীভাবে দেশী জাতের মাছের চাষ বাড়ানো যায় তা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা গবেষণা এবং কার্যক্রম চলছে। এরই অংশ হিসেবে শেরপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মৎস্য হ্যাচারিতে দেশী শিং মাছের সফল কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। এতে এ অঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় দেশী জাতের মাছ চাষে এক নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।

শেরপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জেলার বেকার যুবদের তিন মাস মেয়াদী কৃষিবিষয়ক নানা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর মধ্যে মৎস্য  চাষ অন্যতম। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুবরা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে স্বাবলম্বী হয়ে থাকে।

শেরপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের হ্যাচারিটি একটি ক্ষুদ্রাকার ছোট মাছের হাচারী। নির্মাণ ও কারিগরি ত্র“টি এবং ব্র“ড ফিস তৈরীর জন্য বড় বড় পুকুর না থাকার পরও চলতি প্রজনন মৌসুমে এখানে দেশী শিং মাছের হ্যাচিং করতে সক্ষম হন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। ময়মনসিংহ থেকে ব্র“ড ফিস সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণার্থীদের দেশী বিলুপ্তপ্রায় মাছের হ্যাচিং শেখানো হয়। গত দু’টি ব্যাচে এখানে দেশী শিং মাছের সফল কৃত্রিম প্রজনন সম্ভব হয়। হ্যাচারিতে কাজ করে প্রশিক্ষণার্থীরা প্রযুক্তিটি হাতে-কলমে শিখতে পেরেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব হ্যাচারীতে স্থির পানির দেশী ছোট মাছ যেমনÑ মলা, গোলসা, পাবদা, কই, শিং, মাগুর ইত্যাদি মাছের প্রজনন করা সম্ভব। অল্প খরচেই ব্র“ড আকারের এমন হ্যাচারি স্থাপন ও পরিচালনা করা যায়। বেকার যুবক-যুবতী, ছেলে-মেয়ে এমনকি গ্রামীণ মহিলারাও পারিবারিক কাজের পাশাপাশি হ্যাচারিটি সহজেই চালাতে পারেন। মাত্র ৭০ হাজার টাকায় এ ধরনের একটি ব্র“ড হ্যাচারি স্থাপন করে প্রতি বছর ১৪/১৫ হাজার টাকা বিনিয়োগে বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।

যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষণার্থী ওসমান আলী, রহিমা খাতুন ও আব্দুর রহিম জানান, বাড়ীতেই এমন ক্ষুদ্র হ্যাচারি স্থাপন করে দেশীয় জাতের মাছ চাষ করা সম্ভব সে বিষয়টি আগে আমাদের জানা ছিলো না। এখানে হাতে-কলমে বিষয়টি শিখতে  পেরেছি। এতে আমরা দারুণ উৎসাহিত হয়েছি। সংসারের অন্যান্য কাজ করেও এটি পরিচালনা করা সম্ভব। বাড়ি ফিরে আমরা এ ধরনের ক্ষুদ্র আকারের হ্যাচারি স্থাপন করে নিজেদের ভাগ্য বদলের চেষ্টা করবো। 

শেরপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, সারাদেশে ৫৪টি জেলায় ৫৪টি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু আছে। প্রতিটি কেন্দ্রে একটি করে মাছের হ্যাচারি  রয়েছে। কিন্তু নির্মাণ ও কারিগরি ত্র“টির কারণে এবং ব্র“ড ফিস তৈরীর জন্য বড় বড় পুকুর না থাকায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ মৎস্য বিশেষজ্ঞ থাকার পরও বেশীর ভাগ হ্যাচারি চালু করা যাচ্ছে না। কিন্তু এত কিছুর পরও শেরপুরে ক্ষুদ্রাকার মাছের হ্যাচারিটি নিজেদের প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় আমরা চালু করেছি। এতে প্রজনন মৌসুমে ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে ব্র“ড ফিস সংগ্রহ করে শিং মাছের সফল কৃত্রিম প্রজনন সম্ভব হয়েছে। 

তিনি জানান, এ এলাকায় এ ধরনের ক্ষুদ্র হ্যাচারির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামীণ মেয়েরাও পারিবারিক কাজের পাশাপাশি হ্যাচারিটি সহজেই পরিচালনা করতে পারবেন। এ জন্য আঞ্চলিক ব্র“ড ফিস ব্যাংক তৈরী করা হলে মাছ চাষে অনেক সাফল্য আসবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।

বসত বাড়ির আঙিনায় ছোট মাছের হ্যাচারি স্থাপন করে রেণু পোনা উৎপাদন ও পালনের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বলেছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে শেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফজলুর রহমান বলেন, এ প্রযুক্তি গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা গেলে একদিকে যেমন আমিষের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াও সম্ভব হবে। 

Sunday, February 23, 2014

টাঙ্গাইলের মধুপুরে কিষানী মহিরন বেগমের কেঁচো বিপ্লব

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আউশনারা ইউনিয়নের দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম দক্ষিণ ইদিলপুর। এ গ্রামের বিত্তহীন কিষানী মহিরন বেগম (২৮) কেঁচো বিল্পব ঘটিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি সুনাম ও খ্যাতি কুড়িয়েছেন। অভাবী ঘরে জন্ম নেয়া মহিরন ছোটবেলায় পড়াশুনা করতে পারেননি। কিশোর বয়সে তার বিয়ে হয় গ্রামের দিন মজুর সুরুজ আলীর সাথে। কামলা খাটা সামান্য আয়ে খাওয়াপড়া জুটতো না। এর মধ্যে পর পর জন্ম নেয় ছয় সন্তান। অভাব-অনটন আর সন্তান-সন্ততীর ভারে ডুবে যেতে বসে ছোট্ট সংসার। 

এ অবস্থায় ২০০৯ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার সাথে যুক্ত হয় মহিরন বেগম। সচেতনতা ও দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগল পালনের মাধ্যমে পথ চলা শুরু হয়। পরবর্তীতে সিবিএসডিপি এনজিওর কেঁচো সার উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয় মহিরন। সংস্থাটি তাকে দু’টি চাড়ি ও ৫০টি কেঁচো দিয়ে ভার্মী কেঁচো চাষ শুরু করান। উৎপাদিত সার দিয়ে নিজের জমিতে সবজি চাষ করেন। 
রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই সবজি উৎপাদন দেখে সবাই হতবাক হয়ে যায়। মহিরন কেঁচো সার উৎপাদনের পরিধি বাড়ালে আয়ও দিন দিন বাড়তে থাকে। গতবার ৭০ মণ ভার্মি সার ২৮ হাজার টাকায় এবং প্রতিটি কেঁচো দুই টাকা দরে বিক্রি করে দুই হাজার টাকা রোজগার করেন। তার অভিজ্ঞতা ও সাফল্য দেখে সবাই অভিভূত হয়ে যায়। 

দেশের অন্যান্য জায়গায় কর্মরত বেসরকারি সংস্থা কেঁচো উৎপাদনে প্রশিক্ষক হিসাবে মহিরনকে নিয়ে যান। এ  থেকেও কিছু টাকা তিনি আয় করে থাকেন। মহিরন বেগমের বাড়ি এখন কেঁচো সারের কারখানা। সকাল-বিকাল নিজের সন্তানের মত কেঁচোকে যতœ করেন। বাড়ির আশপাশের খড়কুটো, সবুজ লতাপাতা, ঘরবাড়ি ঝাড়া ময়লা আবর্জনা, তরিতরকারি উচ্ছিষ্ট, গোবর, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগীর বিষ্ঠা দিয়ে প্রিকম্পোষ্ট তৈরি করে কেঁচোকে খাওয়ায়। মহিরন বেগম এবার পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা আয় করার আশা করছেন। কেঁচো চাষ করে অন্তত খাওয়াপড়ার দুশ্চিন্তাটুকু দূর করেছেন। এক ছেলেকে স্কুলে লেখাপড়াও করাচ্ছেন। 

মহিরনের দেখাদেখি গ্রামের আরো পঞ্চাশটি বিত্তহীন পরিবার কেঁচো সার তৈরির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। ভার্মি কেঁচো সারের চাহিদা দিনদিন বেড়ে চলেছে। ধান ছাড়াও আদা, হলুদ, কচু, আনারস, কলা, শাক-সবাজ ও ফুলের বাগানসহ সব ধরনের গাছে এ সার প্রয়োগ করা যায়। অনেকে পুকুরে মাছের সুষম খাবার হিসাবেও এর ব্যবহার করছেন। এই সার কৃষি, পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখছে বলে কৃষিবিদদের অভিমত। 

১৯৪২ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারোরা সর্ব প্রথম সুস্বাদু আনারস চাষ শুরু করে। পরবর্তীতে বাঙালী মহাজনরা আনারস চাষের সাথে জড়িত হওয়ায় এবং আনারসের আকার বড় করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, ক্ষতিকর হরমোন ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য ও ইকোসিস্টেম বিনষ্ট হচ্ছে। ফসলী জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। উপকারি কীটপতঙ্গ ও প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। 

ক্ষতিকর হরমোন দিয়ে ফল পাকানোয় ভোক্তারা ফল খেয়ে জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সিবিএসডিপি এ পরিস্থিতিতে পরিবেশ বান্ধব কৃষি বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম হাতে নেয়। এটি সিবিএসডিপির সবচেয়ে সফল প্রকল্প। আর কিষানী মহিরন বেগম এখন মডেল। 

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. হযরত আলী জানান, মহিরনের সাফল্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা দিয়েছে মধুপুর উপজেলায়। পরিবেশ বান্ধব কৃষির জন্য কেঁচো সার খুবই ফলপ্রদ।

Saturday, February 22, 2014

মাগুরায় উচ্চ ফলনশীল জাতের মসুর ডালের চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে কৃষকরা

মাগুরা: মাগুরায় উচ্চ ফলনশীল জাতের মসুর ডাল চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। চলতি রবি মৌসুমে মোট চাষকৃত জমির মধ্যে ৮৫ শতাংশ জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের মসুর ডালের চাষ হয়েছে। মাত্র ১৫ শতাংশ জমিতে চাষ হয়েছে স্থানীয় জাতের মসুর ডাল। এ বছর জেলার চার উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অধিক জমিতে মসুর ডালের চাষ হয়েছে। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর মসুর ডালের চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১২ হাজার ৯৩ হেক্টর জমিতে। চাষ হয়েছে ১৫ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩ হাজার ১৩৭ হেক্টর বেশি। এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের মসুর ডাল চাষ হয়েছে। চাষকৃত জমিতে থেকে ১৫ হাজার ৪৮০  মেট্টিক টন মসুর ডাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যে জেলার কৃষকরা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি- ৪, ৫ ও ৬ এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিনা-৩, ৪ জাতের উচ্চ ফলনশীল মসুর ডালের চাষ করেছে। উচ্চ ফলনশীল এসব জাত থেকে স্থানীয় জাতের তুলনায় দেড় থেকে দুই গুণের 

বেশি মসুর ডাল উৎপাদন হয়ে থাকে। স্থানীয় জাতে যেখানে মুসর ডাল উৎপাদন হয় একর প্রতি ৫ থেকে ৬ মণ। সেখানে বারি ও বিনা উচ্চ ফলনশীল জাতে মসুর ডাল একর প্রতি উৎপাদন হয় ১২ থেকে ১৫ মণ। এ ছাড়া বারি ও বিনা মসুর পরিবর্তিত আবহাওয়ায় চাষ করা যায়। কুয়াশা ও রোদের তাপমাত্রা বেড়ে গেলেও এর ফুল নষ্ট না হয়ে ফলন ঠিক থাকে।  

কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ মেট্টিকটন মসুর ডালের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে উৎপাদন হয় ৫ থেকে ৬ মেট্রিক টন মসুর ডাল। মসুর ডালের এ ঘাটতি  মেটাতে প্রতি বছর বিদেশ থেকে ডাল আমদানী করতে হয়। ব্যাপকভাবে উচ্চ ফলনশীল জাতের এ ডালের চাষ ছড়িয়ে দিতে এবং আমদানী নির্ভরতা কমাতে উচ্চ ফলনশীল মসুর ডালের চাষে কৃষকদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের বিভিন্ন সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি ডাল, তৈলসহ বিভিন্ন ধানের উন্নত মানের ফসলের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের আওতায় মাঠ দিবস কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। জেলায় এ বছর মসুর ডালের বাম্পার ফলনের পাশাপাশি আগমীতে ডাল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে সেই সাথে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ। চলতি মৌসুমে কৃষি বিভাগের সহায়তায় অধিক জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের মসুর ডাল চাষ হওয়ার ডালের ভালো ফলন পাবেন বলে আশা করছেন কৃষকরাও।

সদর উপজেলার সাচানী গ্রামের কৃষক মতিয়ার রহমান  বলেন, ‘আমি অন্যান্য বছর স্থানীয় জাতের মসুর ডাল চাষ করে একরে ৪ থেকে ৫ মণ ফলন পেতাম। এ বছর স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় ১ একর জমিতে বারি-৫ ও ৬ জাতের মসুর ডাল প্রর্দশনী ক্ষেত  করেছেন। যা থেকে আমি কমপক্ষে ১৫ মণ ডাল পাব বলে আশা করছি। যা সাধারণ জাতের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ।’

পথরা গ্রামের কৃষক জিল্লুর রহমান বলেন- ‘ফলন কম হওয়ায় আগে আমরা শুধু পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে ডাল চাষ করতাম। বর্তমানে উন্নত জাতের ডাল চাষ বেশ লাভজনক হওয়ায় আমরা অধিক জমিতে মসুর ডাল চাষ করছি। দেড় একর জমিতে যেভাবে ফলন এসেছে তাতে তিনি প্রায় ২৩ মন মসুর ডাল পাবেন বলে ধারণা করছেন।’ 

মাগুরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোখলেছুর রহমান জানান- সাধারণ জাতের মসুর ডাল যেখানে একরে উৎপাদন হয় ৫ থেকে ৬ মণ। সেখানে বারি ও বীনা- জাতের উচ্চ ফলনশীল ডালের উৎপাদন হয় ১২ থেকে ১৫ মণ। এর পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তিতে ধানের মত লাইন সুইং পদ্ধতিতে মসুর আবাদ করলে এ উৎপাদন বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় একরে ২০ মণের উপরে। 

দেশে ডালের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে জেলার অধিকাংশ জমিতে উন্নত জাতের মসুর ডাল চাষ হয়েছে। এ জন্যে কৃষকদের মাঝে কৃষি বিভাগ কর্তৃক উন্নতজাতের বীজ সরবরাহের পাশাপশি প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়া হয়েছে। উন্নত জাতের এ মসুর ডাল চাষ বাড়াতে বর্তমানে কৃষক মাঠ দিবসের মাধ্যমে কৃষকদের বীজ সংরক্ষণের জন্য পাত্রসহ প্রযুক্তিগত জ্ঞান দেয়া হচ্ছে। এতে করে কৃষকরা উন্নত জাতের এ মসুর ডাল চাষে আরও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।